ঢাকা ০৪:৩৯ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বানের ফানি আমরার ঈদের খুশিরে ভাসাইয়া নিছে

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১১:৪১:৩৬ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৯ অগাস্ট ২০১৭
  • ৬২৩ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ দুই বেলা খাইতাম ঐ ফাইনা। ফুলা ফানরা ফেটের ভুকে কান্দা কাটি করে। ফানি খাইয়া খিদা মিটাই। আমরার আবার ঈদ কিতা। আল্লায়ত আমরার ঈদ আগেই শেষ কইরা দিছইন। বানের ফানি আমরার ঈদের খুশিরে ভাসাইয়া নিয়া গেছে। চোখের পানি ফেলতে ফেলতে কথাগুলো বলছিলেন বানিয়াচংয়ের দৌলতপুর গ্রামের সর্বহারা কৃষক গেদু মিয়া। আগাম বন্যায় তলিয়ে গেছে তার কষ্টার্জিত সকল ফসল। মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা এনে ৫ খানি জমি করেছিলেন গেদু মিয়া। সবই তলিয়ে গেছে বানের পানিতে। এখন মহাজনের সুদের টাকার চিন্তায় রাতে ঘুম আসে না তার। ৩ মেয়ে ও দুই ছেলে নিয়ে ৫ সদস্যের সংসার। এদের পেট ভরে দু’বেলা খেতে দিতে পারেন না। আর কয়েকদিন পরেই ঈদ। কিন্তু ঈদের আনন্দ নাই তার পরিবারে। এ নিয়ে ভাবতেও চান না ষাটোর্ধ্ব বয়সী গেদু মিয়া। তার ভাবনা পরিবারের সদস্য নিয়ে কিভাবে খেয়ে বেঁচে থাকা যায়। এছাড়া আর কোনো ভাবনা আসে না তার মনে। ঈদ উপলক্ষে কোনো সরকারি-বেসরকারি সাহায্য জোটেনি তার কপালে। ছোট ছেলে মেয়েরা ঈদের বায়না করতে চাইলে সজোরে ধমক দিয়ে থামিয়ে দেন ছেলে-মেয়েদের। দুশ্চিন্তা আর নানা হতাশায় রাতে ঘুমুতে পারেন না গেদু মিয়া।
শুধু গেদু মিয়া নয় এ গ্রামের সবকটি পরিবারেই চলছে নীরব হাহাকার। ঈদ যেন কোনো জানান দিতে পারেনি তাদের মনে। সরজমিন বানিয়াচং উপজেলার দৌলতপুর, নোয়াগাঁও মাকালকান্দিসহ কয়েকটি গ্রাম ঘুরে চোখে পড়ে এসব চিত্র। সর্বত্রই বেঁচে থাকার প্রাণান্তর লড়াই করে চলেছেন বানভাসিরা। ঈদ আসছে এটুকই জানেন তারা। এর বেশি কোনো অনুভূতি নেই তাদের। নোয়াগাঁও গ্রামের কৃষাণী আলেয়া বেগম জানান, গরিবের আবার ঈদ কিতা। ঈদ তো বড় লোকের জন্য। অন্যান্য বছর গ্রামের বড় বড় কৃষকরা সকলেই কোরবানি দিতা। আমরারেও মাংস দিতা। ইবার সগলেরঐ ফসল তলাইয়া যাওয়ায় তারা কোরবানিও দিতানা। আমরারও মাংস ফাইবার আশা নাই। পরিবারের কনিষ্ঠ সদস্য ঝিলমিল।  ব্র্যাক স্কুলের ১ম শ্রেণির ছাত্রী। ভয়ে ভয়ে জানালো, আব্বারে কইছলাম ঈদের সময় নতুন একটা জামা কিইন্না দিতা। আব্বায় কইছইন ইবার ফারতানা। আগামী বছর কিইন্না দিবা। গ্রাম ঘুরে দেখা যায় কারো গোলায় এক চিমটি ধান নাই। গবাদি পশুর খাদ্য পর্যন্ত সংগ্রহ করতে পারেননি কৃষকরা।
