ঢাকা ১০:৪৫ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ০৮ জানুয়ারী ২০২৫, ২৫ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

স্কুলে স্কুলে কোচিং সেন্টার

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১১:৪৮:২৭ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭
  • ৩৪৪ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ সকাল সাড়ে ৯টা। স্কুলের ক্লাস চলাকালীন সময় গণিতের কোচিং পড়াচ্ছেন একজন সহকারী শিক্ষক। ক্লাস বাদ দিয়ে কেন কোচিং পড়াচ্ছেন? এমন প্রশ্নে সোজাসাপটা জবাব। সামনে জেএসসি পরীক্ষা। কোচিং-এ মনোযোগ না দিলে ছাত্রদের ফলাফল খারাপ হবে। তাই বলে স্কুল সময় ক্লাসরুমে কোচিং? এমন প্রশ্নে তার জবাব স্কুল কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়েই করাচ্ছি। যদিও স্কুলের প্রধান শিক্ষক ফরহাদ হোসেন এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, কোনো শিক্ষক আমার কাছ থেকে এ ধরনের অনুমতি নেননি। গতকাল রাজধানীর মিরপুরে মণিপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের মূল শাখায় সরজমিন গিয়ে এমন চিত্র দেখা যায়। শুধু মণিপুর নয়, রাজধানীর অধিকাংশ স্কুলে এখন মিনি কোচিং সেন্টারে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি মতিঝিল আইডিয়াল, সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুল, ভিকারুননিসা নূন স্কুল, গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরিসহ রাজধানীর কয়েকটি স্কুল সরজমিন ঘুরে এমন চিত্রের দেখা মিলে। ঈদের পর স্কুলে ক্লাস পুরোপুরি শুরু না হলেও পুরোদমে চলছে কোচিং সেন্টারগুলো। মিরপুর মণিপুর স্কুলের ভিতরে প্রকাশ্যে চলছে কোচিং। সামনে এসএসসি, জেএসসি, পিইসি পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে প্রত্যেক স্কুলে একটি মিনি কোচিং সেন্টার গড়ে তুলেছেন কোচিংবাজ শিক্ষকরা। ক্লাস না হলেও কোচিং বাধ্যতামূলক। এমন রীতি চালু আছে স্কুলগুলোয়। আর এ সবই হচ্ছে স্কুল কর্তৃপক্ষ, প্রশাসনের নাকের ডগায়। শিক্ষকদের এমন অপতৎপরতা বন্ধ করতে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ইতিমধ্যে সংস্থাটি রাজধানীর কয়েকটি স্কুলের কয়েকশ’ কোচিংবাজ শিক্ষকের তালিকা সংগ্রহ করেছে। শিগগিরই তাদের বিরুদ্ধে আভিযানে নামবে বলে জানিয়েছেন তারা। এছাড়াও পর্যায়ক্রমে সারা দেশে কোচিংবাজ শিক্ষকদের তালিকাও সংগ্রহ করতে সংস্থাটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। এই তালিকা সংগ্রহ করছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। সাধারণ শিক্ষকদের অভিযোগ, দুদকের চাহিদা মোতাবেক কোচিংবাজ শিক্ষকদের তালিকা পাঠাতে গিয়েও গোঁজামিলের আশ্রয় নিয়েছেন প্রধান শিক্ষক এবং শিক্ষকদের সিন্ডিকেট। ‘কোচিংবাজ শিক্ষকদের তালিকা করার নামে বাণিজ্যে নেমেছেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। যারা মোটা অংকের টাকা দিচ্ছেন কোচিংবাজ হওয়ার পরও তাদের নাম দুদকে যায়নি। অথচ কোচিং না করিয়েও সাধারণ শিক্ষকদের নাম চলে গেছে দুদকের তালিকায়।
