ঢাকা ০৮:০২ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাড়ছে হাওর তীরের মানুষের অসহায়ত্ব

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১১:২৬:৪০ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৬ অগাস্ট ২০১৭
  • ৫২০ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ বন্যা আমাদের গিলে খাচ্ছে। প্রতিনিয়ত বাঁচা মরার এমন যুদ্ধে আমরা চরম অসহায়। আমাদের এমন দুর্দিনে দেশবাসীর সহযোগিতা চাই। দেশের সবচেয়ে বড় হাওর হাকালুকি আর কাউয়াদিঘি হাওরের বন্যাকবলিত মানুষের কান্নাজড়িত কণ্ঠে এমন আকুতি। হাওর পাড়ের কৃষি, মৎস্য ও শ্রমজীবী মানুষ দীর্ঘদিন থেকে পানিবন্দি থাকায় কর্মহীন। তাই নেই আয় রোজগার।  চারদিকে শুধু থৈ থৈ পানির সুরে তাদের রাতদিন একাকার। ঘরে খাবার নেই। থাকার জায়গা নেই। ক্ষেত কৃষি, রাস্তাঘাট আর ঘরবাড়ি সবই এখন পানির দখলে। চৈত্র মাসে শুরু হওয়া বন্যা এখনো থামেনি। বরং কয়েক দফা বন্যা দীর্ঘ হয়ে তা স্থায়ী জলাবদ্ধতায় পরিণত হচ্ছে। এ বছর বানের পানির এমন আকস্মিক আক্রমণে আউশ, আমন, বোরো আর সবজি ফসল কোনোটিই ঘরে তুলতে পারেননি এ অঞ্চলের কৃষক। হঠাৎ এমন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে সব হারিয়ে তারা নিঃস্ব। এমন পরিস্থিতিতে পরিবার পরিজন নিয়ে খাওয়া বাঁচার চিন্তায় চরম অসহায়। হাওর তীরের মানুষের জীবিকা নির্বাহের অন্যতম মাধ্যম ধান চাষ আর মাছ ধরা। এ বছর দীর্ঘ বন্যার কারণে জীবিকা নির্বাহের এ দুটি উৎস
থেকে তারা বঞ্চিত। দফায় দফায় দীর্ঘ বন্যা। তৃতীয় দফার চলমান বন্যায় স্থায়ী জলাবদ্ধতা। গেল ক’দিনের বৃষ্টি আর উজানের পাহাড়ি ঢল ৪র্থ দফা বন্যার আভাস। ইতিমধ্যে হাকালুকি হাওর তীরের জুড়ী উপজেলার কয়েকটি এলাকায় পানি বেড়ে নতুন করে দেখা দিচ্ছে বন্যা। গেল ক’দিন থেকে উজানের নেমে আসা পাহাড়ি ঢল আর বৃষ্টিতে নতুন করে বন্যার আশঙ্কায় স্থানীয় বাসিন্দারা। দফায় দফায় বন্যার সঙ্গে যুদ্ধ করে মানুষ বাসস্থান হারাচ্ছে। খাদ্য সংকটে পড়ছে। দেখা দিচ্ছে নানা রোগবালাই। মানুষের মতো খাদ্য আর বাসস্থান সংকটে গৃহপালিত পশুও। এবছর চৈত্রের অকাল বন্যায় সোনালি ফসল বোরো ধান কেড়ে নেয় উত্তাল হাওর। এরপর পচা ধানের বিষক্রিয়ায় মরে মাছ। বিষাক্ত পচা মাছ খেয়ে মারা যায় গৃহপালিত হাঁস। মরে জলজপ্রাণি ও উদ্ভিদ। হঠাৎ এমন বিপর্যয়ে দিশাহারা হয়ে পড়ে হাওর অঞ্চলের মানুষ। এরপর একের পর এক বন্যা। আর এখন বন্যা দীর্ঘ হয়ে স্থায়ী জলাবদ্ধতা। সহায় সম্বলহীন এ মানুষগুলো এখন অর্ধহারে অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। তাদের