হবিগঞ্জে অকাল বন্যায় তলিয়ে নিয়ে গেছে অধিকাংশ বোরো ফসল। চলতি বছরে জেলার ৮ উপজেলায় ১ লাখ ১৬ হাজার ৫১০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ করা হয়েছিল। এর মধ্যে ৬০ হাজার হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে গেছে। এতে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন জেলার ৯০ হাজার কৃষক। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় বানিয়াচং উপজেলায়। ফসলি জমির নব্বই ভাগই তলিয়ে যায় অকাল বন্যায়। এতে দিশাহারা হয়ে পড়েন উপজেলার প্রায় ৪০ হাজার কৃষক। বানিয়াচংয়ের চমকপুর গ্রামের হাওরের পাড়ে বসে ডুবে যাওয়া ফসলি জমির দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক মর্তুজ আলী। জমিতে এখন আর ধান নেই। যেটুকু দৃষ্টি যায় শুধু পানি আর পানি। এ পানিতেই তলিয়ে গেছে মর্তুজ আলীর স্বপ্ন। তার মতে, আমাদের আবার ঈদ। দু মুঠা খাইয়া বাইচ্চা নি থাকতাম পারি এইটাই বড় কথা। ছোট পুলাটার এক সাপ্তাহ ধইরা জ্বর। পারিনা ওষুধ আইন্না খাওয়াইতাম। কি যে করি। চোখে অন্ধকার দেখতাছি। নেতারা বড় বড় কথা কইন। আমরার লাগিত হেরার কোনো চিন্তা নাই। আমরা ঈদ না করলে হেরার কিতা। ভোটের সময় আইলেই আমরার দরকার। জানালেন, রাতে বাচ্ছাদের খাইয়ে যে অল্প ভাত ছিল স্ত্রীকে নিয়ে ভাগ করে কয়েক মুঠা খেয়েছিলেন। এখন বিকাল ৪টা পর্যন্ত আর খাবার জোটেনি। এভাবেই অনাহারে-অর্ধাহারে কাটছে তাদের জীবন। হাওরাঞ্চলের প্রতিটি পরিবারে চলছে নীরব দুর্ভিক্ষ। কোনো কোনো গ্রামে মুষ্টিমেয় লোকজন সরকারি ত্রাণ পেলেও তা নিতান্তই অপ্রতুল। ক্ষতিগ্রস্ত বানভাসিদের দুঃখ দুর্দশার কথা শুনার কেউ নেই। ঈদ পূজা কোন উৎসবই তাদের মনে আলাদা কোন অনুভূতির সৃষ্টি করে না। তাদের দাবি একটাই, শুধু মুখে নয় সরকার যেন তাদের পাশে এসে দাঁড়ায়। সবার মতো তারাও যেন ঈদের আনন্দে শরিক হতে পারে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

বানের ফানি আমরার ঈদের খুশিরে ভাসাইয়া নিছে

আপডেট টাইম : ১১:৪১:৩৬ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৯ অগাস্ট ২০১৭

হাওর বার্তা ডেস্কঃ দুই বেলা খাইতাম ঐ ফাইনা। ফুলা ফানরা ফেটের ভুকে কান্দা কাটি করে। ফানি খাইয়া খিদা মিটাই। আমরার আবার ঈদ কিতা। আল্লায়ত আমরার ঈদ আগেই শেষ কইরা দিছইন। বানের ফানি আমরার ঈদের খুশিরে ভাসাইয়া নিয়া গেছে। চোখের পানি ফেলতে ফেলতে কথাগুলো বলছিলেন বানিয়াচংয়ের দৌলতপুর গ্রামের সর্বহারা কৃষক গেদু মিয়া। আগাম বন্যায় তলিয়ে গেছে তার কষ্টার্জিত সকল ফসল। মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা এনে ৫ খানি জমি করেছিলেন গেদু মিয়া। সবই তলিয়ে গেছে বানের পানিতে। এখন মহাজনের সুদের টাকার চিন্তায় রাতে ঘুম আসে না তার। ৩ মেয়ে ও দুই ছেলে নিয়ে ৫ সদস্যের সংসার। এদের পেট ভরে দু’বেলা খেতে দিতে পারেন না। আর কয়েকদিন পরেই ঈদ। কিন্তু ঈদের আনন্দ নাই তার পরিবারে। এ নিয়ে ভাবতেও চান না ষাটোর্ধ্ব বয়সী গেদু মিয়া। তার ভাবনা পরিবারের সদস্য নিয়ে কিভাবে খেয়ে বেঁচে থাকা যায়। এছাড়া আর কোনো ভাবনা আসে না তার মনে। ঈদ উপলক্ষে কোনো সরকারি-বেসরকারি সাহায্য জোটেনি তার কপালে। ছোট ছেলে মেয়েরা ঈদের বায়না করতে চাইলে সজোরে ধমক দিয়ে থামিয়ে দেন ছেলে-মেয়েদের। দুশ্চিন্তা আর নানা হতাশায় রাতে ঘুমুতে পারেন না গেদু মিয়া।