গত মঙ্গলবার রাজধানীর কোচিং সেন্টারের কেন্দ্র বলে পরিচিত উত্তর শাহজাহানপুরে মসজিদের পাশে ৪৭৩ হোল্ডিং-এ তিনতলা বাড়িতে গিয়ে দেখা গেলো পুরো বাড়িটিই ভাড়া নিয়েছেন কোচিং সেন্টারের সঙ্গে সম্পৃক্তরা। ভোর থেকে শুরু হয়ে রাত পর্যন্ত বিভিন্ন ক্লাসের ৩০টির বেশি ব্যাচে শিক্ষার্থীদের কোচিং করানো হয় এখানে। পাশে একটি রুমে বরাদ্দ রাখা হয়েছে অভিভাবকদের বিশ্রামের জন্য। আইডিয়াল স্কুলের শিক্ষকরা এ কোচিং সেন্টারের উদ্যোক্তা। এলাকাবাসী জানান, আইডিয়াল স্কুলের ১০-১২ জন শিক্ষক এক হাজারের বেশি শিক্ষার্থীকে এখানে পড়ান। স্কুল চলাকালীন সময় কিভাবে শিক্ষকরা আসেন এমন প্রশ্নও করেন তারা।
জানা গেছে, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলে মোট সাড়ে ৬শ’ শিক্ষক কর্মরত আছেন। এর মধ্যে ৪২৯ জনই কোনো না কোনোভাবে কোচিংয়ের সঙ্গে যুক্ত। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে পাঠানো এ প্রতিষ্ঠানের কোচিংবাজ শিক্ষকদের তালিকায় মতিঝিল আইডিয়ালের মূল শাখায় ৮৯ জন, প্রভাতী শাখার ১০২ জন, বনশ্রী শাখার প্রভাতীতে ৮২, দিবায় ৭৭ জন, ইংরেজি ভার্সন ২৪ জন, মুগদা শাখায় দিবা ও প্রভাতী মিলে ৪০ জন, মতিঝিল মূল শাখায় ইংরেজি ভার্সন ৩৬ জন, প্রভাতী শাখায় ২৯ জন শিক্ষকের নাম দেয়া হয়েছে। কিন্তু দুদকের কাছে মাত্র ১২৮ জন শিক্ষকের নাম পাঠানো হয়েছে। এই তালিকা নিয়ে মহা কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটিয়েছেন প্রধান শিক্ষক। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আইডিয়াল স্কুলের প্রধান শিক্ষক ড. শাহান আরা বেগম বলেন, কোনো শিক্ষক আমার অনুমতি নিয়ে কোচিং করান না। দুদক কোচিংবাজ শিক্ষকদের তালিকা চেয়েছে আমরা সংগ্রহ করে পাঠাবো। তিনি জানান, তিনটি শাখায় ৬৬০ জন শিক্ষক আছেন। কারা কোচিং পড়ান, কারা পড়ান না, তা যাচাই-বাছাই করে পাঠাতে হবে। ইতিমধ্যে দুদকের কাছে যে তালিকা পাঠানো হয়েছে তা স্কুল কর্তৃপক্ষের না বলেও দাবি করেন তিনি।
