ঢাকা ০১:১২ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২২ মে ২০২৪, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ধ্বংসস্তূপ মোনতলা ও গাজীরপাড়া চর

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৫:১০:১০ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৩ অগাস্ট ২০১৭
  • ২১০ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ বিবর্ণ মুখ। শুষ্ক ঠোঁট। ক্লান্ত দেহ। নারী-পুরুষ সবাই পরিশ্রান্ত। হালকা-পাতলা শরীর ক্ষুধায় টলছে। চোখে-মুখে একরাশ শূন্যতা। এমন করুণ মুখচ্ছবি নৌকা দেখে ব্রহ্মপুত্রের তীরে ছুটে আসা বানভাসি মানুষের। কথায় কথায় ঝরে পড়ছে কান্না। হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে দীর্ঘশ্বাসগুলো। এমন পরিস্থিতির কারণ কী জানতে চাইতেই  মোনতলা ও গাজীর পাড়ার চরের বাসিন্দারা সমস্বরে বলে ওঠেন, ‘হামরা নিঃস। অনাহারী। খায়, না খাইয়া দিন যাচ্ছে। কোনোমতে বাঁচি আছি।’
কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলাস্থ চিলমারী ইউনিয়নের এ গ্রাম দু’টি একেবারে ব্রহ্মপুত্রের তীর ঘেঁষা। গত ১২ই আগস্ট উত্তরাঞ্চলের বহু জেলার মতো এ গ্রামগুলোর উপর দিয়ে বয়ে গেছে বন্যার উজানের করাল স্রোত। ৫ থেকে ৭ ফুট উচুঁ বন্যার পানির তীব্র স্রোত বহু ঘরবাড়ি নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে গেছে। দুমড়ে-মুচড়ে ফেলেছে বাকিগুলো। গতকাল মঙ্গলবার সকালে নৌকায় মোনতলা ও গাজীর পাড়ার চরে যাওয়ার সময়ও ব্রহ্মপুত্রে বেশ স্রোত ছিল।
খোলামেলা চরের পাশ দিয়ে নৌকায় অচেনা লোক যেতে দেখেই ছুটে আসেন নারী-পুরুষ। শিশু-বৃদ্ধসহ অনেকেই। দু’-একটা ভাঙাচোরা বাড়িঘর চোখে পড়লেও বিরান চরে হঠাৎ এত মানুষের সমাগম কোথা থেকে জিজ্ঞেস করতে জানা গেল, চরে বন্যার পলির নিচে চাপা পড়েছে তাদের ভিটেমাটি। রোদ-বৃষ্টিতে শূন্যভিটা পাহারা দিচ্ছেন তারা। বন্যার স্রোত ঘরবাড়ির সঙ্গে গাছপালাও ভাসিয়ে নেয়ায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে সবকিছু। তাদের প্রায় সবাই এখন সর্বস্বান্ত।
শূন্য ভিটায় আনমনে বসে ছিলেন সাবেদা আক্তার। দেখে বুঝার উপায় নেই যে সেটাই তার বসতভিটা। পাশে ধার করা দু’-একটি হাঁড়িপাতিল। কয়েক টুকরো ইট জোগাড় করে বানিয়েছেন রান্নার চুলা। কী করছেন জানতে চাইতেই আঁচলে মুখ ঢেকে কান্না লুকালেন। ফেললেন দীর্ঘশ্বাস।
বললেন, হামার চোখের সামনেই বাড়িঘর সব ভাসি নিছে। প্রাণ বাঁচপার যাইয়া, কিছুই বাঁচাপার পারি নাই। বন্যার সময় ৫ দিন না খায়া ছিলাম। চোখে ঘুম নাই। এহনও ১ বেলা খাইলেও দু’বেলা না খাইয়া থাকি। হামারা অনাহারী।
