হাওর বার্তা ডেস্কঃ লাইলী বেগম। মিয়ানমারের চাইন্দাপাড়া থেকে পালিয়ে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ হয়ে কুতুপালংয়ে একটি রাস্তার ধারেই এখন তার ঠিকানা। স্বামী মো. রফিকুল ইসলামকে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী তার সামনেই গুলি করে মেরে ফেলে।
বারো বছরের নিচে পিঠাপিঠি চার ছেলে তৈয়ব, আহমেদ আলম, মো. আইয়াজ ও মো. ইউনূসকে নিয়ে কোনোমতে পালিয়ে আসেন তিনি। এখনো খোলা আকাশই ঠিকানা এই বিধবা নারীর। কান্নাজড়িত কণ্ঠে লাইলী বেগম নিজের ভাষায় জানান, ‘আই এখন কডে যাইয়ুম। চার পোয়াকে কনে চাইবো। আল্লা আরে বাঁচাও।’
এই আর্তনাদ শুধু লাইলী বেগমেরই নয়, মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা অধিকাংশ নারীরই। তাদের পরিচয় এখন ‘বিধবা’। তাদের স্বামীর পাশাপাশি ছেলে মেয়ে ও ভাইবোনদের হত্যা করেছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও মগরা। শুধু মেরেই ক্ষান্ত হয়নি, বাড়িঘর, দোকানপাট জ্বালিয়ে দিয়েছে। অনেক বিধবা নারীকে সম্ভ্রমহানীও করেছে।
প্রাণ নিয়ে কোনোমতে পালিয়ে আসার সময় কেড়ে নিয়েছে শেষ সম্বল গায়ে থাকা স্বর্ণালঙ্কারও। সহায় সম্পদ তো আগেই হাতছাড়া। মিয়ানমারের উদয়ং থেকে প্রাণ নিয়ে থাইংখালী পালিয়ে এসেছেন রেহেনা খাতুন নামে এক মধ্যবয়সী নারী। তার স্বামী দ্বীন মোহাম্মদের একটি দোকান ছিল স্থানীয় বাজারে। সেখানে মগরা ঢুকে তার স্বামীকে কুপিয়ে হত্যা করেছে।
তার বাড়িতে আগুন দেওয়ার আগেই তিন ছেলে এনামুল, আসমত উল্লাহ, হেদায়েতুল্লাহ ও তিন মেয়ে আসমা, সাদিয়া ও সাদেকাকে নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন। লুনা বেগম নামে সাত মাসের আরেক গর্ভবর্তী নারীর সঙ্গে কথা হয় একই এলাকায়। মিয়ানমারের নাইকং থেকে শাহপরীর দ্বীপ হয়ে শিলখালীতে অনুপ্রবেশ করেন।
এক ভাইয়ের সহযোগিতা নিয়ে কোলে এক বাচ্চাকে নিয়ে ১৫ দিনে বাংলাদেশে আসেন। তার স্বামী রবি আলমকেও গুলি করেছে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা। একইসঙ্গে মসজিদ জ্বালিয়ে বাবা আবদুল্লাহকেও পুড়িয়ে মেরেছে তারা। এখন তার ঠিকানা টেংখালীর জামতলা মাঠে। গতকাল যখন তার কথা হয়, তখন তিনি অঝোর ধারায় কাঁদছিলেন।
আয়েশা, ওসমানী, রাইজু ও ঝরনাতারা—চার তরুণী মেয়েকে নিয়ে সুখেই ছিলেন সালমা খাতুন। তিনি ও নাইচং থেকে শাহপরীর দ্বীপ হয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেন। ২৫ আগস্টের রাতে তার স্বামীকে ধরে নিয়ে যায় স্থানীয় পুলিশ। জেলে নিয়ে যাওয়ার কথা বললেও পরে তার আর কোনো সন্ধান মেলেনি। এরপরদিনই যুবতী চার কন্যাকে নিয়ে জীবন বাঁচাতে পাড়ি দেন বাংলাদেশের উদ্দেশে।
অনেক কষ্টে এখন তার ঠিকানা হয়েছে পালংখালীর রাস্তার পাশে। মিয়ানমার থেকে আগত ১৫ জন নারীর সঙ্গে কথা ছয়, তারা বলছেন স্বামী নেই। তরুণ ছেলেও হারিয়েছেন অনেকেই। কেউ কেউ বলেছেন, তার সামনেই নিজের যুবতী মেয়েকে সম্ভ্রম নষ্ট করা হয়েছে। সম্ভ্রমহানীই শেষ নয়, তার হাত পায়ের নখ উপড়ে ফেলা হয়েছে। বিভিন্ন স্পর্শকাতর স্থানে ছেঁকা দেওয়া হয়েছে। মেরে ফেলা হয়েছে অনেক তরুণীকে।
বালুখালী এলাকায় এক শরণার্থী শিবিরে অবস্থান নেওয়া মরিয়ম বিবি (৬৫) জানান, যুবক, যুবতী ও বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদেরও পৃথক লাইন করা হতো। তরুণ-যুবকদের পৃথক লাইনে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। যুবতীদের নিয়ে যাওয়া হয় আলাদা স্থানে। সেখানে বার্মিজ মিলিটারি ও পুলিশরা যুবতীদের গণ হারে সম্ভ্রমহানী করে। এমনকি অনেক মেয়েকে হত্যাও করা হয়। কেউ কেউ কাকুতি মিনতি করে নিজেকে ছাড়িয়ে এনে পালিয়ে আসে বাংলাদেশে।
বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের চরম নির্যাতন করে বলা হয়, তোরা দ্রুত বাংলাদেশে চলে যা। ওটাই তোদের ঠিকানা। টেকনাফে রোহিঙ্গা শিশুর মৃতদেহ উদ্ধার : টেকনাফ উপকূল থেকে আরও এক রোহিঙ্গা শিশুর লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। গতকাল দুপুর দেড়টার দিকে দ্বীপের পশ্চিমপাড়া সাগর উপকূলে ভেসে আসা রোহিঙ্গা শিশুর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।
টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মাইন উদ্দিন খান বলেন, ‘বৃহস্পতিবার শাহপরীর দ্বীপ উপকূলের কাছে সাগরে রোহিঙ্গাবাহী দুটি নৌকা ডুবে যায়। এ ঘটনায় আজ দুপুরে আরও এক রোহিঙ্গা শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এ ঘটনায় আরও অনেকে নিখোঁজ থাকতে পারে। নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে একজন বাংলাদেশিও রয়েছে।’
টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য নুরুল আমিন বলেন, ‘নিখোঁজ বাংলাদেশির নাম মো. শাকের (৩০)। তিনি শাহপরীর দ্বীপের পশ্চিমপাড়ার বাসিন্দা আলী হোসেনের ছেলে। শাকের একটি নৌকার মাঝির সহকারী ছিলেন। এদিকে গতকালও মিয়ানমার সীমান্তের কয়েকটি গ্রামে আগুন দেওয়ার খবর পাওয়া গেছে।