ডশক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে পাঠানো তিনটি ক্যাটাগরি অতি উৎসাহী, শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের চাপ এবং অবসর সময়ে বাসায় পড়ান এই তিন ক্যাটাগরির কোচিংবাজ শিক্ষকদের তালিকা পাঠানো হয়েছে। এরমধ্যে অতি উৎসাহী, যারা ক্লাস বাদ দিয়ে কোচিংয়ে যেতে শিক্ষার্থী, অভিভাবকদের জিম্মি করেন এবং নিজেরাই কোচিং সেন্টার খুলে বসেছেন এদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে। অতি উৎসাহী শিক্ষক হিসেবে যাদের নাম এসেছে তারা হলেন- মূল শাখার এবিএম নাসির উদ্দিন, শাখাওয়াত হোসেন, জহুরুল ইসলাম, মুহা. ফিদা হোসেন, মো. আলী মোর্তুজা, গৌরাঙ্গ চন্দ্র দাস, আজমল হোসেন, নাসির উদ্দিন, মাহফুজুর রহমান, আফসার উদ্দিন, প্রভাতী শাখায় আবদুল সালাম, শাহজাদী বেগম, শেখ মোহাম্মদ শামসুদ্দীন, নিজাম উদ্দিন কামাল, আকলিমা খাতুন, সেবিকা রানী পাল, ফখরুল ইসলাম, ফারহানা আফরোজ, মুরাদ আহমেদ। বনশ্রী প্রভাতী শাখার অতি উৎসাহী কোচিংবাজ শিক্ষকরা হলেন- ইশরাত জাবীন বানু, মোছলেহ উদ্দিন, শাহনাজ আক্তার, আবদুল হান্নান, বিল্লাল হোসেন, আবদুুল্লাহ আল মানিক, সেখ মিরাজুল ইসলাম, আফিফা সুলতানা, মাসুম বিল্লাল, ফরিদুজ্জামান, ফরিদ উদ্দিন, শাহাদাৎ হোসেন বেপারী, গোলাম ফারুক পাটওয়ারী, তাফাজ্জল হোসেন মজুমদার, শাহজালাল ঢালী। বনশ্রী দিবা শাখার শিক্ষকরা হলেন- এসএম কামরুজ্জামান, মাসুম বিল্লাহ, আল-হেলাল উদ্দিন, সফিকুল আলম, এসএম হাফিজুর রহমান, আতিকুজ্জামান মৃধা, আঃ কাদির দেওয়ান মোকসেদুল হক, মোরশেদ আলম, গৌতম কুমার শিকদার, জসিম উদ্দিন, আমিনুন বারী, কাজী ফখরুদ্দিন, আনিসুর রহমান, রফিকুল ইসলাম, সোহরাব হোসেন, আল আমিন, বজলুল রহমান, রেজাউল ইসলাম, রিয়াজুল ইসলাম, রিপন আহমেদ খান, শহীদুল্লাহ তরফদার, গোলাম রব্বানী, তাইজুল ইসলাম, উদয় শংকর অধিকারী।  মুগদা শাখার দিবা ও প্রভাতী শাখার এএফএম নোমান তালুকদার, মাহবুবুর রহমান খান, জিয়াউল হক, গোলাম মো. সাইফুল্লাহ, মুহাররম হোসেন, মঈনুল ইসলাম, মুনিরা আখতার, কৃঞ্চা বিশ্বাস তৃষা, আশরাত জাহান ফিরোজী, অ্যান্টিনা সরকার, মাহমুদা খাতুন, ফাতিমা খানম লাকী। মতিঝিলে ইংরেজি ভার্সনের আবু বক্কর সিদ্দিক, মোজাম্মেল হক, মাকসুদুল ইসলাম, মহিউদ্দিন, আবদুল কাইয়ুম, মাহবুবুর রহমান, জিসান আহমেদ, অলক কুমার বিশ্বাস, শফিকুল ইসলাম।
শুধু শাহজাহানপুর নয়, ফার্মগেট, মৌচাক-মালিবাগ, আরামবাগ, আজিমপুরের চায়না গলি, নীলক্ষেত, সিদ্ধেশ্বরী, শান্তিনগর মোড়, শাহজাহানপুর, মতিঝিলের বেনজীরবাগান, বনশ্রী-মুগদাপাড়া, কাকরাইল, মিরপুর-উত্তরার বিখ্যাত স্কুলগুলোর আশপাশের এলাকা ইতিমধ্যেই ‘কোচিং অঞ্চল’ হিসেব সবার কাছে পরিচিতি লাভ করেছে। এসব এলাকায় হাঁটলেই নজরে পড়ে শ’ শ’ বাণিজ্যিক কোচিং সেন্টারের সাইনবোর্ড। এছাড়া রাজধানীর অলি-গলিতে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন স্যার’র নামে কোচিং সেন্টার। হাঁটলেই দেয়ালে, বিদ্যুতের খুঁটিতে, বাসের পেছনে, ব্যানারে, পোস্টারে-ফেস্টুনে, ওভারহেড সাইনবোর্ডে দেখা যায় প্রাইভেট আর কোচিংয়ের বিজ্ঞাপন। পত্রিকায় টিউটর/গৃহশিক্ষক দিচ্ছি