তার পাশেই গোলাপীর চাল-ডাল, হাঁড়ি-পাতিলসহ ঘরের বেড়া ভেসে গেছে। তবে খুঁটির উপর ঘরের চালা রক্ষা পেয়েছে। তারও দিন যাচ্ছে খেয়ে না খেয়ে। একইভাবে ঘরের চালা রক্ষা হলেও চারপাশের বেড়াসহ সবকিছু গেছে আজেনারও। তবে তিনি ত্রাণ হিসেবে ১০ সের চাল পেয়েছেন। কয়েকদিন উপস থাকার পর এখন সে চালে দিন যাচ্ছে তার। কিন্তু কোনো ত্রাণ জুটেনি হাবেজার ভাগ্যে। স্বামী বখতেয়ার, দু’ছেলে হাবিজুল ও আসাদ এবং দু’মেয়ে নূরজাহান ও নুরেত্তাসহ ৬ জনের সংসার বন্যার পর থেকে খেয়ে না খেয়ে দিন পার করছে।
হাবেজা বলেন, গত সোমবার সারাদিন কিছু খাইনি। রাতে অল্প চাল জোগাড় করে ভাত খাই। মঙ্গলবার সকালে আধপেটা পান্তাভাত খাইছি। সারাদিন কিছু খামু না। বাচ্চারা অভাব বুঝে না। খাওয়ার জন্য কান্দে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো রিলিফ পাই নাই।
ভিক্ষায় দিন চলে বৃদ্ধা জুলেখার। তার স্বামী সংসারে এখন ভাগ বসাচ্ছে মেয়ে মরিয়ম ও তার দু’সন্তান মমিন ও মুক্তা। তারাও কোনো ত্রাণ পাননি। তাদের অনেকেই বলেন, বহু পরিবারে ত্রাণ বিতরণ হলেও পায়নি এমন পরিবারের সংখ্যাও কম নয়।
শুধু চিলমারীর মনতোলা বা গাজীর পাড়ার চর নয়, আরও বহু গ্রামে মানবেতর জীবন কাটছে বন্যাদুর্গতদের। উপজেলার বাকি পাঁচ ইউনিয়ন অষ্টমীরচর, নয়ারহাট, রমনা, রানীগঞ্জ ও থানাহাট ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে। চিলমারী উপজেলা প্রশাসনের হিসাবে সেখানে লোকসংখ্যা ১ লাখ ২২ হাজার ৮৪১ জন (২০১১ সালের আদম শুমারি অনুযায়ী)। এর মধ্যে এবার ১ লাখ ৮ হাজার ৩৬৪ জন মানুষ বন্যাদুর্গত। উপজেলার ৪০ হাজার পরিবারের মধ্যে ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে ২৭ হাজার ৯১ টি পরিবার। একই পরিস্থিতি কুড়িগ্রামের সদর, উলিপুর, ফুলবাড়ী, রাজারহাট, নাগেশ্বরী, ভূরুঙ্গামারী, রৌমারী এবং রাজীবপুর উপজেলায়। একইভাবে এবার গত ১২ ও ১৩ই আগস্ট উজানের পানিতে বন্যা কবলিত হয়েছে দেশের অন্তত ৩০ জেলা। এসব এলাকায় এখন ত্রাণ বিতরণ করা হলেও তা যথেষ্ট নয়। বহু দুর্গত মানুষ ত্রাণ পাচ্ছে না।
চিলমারী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গওছুল হক মণ্ডল হাওর বার্তাকে বলেন, আসলে প্রায় মানুষ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে। তাদেরকে ত্রাণ দেয়া হয়েছে। মনতোলা ও গাজীর পাড়ার চরের সবাই ত্রাণ পাওয়ার কথা। কেউ না পেয়ে থাকলে তা আমার জানা নেই।