রাত দিন কাটছে দুশ্চিন্তায়। মাথাগুঁজার ঠাঁই ছাড়া নেই কোনো সম্বল। সেখানেও নিরাপদ নয় তারা। আফাল (বড় ঢেউ) আর বলনের (ঘূর্ণায়মান ঢেউ) তোড়ে রাক্ষুসে হাওর কেড়ে নিতে চায় তাদের ঘর বাড়ি। নানা কায়দা কৌশলে আফাল বলনের তোড় থেকে ঘর বাড়ি রক্ষার প্রচেষ্টা। কিন্তু বিশাল শক্তির কাছে তারা পরাস্ত হচ্ছে। এবার বন্যার পানিতে প্রচুর পরিমাণ জোঁক এসেছে। আর পানিতে রয়েছে চর্মরোগের জীবাণু। কিছু কিছু এলাকায় শরীরের কোনো অংশে বানের পানি লাগলেই চাকারমতো লাল দাগ হয়ে চুলকাতে থাকে। এমনটি ছাড়াও রয়েছে সাপের ভয়। এতদিন প্রতিশ্রুতির ফুলঝুড়িতে আশ্বস্ত ছিল হাওর তীরের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ। প্রতিদিনই ত্রাণের জন্য দীর্ঘ অপেক্ষার শেষেও নেই কোনো প্রাপ্তি। সরকারি তরফে এ পর্যন্ত যে সহায়তা এসেছে তা পর্যাপ্ত না হওয়ায় তা সবার ভাগ্যে জুটেনি। তাই দু’বেলা দু’মুঠো ভাতের জন্য পরিবারের কর্তারা হন্তদন্ত। সম্প্রতি হাকালুকি হাওর তীরবর্তী ভূকশিমইল, কাদিপুর, বরমচাল, ভাটেরা, জায়ফরনগর, পশ্চিম জুড়ী ইউনিয়ন ও কাউয়াদিঘি হাওরের একাটুনা, আখালকুড়া, পাঁচগাঁও, ফতেহপুর ইউনিয়নের গ্রামগুলোতে গেলে কথা হয় বন্যাকবলিত দুর্দশাগ্রস্ত লোকজনের সঙ্গে। তারা কান্নাজড়িত কণ্ঠে তাদের দুর্ভোগের কথা জানান। তারা জানালেন দীর্ঘ প্রায় ৬ মাস থেকে খেয়ে না খেয়ে কোন রকম বেঁচে আছেন। সরকারি সহায়তা কেউ পেয়েছেন আবার অনেকেই পাননি এমন অভিযোগও করেন তাদের। ঘরে পানি, উঠানেও পানি। চোখ যতদূর যায় সবখানেই পানি আর পানি। ক্ষোভে দুঃখে অনেকেই বললেন এ বছর বানের পানি আমাদের জন্য অভিশাপ হয়ে এসেছে। ধান আর সবজির পর মনে হচ্ছে এখন আমাদেরও খেতে চাইছে। প্রায় ৬ মাস হয়ে গেল কিন্তু কিছুতেই কমছে না পানি। বরং বৃষ্টি হলেই কমে যাওয়া পানি আবারও যেই সেই। বন্যার কারণে তারা অনেকটা গৃহবন্দি। ঘর থেকে বের হয়ে হাঁটার পথ নেই। সবই গিলে খেয়েছে পানি। তাই এ ঘর থেকে ও ঘরে যেতে নৌকাই একমাত্র ভরসা। বিশুদ্ধ খাবার পানি আর টয়লেট সমস্যা প্রকট। এ কারণে দূষিত পানি খেয়ে পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন তারা। হাকালুকি হাওর পাড়ের কানেহাতের সালাম মিয়া, তমিজ আলী, চকাপনের আব্দুল মুহিত ফটিক, সনজিত দেব নাথ, কানেশাইলের করিম মিয়া, ফরমুজ মিয়া, বাদেভূকশিমইলের শরিফ মিয়া, ইন্তাজ মিয়া, জরিপ মিয়াসহ অনেকেই বলেন বন্যায় ক্ষতির কথা বলতে গেলে ঘুরে ফিরে চলে আসে চৈত্রের অকাল বন্যায় কাঁচা থোড়ওয়ালা বোরো ধান হারানোর দৃশ্য। চোখের সামনে হঠাৎ উত্তাল হওয়া রাক্ষুসী হাওর সোনালী