বিজ্ঞাপন-লিফলেট অহরহই চোখে পড়ে। আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রায় ৪শ’ শিক্ষক শাহজাহানপুর ও বনশ্রী এলাকায় এমন কোচিং বাণিজ্য সেন্টার গড়ে তুলে প্রতি মাসে প্রায় সোয়া তিন কোটি টাকা আয় করছেন তারা। রাজধানীর অন্যান্য বিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকও এভাবে কোচিং সেন্টার খুলে অনৈতিকভাবে অর্থ উপার্জন করছেন। নিরুপায় অভিভাবকরাও ভবিষ্যতের কথা ভেবে সেখানে পাঠাচ্ছেন সন্তানদের।
আইডিয়াল স্কুলের বনশ্রী শাখার সহকারী প্রধান শিক্ষক মোয়াজ্জেম হোসেন পড়ান ভূঁইয়াপাড়ার ২১৮/চ, বনশ্রী লিংক রোডের তৃতীয় তলায়। ৩শ’র বেশি শিক্ষার্থীকে গণিত ও পদার্থবিজ্ঞান পড়ান তিনি। তার যুক্তি, এই দুর্মূল্যের বাজারে বাড়তি আয়ের জন্য কিছু শিক্ষার্থীকে তো পড়াতেই হয়।’ কয়েকদিন ঘুরে দেখা গেছে, বনশ্রী এলাকার বিভিন্ন বাসায় আইডিয়াল স্কুলের শিক্ষক আমিনুল ইসলাম বারী, কামরুজ্জামান, আবদুল কাদির, মো. আলামিন, জসিম, আমিনুল, শফিকুল ইসলাম, গোলাম ফারুক পাটোয়ারী, শাহ্‌জালাল ঢালী, আল হেলাল, আবদুর রহিম প্রমুখ কোচিং করিয়ে থাকেন। তারা ছাড়াও এখানে একাধিক শিক্ষক কোচিং বাণিজ্য করছেন। শাহজাহানপুর এলাকায় সরজমিন ঘুরে দেখা গেছে, সেখানে কোচিং বাণিজ্য করছেন আইডিয়াল স্কুলের মতিঝিল শাখার শিক্ষক খন্দকার নাহিদ হাসান, মোজাম্মেল হক দোলন, সুবাস চন্দ্র পাল, সেবিকা রানী পাল, সাখাওয়াত সোহেল, আফসার উদ্দিন, আবুল কালাম আজাদ ছাড়াও বেশ কয়েকজন শিক্ষক।
কোচিং করাচ্ছেন শিক্ষক ইমাম হোসেন, আব্বাস উদ্দীন, নুরুল আমিন, পরিচালনা কমিটির শিক্ষক প্রতিনিধি রফিকুল ইসলাম, ক্রীড়া শিক্ষক মনজুরুল আলম, মো. আলী মোর্তুজা ও আলী নেওয়াজ আল করিম।
কোচিং সেন্টার খুলে অথবা ব্যাচভিত্তিক টিউশনি করানোর তালিকায় আরও রয়েছেন আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক মাসুদা হাসনাত (ইংরেজি), আবদুস সালাম (ইংরেজি), মোতাহার হোসেন (গণিত ও বিজ্ঞান), জুবাইদা রহমান (বাংলা), আবুল কালাম আজাদ-২ (গণিত), কামরুজ্জামান-২ (পদার্থবিজ্ঞান), তামান্না জাহান হামিদী (শারীরিক শিক্ষা), শামসুজ্জামান লুৎফা (আইসিটি), মোহাম্মদ হারুনুর রশীদ-৩ (গণিত), লাভলী আখতার (ইংরেজি), মোসাম্মৎ বিলকিস রুমা (চারুকলা) ও লুৎফুন নাহার (গণিত ও বিজ্ঞান)। অভিভাবকরা জানান, মুগদা শাখার কোচিংবাজ শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছেন এই শাখার সহকারী প্রধান শিক্ষক কাজল কান্তি বড়ুয়া, এএফএম নোমান তালুকদার, বেলায়েত হোসেন, মাহবুবুর রহমান খান, জয়নাল আবেদীন, রত্না দেবী নাথ, তানভীনা জামান, কামরুল হাসান, আতিয়া মেহের আফসানা, জিয়াউল হক, আমেনা বেগম, কাবিউল ইসলাম, মুক্তা বেগম, মির্জা জাহিদুল হাসান, আজিবর রহমান শেখ, আফজাল হোসেন, এসএম শাহজাহান, মঈনুল ইসলাম ও এসএম মাহমুদ উল আলম।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