মোরও নামটা নেকো বাহে (আমার নামটাও লেখ ভাই): চরে উঠে কয়েকটা বসতভিটেয় ঘুরতেই বেরিয়ে আসেন বহু নারী। তরুণী, যুবতী, মধ্যবয়সী ও বৃদ্ধা। সবার চোখে-মুখে ক্লান্তির ছাপ। দু’-একজনের সঙ্গে কথা-বলে নাম লিখতেই অন্যরা বলে উঠেন, মোরও নামটা নেকো বাহে। হামরা খুব কষ্টত আছি।’ অগত্যা তাদের সবার নাম লিখতে হলো। তারা হলেন, কাকলী, হালিমা, রুবিনা, আম্বিয়া, চায়না, মতিজান, সুফিয়া, আয়েশা, কোহিনূর, এজিয়া, শিরিনা, আদুরী, রোকসানা, কাইছলেনি, মনোয়ারা, রাশেদা, নজপান, জোলেখা, মরিয়ম, দিপালী, নূরীমে, শহরবানু, লাইলী, হাজেরা, আসমা, মোর্শেদা, রুসনা, আসমা, বাতাসি, নূরীমে (২), আমেনা, ওসনা, কলিমন, বিলকিস, আজিরা, পরিনা, বিলকিস (২), আকলিমা, খৈমন, বিউটি, মজিতে, ইসমত আরা, হালিমা, আবেদা, অলদা, শিল্পী, অসুনারা, সকিনা ও আনোয়ারা।
ধ্বংসস্তূপে পরিণত মনতোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়: মনতোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভেঙেচুরে গেছে। পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে। বহু আসবাবপত্র ভাসিয়ে নিয়েছে স্রোত। চরের বিভিন্ন জায়গায় পলির নিচে স্কুলের চেয়ার, টুল, টেবিল, লোহারপাত ইত্যাদি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে দেখা গেছে।
নলকূপ মাটি চাপা পড়ায় দেখা দিয়েছে পানি সংকট: বন্যার প্রবল স্রোতে মনতোলা ও গাজীর পাড়ার চরের অধিকাংশ নলকূপ মাটি চাপা পড়তে দেখা গেছে। স্রোতের তোড়ে হারিয়ে গেছে কয়েকটি। রাজ্জাক ও সাবেদা আক্তারের বাড়ির দু’টি নলকূপ পলি মাটির নিচে চাপা পড়েছে। এতে পানি সংকটে রয়েছেন তারা। বন্যার পর মাটি খুঁড়ে চাপা পড়া আমিছার বাড়ির নলকূপটি উদ্ধার করা হয়েছে। সেটির পানিতে এখন দিন কাটছে রাজ্জাক, সাবেদাসহ আশপাশের পরিবারগুলোর।
সিএলপি’র উঁচু ভিটা প্রাণ বাঁচালো ১২ পরিবারের: প্রতি বর্ষায় বন্যার কবলে পড়তে হয় মোনতলাবাসীদের। এই দুর্যোগে কিছুটা আশ্রয় দেয়ার জন্য সুবিধাভোগী সদস্য পরিবারগুলোর কিছু ভিটা উঁচু করে দিয়েছিল সিএলপি নামে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা। তখন ফাতেমা, সেলিনা, মেহের আলী ও রাশিদুলের বসতভিটাও উঁচু করে দেয়া হয়। বন্যা অন্য ঘরগুলো ভাসিয়ে নিলেও ওই ভিটার বসতঘরগুলো ভাসিয়ে নিয়ে যায়নি। সেখানে পানিও উঠেনি। বন্যায় যখন সব ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল তখন সেই ভিটায় আশ্রয় নিয়ে প্রাণ বাঁচায় ফারুক, মিনারা, রাজ্জাক আলী, রউফ, খয়বার, জাবের, কাশিম আলী, কাজীম উদ্দিন, আজেনা, সানোয়ারা ও জিয়ারুলের পরিবার।
অন্যের ঘর বাঁচাতে গিয়ে নিজেরটা হারালো ফারুক: মনতোলার চরের ফারুকের ছোট্ট একটি নৌকা আছে। বন্যার শুরুর দিকে সেই নৌকায় চড়ে অন্য প্রতিবেশীর ঘর বাঁচাতে ছুটেন এই যুবক। কয়েকটা ভেসে যাওয়া ঘর রক্ষাও করেন। কিন্তু ততক্ষণে ওইদিকে তার নিজের ঘরই ভাসিয়ে নিয়েছে বন্যার পানি।