ফসল কেড়ে নিল। তারা জানানেল তাদের প্রত্যেকেরই ২-৩ একর জমিতে বোরো ধানের আবাদ ছিল। আবাদ হওয়া বোরো ফসলেই তাদের পরিবারের সারা বছরের জীবিকা নির্বাহ হত। এখন এসব শুধু স্মৃতি কথা। ধানের পর মাছ ও সবজি ক্ষেত হারিয়ে এখন তারা সর্বস্বান্ত। ক্ষতিগ্রস্তরা জানান এবারকার বন্যা অন্যান্য বন্যার চাইতে ভিন্ন। এবছর কয়েক দফা বন্যা হয়েছে। বন্যার শুরুও ছিল চৈত্র মাস। এখন তা স্থায়ী জলাবদ্ধতায় রূপ নিচ্ছে। অন্যান্য বছর বন্যা হলে কিছু হলেও ধান ঘরে তোলা সম্ভব হতো। ধান না হলে মাছ মিলত এ বছর এর কোন কিছুরই মিল নেই। তারা বলেন সরকারের কাছে আমাদের একটাই দাবি মৃত্যুপথযাত্রী হাকালুকি হাওরকে বাঁচানোর। হাকালুকি হাওর বাঁচলে আমরা বাঁচবো। আমরা যৎসামান্য ত্রাণ চাই না। আমরা কাজ করে খেতে চাই। আমরা কারো দয়া ভিক্ষা চাই না। দেশের সবচেয়ে বড় এই হাওরকে বাঁচাতে এখনই উদ্যোগী হন। তা না হলে বারবার এমন দুর্যোগ পোহাতে হবে। কাউয়াদিঘি হাওর পাড়ের ফতেহপুর ও একাটুনা ইউনিয়নের বাসিন্দা সায়েদ আলী, সাজু মিয়া, ফজলু মিয়া, এমরান মিয়া, মনোহর আলীসহ অনেকেই বলেন ৫ মাস থেকে তারা পানিবন্দী। বোরোধানের পর আমন ধানও খেয়েছে বানের পানি। সবজি ক্ষেতের জমিতেও পানি। এখন তাদের সব ধরনের চাষাবাদ বন্ধ। ঘর বাড়িতে দীর্ঘ প্রায় ৬ মাস থেকে পানি উঠে যাওয়ায় তারা চরম অসহায়। তারা সকলেই জানান তাদের এলাকায় বন্যা হলেও এরকম বানের পানি দীর্ঘ হয়ে জলাবদ্ধতায় রূপ নেয়ার কথা ছিল না। কারণ তাদের এমন দুর্দশা লাগবে কৃষকদের কল্যাণে বাস্তবায়ন হয়েছিল ‘মনু প্রকল্প’। নদী শাসনের এ প্রকল্পের আওতায় শত কোটি টাকা ব্যয়ে কাশিমপুর এলাকায় নির্মিত হয়েছিল পাম্প হাউজ। বর্ষা ও শুষ্ক মৌসুমে চাষিদের কল্যাণে যে পাম্প হাউজ সচল থাকার কথা ছিল নানা অজুহাতে ও সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতায় তা রয়েছে বিকল। ৯টি পাম্পের মধ্যে ৫টিই অকেজো। আর যে ৪টি সচল তাও বিদ্যুৎ না থাকাসহ নানা অজুহাতে তা থাকে অচল। তাছাড়া বিল ইজারাদের সঙ্গে পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুর্নীতিপরায়ণ কিছু কর্মকর্তা কর্মচারীর যোগসাজশের কারণে তাদের সুবিধানুযায়ী বর্ষায় সেচ দেয়া বন্ধ থাকে। আর শুষ্ক মৌসুমে তাদের ইশারায় সেচ দেয়। যাতে বিল ইজারাদাররা সহজেই মাছ ধরতে পারে। এ কারণে বর্ষা মৌসুমে বন্যায় দীর্ঘ জলাবদ্ধতা। আর শুষ্ক মৌসুমে পানি না থাকায় চাষাবাদে ব্যাঘাত ঘটে চাষিদের। স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের দাবি- দ্রুত পাম্প হাউজ সচল ও মনু প্রকল্পের খাল ও স্লুইস গেটের সংস্কারের মাধ্যমে এই সমস্যার স্থায়ী সমাধানের।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