স্কুলে স্কুলে কোচিং সেন্টার

আপডেট টাইম : ১১:৪৮:২৭ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭

হাওর বার্তা ডেস্কঃ সকাল সাড়ে ৯টা। স্কুলের ক্লাস চলাকালীন সময় গণিতের কোচিং পড়াচ্ছেন একজন সহকারী শিক্ষক। ক্লাস বাদ দিয়ে কেন কোচিং পড়াচ্ছেন? এমন প্রশ্নে সোজাসাপটা জবাব। সামনে জেএসসি পরীক্ষা। কোচিং-এ মনোযোগ না দিলে ছাত্রদের ফলাফল খারাপ হবে। তাই বলে স্কুল সময় ক্লাসরুমে কোচিং? এমন প্রশ্নে তার জবাব স্কুল কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়েই করাচ্ছি। যদিও স্কুলের প্রধান শিক্ষক ফরহাদ হোসেন এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, কোনো শিক্ষক আমার কাছ থেকে এ ধরনের অনুমতি নেননি। গতকাল রাজধানীর মিরপুরে মণিপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের মূল শাখায় সরজমিন গিয়ে এমন চিত্র দেখা যায়। শুধু মণিপুর নয়, রাজধানীর অধিকাংশ স্কুলে এখন মিনি কোচিং সেন্টারে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি মতিঝিল আইডিয়াল, সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুল, ভিকারুননিসা নূন স্কুল, গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরিসহ রাজধানীর কয়েকটি স্কুল সরজমিন ঘুরে এমন চিত্রের দেখা মিলে। ঈদের পর স্কুলে ক্লাস পুরোপুরি শুরু না হলেও পুরোদমে চলছে কোচিং সেন্টারগুলো। মিরপুর মণিপুর স্কুলের ভিতরে প্রকাশ্যে চলছে কোচিং। সামনে এসএসসি, জেএসসি, পিইসি পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে প্রত্যেক স্কুলে একটি মিনি কোচিং সেন্টার গড়ে তুলেছেন কোচিংবাজ শিক্ষকরা। ক্লাস না হলেও কোচিং বাধ্যতামূলক। এমন রীতি চালু আছে স্কুলগুলোয়। আর এ সবই হচ্ছে স্কুল কর্তৃপক্ষ, প্রশাসনের নাকের ডগায়। শিক্ষকদের এমন অপতৎপরতা বন্ধ করতে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ইতিমধ্যে সংস্থাটি রাজধানীর কয়েকটি স্কুলের কয়েকশ’ কোচিংবাজ শিক্ষকের তালিকা সংগ্রহ করেছে। শিগগিরই তাদের বিরুদ্ধে আভিযানে নামবে বলে জানিয়েছেন তারা। এছাড়াও পর্যায়ক্রমে সারা দেশে কোচিংবাজ শিক্ষকদের তালিকাও সংগ্রহ করতে সংস্থাটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। এই তালিকা সংগ্রহ করছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। সাধারণ শিক্ষকদের অভিযোগ, দুদকের চাহিদা মোতাবেক কোচিংবাজ শিক্ষকদের তালিকা পাঠাতে গিয়েও গোঁজামিলের আশ্রয় নিয়েছেন প্রধান শিক্ষক এবং শিক্ষকদের সিন্ডিকেট। ‘কোচিংবাজ শিক্ষকদের তালিকা করার নামে বাণিজ্যে নেমেছেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। যারা মোটা অংকের টাকা দিচ্ছেন কোচিংবাজ হওয়ার পরও তাদের নাম দুদকে যায়নি। অথচ কোচিং না করিয়েও সাধারণ শিক্ষকদের নাম চলে গেছে দুদকের তালিকায়।