তিনি বলেন, গ্রামের মাত্র কয়েকটি নৌকা আছে। আমারও একটা আছে। তা দিয়ে অন্যের ভাসিয়ে নেয়া ঘর ধরতে গিয়েছিলাম। আর ওদিকে আমার ঘরই ভাসাই নিল।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

ধ্বংসস্তূপ মোনতলা ও গাজীরপাড়া চর

আপডেট টাইম : ০৫:১০:১০ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৩ অগাস্ট ২০১৭

হাওর বার্তা ডেস্কঃ বিবর্ণ মুখ। শুষ্ক ঠোঁট। ক্লান্ত দেহ। নারী-পুরুষ সবাই পরিশ্রান্ত। হালকা-পাতলা শরীর ক্ষুধায় টলছে। চোখে-মুখে একরাশ শূন্যতা। এমন করুণ মুখচ্ছবি নৌকা দেখে ব্রহ্মপুত্রের তীরে ছুটে আসা বানভাসি মানুষের। কথায় কথায় ঝরে পড়ছে কান্না। হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে দীর্ঘশ্বাসগুলো। এমন পরিস্থিতির কারণ কী জানতে চাইতেই  মোনতলা ও গাজীর পাড়ার চরের বাসিন্দারা সমস্বরে বলে ওঠেন, ‘হামরা নিঃস। অনাহারী। খায়, না খাইয়া দিন যাচ্ছে। কোনোমতে বাঁচি আছি।’
কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলাস্থ চিলমারী ইউনিয়নের এ গ্রাম দু’টি একেবারে ব্রহ্মপুত্রের তীর ঘেঁষা। গত ১২ই আগস্ট উত্তরাঞ্চলের বহু জেলার মতো এ গ্রামগুলোর উপর দিয়ে বয়ে গেছে বন্যার উজানের করাল স্রোত। ৫ থেকে ৭ ফুট উচুঁ বন্যার পানির তীব্র স্রোত বহু ঘরবাড়ি নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে গেছে। দুমড়ে-মুচড়ে ফেলেছে বাকিগুলো। গতকাল মঙ্গলবার সকালে নৌকায় মোনতলা ও গাজীর পাড়ার চরে যাওয়ার সময়ও ব্রহ্মপুত্রে বেশ স্রোত ছিল।
খোলামেলা চরের পাশ দিয়ে নৌকায় অচেনা লোক যেতে দেখেই ছুটে আসেন নারী-পুরুষ। শিশু-বৃদ্ধসহ অনেকেই। দু’-একটা ভাঙাচোরা বাড়িঘর চোখে পড়লেও বিরান চরে হঠাৎ এত মানুষের সমাগম কোথা থেকে জিজ্ঞেস করতে জানা গেল, চরে বন্যার পলির নিচে চাপা পড়েছে তাদের ভিটেমাটি। রোদ-বৃষ্টিতে শূন্যভিটা পাহারা দিচ্ছেন তারা। বন্যার স্রোত ঘরবাড়ির সঙ্গে গাছপালাও ভাসিয়ে নেয়ায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে সবকিছু। তাদের প্রায় সবাই এখন সর্বস্বান্ত।
শূন্য ভিটায় আনমনে বসে ছিলেন সাবেদা আক্তার। দেখে বুঝার উপায় নেই যে সেটাই তার বসতভিটা। পাশে ধার করা দু’-একটি হাঁড়িপাতিল। কয়েক টুকরো ইট জোগাড় করে বানিয়েছেন রান্নার চুলা। কী করছেন জানতে চাইতেই আঁচলে মুখ ঢেকে কান্না লুকালেন। ফেললেন দীর্ঘশ্বাস।
বললেন, হামার চোখের সামনেই বাড়িঘর সব ভাসি নিছে। প্রাণ বাঁচপার যাইয়া, কিছুই বাঁচাপার পারি নাই। বন্যার সময় ৫ দিন না খায়া ছিলাম। চোখে ঘুম নাই। এহনও ১ বেলা খাইলেও দু’বেলা না খাইয়া থাকি। হামারা অনাহারী।
