হাওর বার্তা ডেস্কঃ ইঞ্জিনচালিত নৌকা সামনের দিকে ছুটছে। চারদিকে থইথই পানি। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে, দুই পাশের বাড়িঘর মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। কিছুদূর যেতেই চোখ আটকে গেল একটি মাচার দিকে। নৌকা ভেড়াতেই দেখা গেল, পানির ওপর মাচা করে একটি পরিবারের কয়েকজন সদস্য বসে আছেন। সেখানে বিছানাপত্র রাখা ও সামনে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। এক গৃহবধূর কোলে ছোট্ট শিশু। আট দিন ধরে তাঁরা এভাবে বসবাস করছেন।
মাচায় থাকা বৃদ্ধা ঝাড়মুন বিবি (৬৫) কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘বাবারে, চার দিন থ্যাইকা বাড়িত ভাত রানবের পারিনি। পাড়ার মানসেরা এক বেলা খাবার দিইয়্যা যাত্তে, সেগলা খাইয়্যা বাঁইচ্যা আছি।’ তাঁর সঙ্গে সুর মেলালেন পাশে বসা ছেলের বউ (২৯)। তিনি বলেন, দেড় মাস হলো তাঁর এই কন্যাশিশু হয়েছে। বাড়িঘর বন্যার পানিতে ডুবে যাওয়ায় সড়কের ওপর আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেটাও ডুবে যাওয়ায় এভাবে মাচা করে বাড়ির সবাই মিলে একসঙ্গে থাকছেন।
এই চিত্র রাজশাহীর বাগমারার নরদাশ ইউনিয়নের গোড়সার গ্রামের। তবে গত রোববার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত সরেজমিনে একই চিত্র দেখা গেল উপজেলার প্রায় সব ইউনিয়নে।
গোড়সার গ্রামেরবাসিন্দা ইব্রাহিম হোসেন (৪৬) বলেন, বাড়ির পাশে খামারে দেড় হাজার মুরগি ছিল। এক রাতের বন্যায় খামারের সব মুরগি ভেসে গেছে। তিনি ডুবে থাকা খামার দেখিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। ইসাহাক আলী বলেন, এই গ্রামের দেড় শ পরিবার গবাদিপশু আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে পাঠিয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে।
পাশের গ্রাম পূর্ব দৌলতপুরে ছয়-সাতটি উঁচু বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে ২০টি পরিবার। ওই গ্রামের মতি বেগম (৫৩) বলেন, এক রাতের বানে ঘরের সব ভেসে গেছে। কিছু কাপড় নিয়ে আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁরাই খাবারের ব্যবস্থা করছেন। তিনি সরকারিভাবে কিছু পাননি।
একই পথ ধরে সোনাডাঙ্গা ইউনিয়নের শেরকোল গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, লোকজন সড়কে ও উঁচু বাগানে গরু বেঁধে রেখেছেন। পাশের নাসিরগঞ্জ ডিগ্রি কলেজের আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে ১২টি পরিবার। তবে কলেজটিতেও গত শনিবার পানি উঠেছে। সেখানে থাকা নাসিম আহম্মেদ, রেনুকা বেওয়া, শমসের আলী বলেন, তাঁদের ঘরবাড়ি ডুবে গেছে। বেসরকারিভাবে কিছু ত্রাণ দেওয়া হয়েছে, সেগুলো দিয়ে কোনো রকম দিনাতিপাত করছেন।
রোববার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত নরদাশ, সোনাডাঙ্গা, গোবিন্দপাড়া ও দ্বীপপুর ইউনিয়নের ৩০টি গ্রাম ঘুরে সব জায়গায় একই ধরনের দুর্দশার চিত্র চোখে পড়ে।
এদিকে গতকাল সোমবার পর্যন্ত উপজেলার বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। নতুন করে উপজেলার যোগিপাড়া ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়া বাসুপাড়া, নরদাশ, শুভডাঙ্গা ও সোনাডাঙ্গা ইউনিয়নের কয়েকটি অভ্যন্তরীণ বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় ওই সব এলাকার ২২টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বন্যার কারণে সোনাডাঙ্গা, নরদাশ ও গোবিন্দপাড়া ইউনিয়নের সঙ্গে উপজেলা ও জেলা সদরের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
গোবিন্দপাড়ার ইউপি চেয়ারম্যান বিজন কুমার সরকার বলেন, তাঁর ইউনিয়ন শতভাগ বন্যাকবলিত। তাঁরা সরকারি অনুদান খুবই কম পাচ্ছেন। নরদাশ ইউপির চেয়ারম্যান মতিউর রহমান বলেন, ফসল, বাড়িঘর, মাছ—সবই চলে গেছে। স্থানীয় সাংসদ এনামুল হক বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুসারে যেসব বাড়িঘর ভেঙে বা ধসে গেছে, সেগুলো নির্মাণের ব্যবস্থা ও কৃষকদের বিনা মূল্যে কৃষি প্রণোদনা দেওয়া হবে।’
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মাসুদুর রহমান বলেন, সরকারিভাবে এ পর্যন্ত ২৯ মেট্রিক টন চাল পাওয়া গেছে।