গত মঙ্গলবার রাজধানীর কোচিং সেন্টারের কেন্দ্র বলে পরিচিত উত্তর শাহজাহানপুরে মসজিদের পাশে ৪৭৩ হোল্ডিং-এ তিনতলা বাড়িতে গিয়ে দেখা গেলো পুরো বাড়িটিই ভাড়া নিয়েছেন কোচিং সেন্টারের সঙ্গে সম্পৃক্তরা। ভোর থেকে শুরু হয়ে রাত পর্যন্ত বিভিন্ন ক্লাসের ৩০টির বেশি ব্যাচে শিক্ষার্থীদের কোচিং করানো হয় এখানে। পাশে একটি রুমে বরাদ্দ রাখা হয়েছে অভিভাবকদের বিশ্রামের জন্য। আইডিয়াল স্কুলের শিক্ষকরা এ কোচিং সেন্টারের উদ্যোক্তা। এলাকাবাসী জানান, আইডিয়াল স্কুলের ১০-১২ জন শিক্ষক এক হাজারের বেশি শিক্ষার্থীকে এখানে পড়ান। স্কুল চলাকালীন সময় কিভাবে শিক্ষকরা আসেন এমন প্রশ্নও করেন তারা।
জানা গেছে, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলে মোট সাড়ে ৬শ’ শিক্ষক কর্মরত আছেন। এর মধ্যে ৪২৯ জনই কোনো না কোনোভাবে কোচিংয়ের সঙ্গে যুক্ত। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে পাঠানো এ প্রতিষ্ঠানের কোচিংবাজ শিক্ষকদের তালিকায় মতিঝিল আইডিয়ালের মূল শাখায় ৮৯ জন, প্রভাতী শাখার ১০২ জন, বনশ্রী শাখার প্রভাতীতে ৮২, দিবায় ৭৭ জন, ইংরেজি ভার্সন ২৪ জন, মুগদা শাখায় দিবা ও প্রভাতী মিলে ৪০ জন, মতিঝিল মূল শাখায় ইংরেজি ভার্সন ৩৬ জন, প্রভাতী শাখায় ২৯ জন শিক্ষকের নাম দেয়া হয়েছে। কিন্তু দুদকের কাছে মাত্র ১২৮ জন শিক্ষকের নাম পাঠানো হয়েছে। এই তালিকা নিয়ে মহা কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটিয়েছেন প্রধান শিক্ষক। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আইডিয়াল স্কুলের প্রধান শিক্ষক ড. শাহান আরা বেগম বলেন, কোনো শিক্ষক আমার অনুমতি নিয়ে কোচিং করান না। দুদক কোচিংবাজ শিক্ষকদের তালিকা চেয়েছে আমরা সংগ্রহ করে পাঠাবো। তিনি জানান, তিনটি শাখায় ৬৬০ জন শিক্ষক আছেন। কারা কোচিং পড়ান, কারা পড়ান না, তা যাচাই-বাছাই করে পাঠাতে হবে। ইতিমধ্যে দুদকের কাছে যে তালিকা পাঠানো হয়েছে তা স্কুল কর্তৃপক্ষের না বলেও দাবি করেন তিনি।
ডশক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে পাঠানো তিনটি ক্যাটাগরি অতি উৎসাহী, শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের চাপ এবং অবসর সময়ে বাসায় পড়ান এই তিন ক্যাটাগরির কোচিংবাজ শিক্ষকদের তালিকা পাঠানো হয়েছে। এরমধ্যে অতি উৎসাহী, যারা ক্লাস বাদ দিয়ে কোচিংয়ে যেতে শিক্ষার্থী, অভিভাবকদের জিম্মি করেন এবং নিজেরাই কোচিং সেন্টার খুলে বসেছেন এদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে। অতি