শুধু গেদু মিয়া নয় এ গ্রামের সবকটি পরিবারেই চলছে নীরব হাহাকার। ঈদ যেন কোনো জানান দিতে পারেনি তাদের মনে। সরজমিন বানিয়াচং উপজেলার দৌলতপুর, নোয়াগাঁও মাকালকান্দিসহ কয়েকটি গ্রাম ঘুরে চোখে পড়ে এসব চিত্র। সর্বত্রই বেঁচে থাকার প্রাণান্তর লড়াই করে চলেছেন বানভাসিরা। ঈদ আসছে এটুকই জানেন তারা। এর বেশি কোনো অনুভূতি নেই তাদের। নোয়াগাঁও গ্রামের কৃষাণী আলেয়া বেগম জানান, গরিবের আবার ঈদ কিতা। ঈদ তো বড় লোকের জন্য। অন্যান্য বছর গ্রামের বড় বড় কৃষকরা সকলেই কোরবানি দিতা। আমরারেও মাংস দিতা। ইবার সগলেরঐ ফসল তলাইয়া যাওয়ায় তারা কোরবানিও দিতানা। আমরারও মাংস ফাইবার আশা নাই। পরিবারের কনিষ্ঠ সদস্য ঝিলমিল।  ব্র্যাক স্কুলের ১ম শ্রেণির ছাত্রী। ভয়ে ভয়ে জানালো, আব্বারে কইছলাম ঈদের সময় নতুন একটা জামা কিইন্না দিতা। আব্বায় কইছইন ইবার ফারতানা। আগামী বছর কিইন্না দিবা। গ্রাম ঘুরে দেখা যায় কারো গোলায় এক চিমটি ধান নাই। গবাদি পশুর খাদ্য পর্যন্ত সংগ্রহ করতে পারেননি কৃষকরা।
হবিগঞ্জে অকাল বন্যায় তলিয়ে নিয়ে গেছে অধিকাংশ বোরো ফসল। চলতি বছরে জেলার ৮ উপজেলায় ১ লাখ ১৬ হাজার ৫১০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ করা হয়েছিল। এর মধ্যে ৬০ হাজার হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে গেছে। এতে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন জেলার ৯০ হাজার কৃষক। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় বানিয়াচং উপজেলায়। ফসলি জমির নব্বই ভাগই তলিয়ে যায় অকাল বন্যায়। এতে দিশাহারা হয়ে পড়েন উপজেলার প্রায় ৪০ হাজার কৃষক। বানিয়াচংয়ের চমকপুর গ্রামের হাওরের পাড়ে বসে ডুবে যাওয়া ফসলি জমির দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক মর্তুজ আলী। জমিতে এখন আর ধান নেই। যেটুকু দৃষ্টি যায় শুধু পানি আর পানি। এ পানিতেই তলিয়ে গেছে মর্তুজ আলীর স্বপ্ন। তার মতে, আমাদের আবার ঈদ। দু মুঠা খাইয়া বাইচ্চা নি থাকতাম পারি এইটাই বড় কথা। ছোট পুলাটার এক সাপ্তাহ ধইরা জ্বর। পারিনা ওষুধ আইন্না খাওয়াইতাম। কি যে করি। চোখে অন্ধকার দেখতাছি। নেতারা বড় বড় কথা কইন। আমরার লাগিত হেরার কোনো চিন্তা নাই। আমরা ঈদ না করলে হেরার কিতা। ভোটের সময় আইলেই আমরার দরকার। জানালেন, রাতে বাচ্ছাদের খাইয়ে যে অল্প ভাত ছিল স্ত্রীকে নিয়ে ভাগ করে কয়েক মুঠা খেয়েছিলেন। এখন বিকাল ৪টা পর্যন্ত আর খাবার জোটেনি। এভাবেই অনাহারে-অর্ধাহারে কাটছে তাদের জীবন। হাওরাঞ্চলের প্রতিটি পরিবারে চলছে নীরব দুর্ভিক্ষ। কোনো কোনো গ্রামে মুষ্টিমেয় লোকজন সরকারি ত্রাণ পেলেও তা নিতান্তই অপ্রতুল। ক্ষতিগ্রস্ত বানভাসিদের দুঃখ দুর্দশার কথা শুনার কেউ নেই। ঈদ পূজা কোন উৎসবই তাদের মনে আলাদা কোন অনুভূতির সৃষ্টি করে না। তাদের দাবি একটাই, শুধু মুখে নয় সরকার যেন তাদের পাশে এসে দাঁড়ায়। সবার মতো তারাও যেন ঈদের আনন্দে শরিক হতে পারে।