বাড়ছে হাওর তীরের মানুষের অসহায়ত্ব

আপডেট টাইম : ১১:২৬:৪০ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৬ অগাস্ট ২০১৭

হাওর বার্তা ডেস্কঃ বন্যা আমাদের গিলে খাচ্ছে। প্রতিনিয়ত বাঁচা মরার এমন যুদ্ধে আমরা চরম অসহায়। আমাদের এমন দুর্দিনে দেশবাসীর সহযোগিতা চাই। দেশের সবচেয়ে বড় হাওর হাকালুকি আর কাউয়াদিঘি হাওরের বন্যাকবলিত মানুষের কান্নাজড়িত কণ্ঠে এমন আকুতি। হাওর পাড়ের কৃষি, মৎস্য ও শ্রমজীবী মানুষ দীর্ঘদিন থেকে পানিবন্দি থাকায় কর্মহীন। তাই নেই আয় রোজগার।  চারদিকে শুধু থৈ থৈ পানির সুরে তাদের রাতদিন একাকার। ঘরে খাবার নেই। থাকার জায়গা নেই। ক্ষেত কৃষি, রাস্তাঘাট আর ঘরবাড়ি সবই এখন পানির দখলে। চৈত্র মাসে শুরু হওয়া বন্যা এখনো থামেনি। বরং কয়েক দফা বন্যা দীর্ঘ হয়ে তা স্থায়ী জলাবদ্ধতায় পরিণত হচ্ছে। এ বছর বানের পানির এমন আকস্মিক আক্রমণে আউশ, আমন, বোরো আর সবজি ফসল কোনোটিই ঘরে তুলতে পারেননি এ অঞ্চলের কৃষক। হঠাৎ এমন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে সব হারিয়ে তারা নিঃস্ব। এমন পরিস্থিতিতে পরিবার পরিজন নিয়ে খাওয়া বাঁচার চিন্তায় চরম অসহায়। হাওর তীরের মানুষের জীবিকা নির্বাহের অন্যতম মাধ্যম ধান চাষ আর মাছ ধরা। এ বছর দীর্ঘ বন্যার কারণে জীবিকা নির্বাহের এ দুটি উৎস
থেকে তারা বঞ্চিত। দফায় দফায় দীর্ঘ বন্যা। তৃতীয় দফার চলমান বন্যায় স্থায়ী জলাবদ্ধতা। গেল ক’দিনের বৃষ্টি আর উজানের পাহাড়ি ঢল ৪র্থ দফা বন্যার আভাস। ইতিমধ্যে হাকালুকি হাওর তীরের জুড়ী উপজেলার কয়েকটি এলাকায় পানি বেড়ে নতুন করে দেখা দিচ্ছে বন্যা। গেল ক’দিন থেকে উজানের নেমে আসা পাহাড়ি ঢল আর বৃষ্টিতে নতুন করে বন্যার আশঙ্কায় স্থানীয় বাসিন্দারা। দফায় দফায় বন্যার সঙ্গে যুদ্ধ করে মানুষ বাসস্থান হারাচ্ছে। খাদ্য সংকটে পড়ছে। দেখা দিচ্ছে নানা রোগবালাই। মানুষের মতো খাদ্য আর বাসস্থান সংকটে গৃহপালিত পশুও। এবছর চৈত্রের অকাল বন্যায় সোনালি ফসল বোরো ধান কেড়ে নেয় উত্তাল হাওর। এরপর পচা ধানের বিষক্রিয়ায় মরে মাছ। বিষাক্ত পচা মাছ খেয়ে মারা যায় গৃহপালিত হাঁস। মরে জলজপ্রাণি ও উদ্ভিদ। হঠাৎ এমন বিপর্যয়ে দিশাহারা হয়ে পড়ে হাওর অঞ্চলের মানুষ। এরপর একের পর এক বন্যা। আর এখন বন্যা দীর্ঘ হয়ে স্থায়ী জলাবদ্ধতা। সহায় সম্বলহীন এ মানুষগুলো এখন অর্ধহারে অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। তাদের রাত দিন কাটছে দুশ্চিন্তায়। মাথাগুঁজার