উৎসাহী শিক্ষক হিসেবে যাদের নাম এসেছে তারা হলেন- মূল শাখার এবিএম নাসির উদ্দিন, শাখাওয়াত হোসেন, জহুরুল ইসলাম, মুহা. ফিদা হোসেন, মো. আলী মোর্তুজা, গৌরাঙ্গ চন্দ্র দাস, আজমল হোসেন, নাসির উদ্দিন, মাহফুজুর রহমান, আফসার উদ্দিন, প্রভাতী শাখায় আবদুল সালাম, শাহজাদী বেগম, শেখ মোহাম্মদ শামসুদ্দীন, নিজাম উদ্দিন কামাল, আকলিমা খাতুন, সেবিকা রানী পাল, ফখরুল ইসলাম, ফারহানা আফরোজ, মুরাদ আহমেদ। বনশ্রী প্রভাতী শাখার অতি উৎসাহী কোচিংবাজ শিক্ষকরা হলেন- ইশরাত জাবীন বানু, মোছলেহ উদ্দিন, শাহনাজ আক্তার, আবদুল হান্নান, বিল্লাল হোসেন, আবদুুল্লাহ আল মানিক, সেখ মিরাজুল ইসলাম, আফিফা সুলতানা, মাসুম বিল্লাল, ফরিদুজ্জামান, ফরিদ উদ্দিন, শাহাদাৎ হোসেন বেপারী, গোলাম ফারুক পাটওয়ারী, তাফাজ্জল হোসেন মজুমদার, শাহজালাল ঢালী। বনশ্রী দিবা শাখার শিক্ষকরা হলেন- এসএম কামরুজ্জামান, মাসুম বিল্লাহ, আল-হেলাল উদ্দিন, সফিকুল আলম, এসএম হাফিজুর রহমান, আতিকুজ্জামান মৃধা, আঃ কাদির দেওয়ান মোকসেদুল হক, মোরশেদ আলম, গৌতম কুমার শিকদার, জসিম উদ্দিন, আমিনুন বারী, কাজী ফখরুদ্দিন, আনিসুর রহমান, রফিকুল ইসলাম, সোহরাব হোসেন, আল আমিন, বজলুল রহমান, রেজাউল ইসলাম, রিয়াজুল ইসলাম, রিপন আহমেদ খান, শহীদুল্লাহ তরফদার, গোলাম রব্বানী, তাইজুল ইসলাম, উদয় শংকর অধিকারী।  মুগদা শাখার দিবা ও প্রভাতী শাখার এএফএম নোমান তালুকদার, মাহবুবুর রহমান খান, জিয়াউল হক, গোলাম মো. সাইফুল্লাহ, মুহাররম হোসেন, মঈনুল ইসলাম, মুনিরা আখতার, কৃঞ্চা বিশ্বাস তৃষা, আশরাত জাহান ফিরোজী, অ্যান্টিনা সরকার, মাহমুদা খাতুন, ফাতিমা খানম লাকী। মতিঝিলে ইংরেজি ভার্সনের আবু বক্কর সিদ্দিক, মোজাম্মেল হক, মাকসুদুল ইসলাম, মহিউদ্দিন, আবদুল কাইয়ুম, মাহবুবুর রহমান, জিসান আহমেদ, অলক কুমার বিশ্বাস, শফিকুল ইসলাম।
শুধু শাহজাহানপুর নয়, ফার্মগেট, মৌচাক-মালিবাগ, আরামবাগ, আজিমপুরের চায়না গলি, নীলক্ষেত, সিদ্ধেশ্বরী, শান্তিনগর মোড়, শাহজাহানপুর, মতিঝিলের বেনজীরবাগান, বনশ্রী-মুগদাপাড়া, কাকরাইল, মিরপুর-উত্তরার বিখ্যাত স্কুলগুলোর আশপাশের এলাকা ইতিমধ্যেই ‘কোচিং অঞ্চল’ হিসেব সবার কাছে পরিচিতি লাভ করেছে। এসব এলাকায় হাঁটলেই নজরে পড়ে শ’ শ’ বাণিজ্যিক কোচিং সেন্টারের সাইনবোর্ড। এছাড়া রাজধানীর অলি-গলিতে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন স্যার’র নামে কোচিং সেন্টার। হাঁটলেই দেয়ালে, বিদ্যুতের খুঁটিতে, বাসের পেছনে, ব্যানারে, পোস্টারে-ফেস্টুনে, ওভারহেড সাইনবোর্ডে দেখা যায় প্রাইভেট আর কোচিংয়ের বিজ্ঞাপন। পত্রিকায় টিউটর/গৃহশিক্ষক দিচ্ছি বিজ্ঞাপন-লিফলেট অহরহই চোখে পড়ে। আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রায় ৪শ’ শিক্ষক শাহজাহানপুর ও বনশ্রী এলাকায় এমন কোচিং বাণিজ্য সেন্টার গড়ে তুলে প্রতি মাসে প্রায় সোয়া তিন কোটি টাকা আয় করছেন তারা। রাজধানীর অন্যান্য বিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকও এভাবে কোচিং সেন্টার খুলে অনৈতিকভাবে অর্থ উপার্জন করছেন। নিরুপায় অভিভাবকরাও ভবিষ্যতের কথা ভেবে সেখানে পাঠাচ্ছেন সন্তানদের।
আইডিয়াল স্কুলের বনশ্রী শাখার সহকারী প্রধান শিক্ষক মোয়াজ্জেম হোসেন পড়ান ভূঁইয়াপাড়ার ২১৮/চ, বনশ্রী লিংক রোডের তৃতীয় তলায়। ৩শ’র বেশি শিক্ষার্থীকে গণিত ও পদার্থবিজ্ঞান পড়ান তিনি। তার যুক্তি, এই দুর্মূল্যের বাজারে বাড়তি আয়ের জন্য কিছু শিক্ষার্থীকে তো পড়াতেই হয়।’ কয়েকদিন ঘুরে দেখা গেছে, বনশ্রী এলাকার বিভিন্ন বাসায় আইডিয়াল স্কুলের শিক্ষক আমিনুল ইসলাম বারী, কামরুজ্জামান, আবদুল কাদির, মো. আলামিন, জসিম, আমিনুল, শফিকুল ইসলাম, গোলাম ফারুক পাটোয়ারী, শাহ্‌জালাল ঢালী, আল হেলাল, আবদুর রহিম প্রমুখ কোচিং করিয়ে থাকেন। তারা ছাড়াও এখানে একাধিক শিক্ষক কোচিং বাণিজ্য করছেন। শাহজাহানপুর এলাকায় সরজমিন ঘুরে দেখা গেছে, সেখানে কোচিং বাণিজ্য করছেন আইডিয়াল স্কুলের মতিঝিল শাখার শিক্ষক খন্দকার নাহিদ হাসান, মোজাম্মেল হক দোলন, সুবাস চন্দ্র পাল, সেবিকা রানী পাল, সাখাওয়াত সোহেল, আফসার উদ্দিন, আবুল কালাম আজাদ ছাড়াও বেশ কয়েকজন শিক্ষক।
কোচিং করাচ্ছেন শিক্ষক ইমাম হোসেন, আব্বাস উদ্দীন, নুরুল আমিন, পরিচালনা কমিটির শিক্ষক প্রতিনিধি রফিকুল ইসলাম, ক্রীড়া শিক্ষক মনজুরুল আলম, মো. আলী মোর্তুজা ও আলী নেওয়াজ আল করিম।
কোচিং সেন্টার খুলে অথবা ব্যাচভিত্তিক টিউশনি করানোর তালিকায় আরও রয়েছেন আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক মাসুদা হাসনাত (ইংরেজি), আবদুস সালাম (ইংরেজি), মোতাহার হোসেন (গণিত ও বিজ্ঞান), জুবাইদা রহমান (বাংলা), আবুল কালাম আজাদ-২ (গণিত), কামরুজ্জামান-২ (পদার্থবিজ্ঞান), তামান্না জাহান হামিদী (শারীরিক শিক্ষা), শামসুজ্জামান লুৎফা (আইসিটি), মোহাম্মদ হারুনুর রশীদ-৩ (গণিত), লাভলী আখতার (ইংরেজি), মোসাম্মৎ বিলকিস রুমা (চারুকলা) ও লুৎফুন নাহার (গণিত ও বিজ্ঞান)। অভিভাবকরা জানান, মুগদা শাখার কোচিংবাজ শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছেন এই শাখার সহকারী প্রধান শিক্ষক কাজল কান্তি বড়ুয়া, এএফএম নোমান তালুকদার, বেলায়েত হোসেন, মাহবুবুর রহমান খান, জয়নাল আবেদীন, রত্না দেবী নাথ, তানভীনা জামান, কামরুল হাসান, আতিয়া মেহের আফসানা, জিয়াউল হক, আমেনা বেগম, কাবিউল ইসলাম, মুক্তা বেগম, মির্জা জাহিদুল হাসান, আজিবর রহমান শেখ, আফজাল হোসেন, এসএম শাহজাহান, মঈনুল ইসলাম ও এসএম মাহমুদ উল আলম।