তার পাশেই গোলাপীর চাল-ডাল, হাঁড়ি-পাতিলসহ ঘরের বেড়া ভেসে গেছে। তবে খুঁটির উপর ঘরের চালা রক্ষা পেয়েছে। তারও দিন যাচ্ছে খেয়ে না খেয়ে। একইভাবে ঘরের চালা রক্ষা হলেও চারপাশের বেড়াসহ সবকিছু গেছে আজেনারও। তবে তিনি ত্রাণ হিসেবে ১০ সের চাল পেয়েছেন। কয়েকদিন উপস থাকার পর এখন সে চালে দিন যাচ্ছে তার। কিন্তু কোনো ত্রাণ জুটেনি হাবেজার ভাগ্যে। স্বামী বখতেয়ার, দু’ছেলে হাবিজুল ও আসাদ এবং দু’মেয়ে নূরজাহান ও নুরেত্তাসহ ৬ জনের সংসার বন্যার পর থেকে খেয়ে না খেয়ে দিন পার করছে।
হাবেজা বলেন, গত সোমবার সারাদিন কিছু খাইনি। রাতে অল্প চাল জোগাড় করে ভাত খাই। মঙ্গলবার সকালে আধপেটা পান্তাভাত খাইছি। সারাদিন কিছু খামু না। বাচ্চারা অভাব বুঝে না। খাওয়ার জন্য কান্দে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো রিলিফ পাই নাই।
ভিক্ষায় দিন চলে বৃদ্ধা জুলেখার। তার স্বামী সংসারে এখন ভাগ বসাচ্ছে মেয়ে মরিয়ম ও তার দু’সন্তান মমিন ও মুক্তা। তারাও কোনো ত্রাণ পাননি। তাদের অনেকেই বলেন, বহু পরিবারে ত্রাণ বিতরণ হলেও পায়নি এমন পরিবারের সংখ্যাও কম নয়।
শুধু চিলমারীর মনতোলা বা গাজীর পাড়ার চর নয়, আরও বহু গ্রামে মানবেতর জীবন কাটছে বন্যাদুর্গতদের। উপজেলার বাকি পাঁচ ইউনিয়ন অষ্টমীরচর, নয়ারহাট, রমনা, রানীগঞ্জ ও থানাহাট ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে। চিলমারী উপজেলা প্রশাসনের হিসাবে সেখানে লোকসংখ্যা ১ লাখ ২২ হাজার ৮৪১ জন (২০১১ সালের আদম শুমারি অনুযায়ী)। এর মধ্যে এবার ১ লাখ ৮ হাজার ৩৬৪ জন মানুষ বন্যাদুর্গত। উপজেলার ৪০ হাজার পরিবারের মধ্যে ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে ২৭ হাজার ৯১ টি পরিবার। একই পরিস্থিতি কুড়িগ্রামের সদর, উলিপুর, ফুলবাড়ী, রাজারহাট, নাগেশ্বরী, ভূরুঙ্গামারী, রৌমারী এবং রাজীবপুর উপজেলায়। একইভাবে এবার গত ১২ ও ১৩ই আগস্ট উজানের পানিতে বন্যা কবলিত হয়েছে দেশের অন্তত ৩০ জেলা। এসব এলাকায় এখন ত্রাণ বিতরণ করা হলেও তা যথেষ্ট নয়। বহু দুর্গত মানুষ ত্রাণ পাচ্ছে না।
চিলমারী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গওছুল হক মণ্ডল হাওর বার্তাকে বলেন, আসলে প্রায় মানুষ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে। তাদেরকে ত্রাণ দেয়া হয়েছে। মনতোলা ও গাজীর পাড়ার চরের সবাই ত্রাণ পাওয়ার কথা। কেউ না পেয়ে থাকলে তা আমার জানা নেই।
মোরও নামটা নেকো বাহে (আমার নামটাও লেখ ভাই): চরে উঠে কয়েকটা বসতভিটেয় ঘুরতেই বেরিয়ে আসেন বহু নারী। তরুণী, যুবতী, মধ্যবয়সী ও বৃদ্ধা। সবার চোখে-মুখে ক্লান্তির ছাপ। দু’-একজনের সঙ্গে কথা-বলে নাম লিখতেই অন্যরা বলে উঠেন, মোরও নামটা নেকো বাহে। হামরা খুব কষ্টত আছি।’ অগত্যা তাদের সবার নাম লিখতে হলো। তারা হলেন, কাকলী, হালিমা, রুবিনা, আম্বিয়া, চায়না, মতিজান, সুফিয়া, আয়েশা, কোহিনূর, এজিয়া, শিরিনা, আদুরী, রোকসানা, কাইছলেনি, মনোয়ারা, রাশেদা, নজপান, জোলেখা, মরিয়ম, দিপালী, নূরীমে, শহরবানু, লাইলী, হাজেরা, আসমা, মোর্শেদা, রুসনা, আসমা, বাতাসি, নূরীমে (২), আমেনা, ওসনা, কলিমন, বিলকিস, আজিরা, পরিনা, বিলকিস (২), আকলিমা, খৈমন, বিউটি, মজিতে, ইসমত আরা, হালিমা, আবেদা, অলদা, শিল্পী, অসুনারা, সকিনা ও আনোয়ারা।
ধ্বংসস্তূপে পরিণত মনতোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়: মনতোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভেঙেচুরে গেছে। পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে। বহু আসবাবপত্র ভাসিয়ে নিয়েছে স্রোত। চরের বিভিন্ন জায়গায় পলির নিচে স্কুলের চেয়ার, টুল, টেবিল, লোহারপাত ইত্যাদি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে দেখা গেছে।
নলকূপ মাটি চাপা পড়ায় দেখা দিয়েছে পানি সংকট: বন্যার প্রবল স্রোতে মনতোলা ও গাজীর পাড়ার চরের অধিকাংশ নলকূপ মাটি চাপা পড়তে দেখা গেছে। স্রোতের তোড়ে হারিয়ে গেছে কয়েকটি। রাজ্জাক ও সাবেদা আক্তারের বাড়ির দু’টি নলকূপ পলি মাটির নিচে চাপা পড়েছে। এতে পানি সংকটে রয়েছেন তারা। বন্যার পর মাটি খুঁড়ে চাপা পড়া আমিছার বাড়ির নলকূপটি উদ্ধার করা হয়েছে। সেটির পানিতে এখন দিন কাটছে রাজ্জাক, সাবেদাসহ আশপাশের পরিবারগুলোর।
সিএলপি’র উঁচু ভিটা প্রাণ বাঁচালো ১২ পরিবারের: প্রতি বর্ষায় বন্যার কবলে পড়তে হয় মোনতলাবাসীদের। এই দুর্যোগে কিছুটা আশ্রয় দেয়ার জন্য সুবিধাভোগী সদস্য পরিবারগুলোর কিছু ভিটা উঁচু করে দিয়েছিল সিএলপি নামে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা। তখন ফাতেমা, সেলিনা, মেহের আলী ও রাশিদুলের বসতভিটাও উঁচু করে দেয়া হয়। বন্যা অন্য ঘরগুলো ভাসিয়ে নিলেও ওই ভিটার বসতঘরগুলো ভাসিয়ে নিয়ে যায়নি। সেখানে পানিও উঠেনি। বন্যায় যখন সব ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল তখন সেই ভিটায় আশ্রয় নিয়ে প্রাণ বাঁচায় ফারুক, মিনারা, রাজ্জাক আলী, রউফ, খয়বার, জাবের, কাশিম আলী, কাজীম উদ্দিন, আজেনা, সানোয়ারা ও জিয়ারুলের পরিবার।
অন্যের ঘর বাঁচাতে গিয়ে নিজেরটা হারালো ফারুক: মনতোলার চরের ফারুকের ছোট্ট একটি নৌকা আছে। বন্যার শুরুর দিকে সেই নৌকায় চড়ে অন্য প্রতিবেশীর ঘর বাঁচাতে ছুটেন এই যুবক। কয়েকটা ভেসে যাওয়া ঘর রক্ষাও করেন। কিন্তু ততক্ষণে ওইদিকে তার নিজের ঘরই ভাসিয়ে নিয়েছে বন্যার পানি।
তিনি বলেন, গ্রামের মাত্র কয়েকটি নৌকা আছে। আমারও একটা আছে। তা দিয়ে অন্যের ভাসিয়ে নেয়া ঘর ধরতে গিয়েছিলাম। আর ওদিকে আমার ঘরই ভাসাই নিল।