ঠাঁই ছাড়া নেই কোনো সম্বল। সেখানেও নিরাপদ নয় তারা। আফাল (বড় ঢেউ) আর বলনের (ঘূর্ণায়মান ঢেউ) তোড়ে রাক্ষুসে হাওর কেড়ে নিতে চায় তাদের ঘর বাড়ি। নানা কায়দা কৌশলে আফাল বলনের তোড় থেকে ঘর বাড়ি রক্ষার প্রচেষ্টা। কিন্তু বিশাল শক্তির কাছে তারা পরাস্ত হচ্ছে। এবার বন্যার পানিতে প্রচুর পরিমাণ জোঁক এসেছে। আর পানিতে রয়েছে চর্মরোগের জীবাণু। কিছু কিছু এলাকায় শরীরের কোনো অংশে বানের পানি লাগলেই চাকারমতো লাল দাগ হয়ে চুলকাতে থাকে। এমনটি ছাড়াও রয়েছে সাপের ভয়। এতদিন প্রতিশ্রুতির ফুলঝুড়িতে আশ্বস্ত ছিল হাওর তীরের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ। প্রতিদিনই ত্রাণের জন্য দীর্ঘ অপেক্ষার শেষেও নেই কোনো প্রাপ্তি। সরকারি তরফে এ পর্যন্ত যে সহায়তা এসেছে তা পর্যাপ্ত না হওয়ায় তা সবার ভাগ্যে জুটেনি। তাই দু’বেলা দু’মুঠো ভাতের জন্য পরিবারের কর্তারা হন্তদন্ত। সম্প্রতি হাকালুকি হাওর তীরবর্তী ভূকশিমইল, কাদিপুর, বরমচাল, ভাটেরা, জায়ফরনগর, পশ্চিম জুড়ী ইউনিয়ন ও কাউয়াদিঘি হাওরের একাটুনা, আখালকুড়া, পাঁচগাঁও, ফতেহপুর ইউনিয়নের গ্রামগুলোতে গেলে কথা হয় বন্যাকবলিত দুর্দশাগ্রস্ত লোকজনের সঙ্গে। তারা কান্নাজড়িত কণ্ঠে তাদের দুর্ভোগের কথা জানান। তারা জানালেন দীর্ঘ প্রায় ৬ মাস থেকে খেয়ে না খেয়ে কোন রকম বেঁচে আছেন। সরকারি সহায়তা কেউ পেয়েছেন আবার অনেকেই পাননি এমন অভিযোগও করেন তাদের। ঘরে পানি, উঠানেও পানি। চোখ যতদূর যায় সবখানেই পানি আর পানি। ক্ষোভে দুঃখে অনেকেই বললেন এ বছর বানের পানি আমাদের জন্য অভিশাপ হয়ে এসেছে। ধান আর সবজির পর মনে হচ্ছে এখন আমাদেরও খেতে চাইছে। প্রায় ৬ মাস হয়ে গেল কিন্তু কিছুতেই কমছে না পানি। বরং বৃষ্টি হলেই কমে যাওয়া পানি আবারও যেই সেই। বন্যার কারণে তারা অনেকটা গৃহবন্দি। ঘর থেকে বের হয়ে হাঁটার পথ নেই। সবই গিলে খেয়েছে পানি। তাই এ ঘর থেকে ও ঘরে যেতে নৌকাই একমাত্র ভরসা। বিশুদ্ধ খাবার পানি আর টয়লেট সমস্যা প্রকট। এ কারণে দূষিত পানি খেয়ে পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন তারা। হাকালুকি হাওর পাড়ের কানেহাতের সালাম মিয়া, তমিজ আলী, চকাপনের আব্দুল মুহিত ফটিক, সনজিত দেব নাথ, কানেশাইলের করিম মিয়া, ফরমুজ মিয়া, বাদেভূকশিমইলের শরিফ মিয়া, ইন্তাজ মিয়া, জরিপ মিয়াসহ অনেকেই বলেন বন্যায় ক্ষতির কথা বলতে গেলে ঘুরে ফিরে চলে আসে চৈত্রের অকাল বন্যায় কাঁচা থোড়ওয়ালা বোরো ধান হারানোর দৃশ্য। চোখের সামনে হঠাৎ উত্তাল হওয়া রাক্ষুসী হাওর সোনালী ফসল কেড়ে নিল। তারা জানানেল তাদের প্রত্যেকেরই ২-৩ একর জমিতে বোরো ধানের আবাদ ছিল। আবাদ হওয়া বোরো ফসলেই তাদের পরিবারের সারা বছরের জীবিকা নির্বাহ হত। এখন এসব শুধু স্মৃতি কথা। ধানের পর মাছ ও সবজি ক্ষেত হারিয়ে এখন তারা সর্বস্বান্ত। ক্ষতিগ্রস্তরা জানান এবারকার বন্যা অন্যান্য বন্যার চাইতে ভিন্ন। এবছর কয়েক দফা বন্যা হয়েছে। বন্যার শুরুও ছিল চৈত্র মাস। এখন তা স্থায়ী জলাবদ্ধতায় রূপ নিচ্ছে। অন্যান্য বছর বন্যা হলে কিছু হলেও ধান ঘরে তোলা সম্ভব হতো। ধান না হলে মাছ মিলত এ বছর এর কোন কিছুরই মিল নেই। তারা বলেন সরকারের কাছে আমাদের একটাই দাবি মৃত্যুপথযাত্রী হাকালুকি হাওরকে বাঁচানোর। হাকালুকি হাওর বাঁচলে আমরা বাঁচবো। আমরা যৎসামান্য ত্রাণ চাই না। আমরা কাজ করে খেতে চাই। আমরা কারো দয়া ভিক্ষা চাই না। দেশের সবচেয়ে বড় এই হাওরকে বাঁচাতে এখনই উদ্যোগী হন। তা না হলে বারবার এমন দুর্যোগ পোহাতে হবে। কাউয়াদিঘি হাওর পাড়ের ফতেহপুর ও একাটুনা ইউনিয়নের বাসিন্দা সায়েদ আলী, সাজু মিয়া, ফজলু মিয়া, এমরান মিয়া, মনোহর আলীসহ অনেকেই বলেন ৫ মাস থেকে তারা পানিবন্দী। বোরোধানের পর আমন ধানও খেয়েছে বানের পানি। সবজি ক্ষেতের জমিতেও পানি। এখন তাদের সব ধরনের চাষাবাদ বন্ধ। ঘর বাড়িতে দীর্ঘ প্রায় ৬ মাস থেকে পানি উঠে যাওয়ায় তারা চরম অসহায়। তারা সকলেই জানান তাদের এলাকায় বন্যা হলেও এরকম বানের পানি দীর্ঘ হয়ে জলাবদ্ধতায় রূপ নেয়ার কথা ছিল না। কারণ তাদের এমন দুর্দশা লাগবে কৃষকদের কল্যাণে বাস্তবায়ন হয়েছিল ‘মনু প্রকল্প’। নদী শাসনের এ প্রকল্পের আওতায় শত কোটি টাকা ব্যয়ে কাশিমপুর এলাকায় নির্মিত হয়েছিল পাম্প হাউজ। বর্ষা ও শুষ্ক মৌসুমে চাষিদের কল্যাণে যে পাম্প হাউজ সচল থাকার কথা ছিল নানা অজুহাতে ও সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতায় তা রয়েছে বিকল। ৯টি পাম্পের মধ্যে ৫টিই অকেজো। আর যে ৪টি সচল তাও বিদ্যুৎ না থাকাসহ নানা অজুহাতে তা থাকে অচল। তাছাড়া বিল ইজারাদের সঙ্গে পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুর্নীতিপরায়ণ কিছু কর্মকর্তা কর্মচারীর যোগসাজশের কারণে তাদের সুবিধানুযায়ী বর্ষায় সেচ দেয়া বন্ধ থাকে। আর শুষ্ক মৌসুমে তাদের ইশারায় সেচ দেয়। যাতে বিল ইজারাদাররা সহজেই মাছ ধরতে পারে। এ কারণে বর্ষা মৌসুমে বন্যায় দীর্ঘ জলাবদ্ধতা। আর শুষ্ক মৌসুমে পানি না থাকায় চাষাবাদে ব্যাঘাত ঘটে চাষিদের। স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের দাবি- দ্রুত পাম্প হাউজ সচল ও মনু প্রকল্পের খাল ও স্লুইস গেটের সংস্কারের মাধ্যমে এই সমস্যার স্থায়ী সমাধানের।