পাত্রাধার, না পাত্র? একদল পণ্ডিত নাকি তর্কটা তুলেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় এদের পরিচয় পণ্ডিতমূর্খ! বাংলাদেশেও দেখা যাচ্ছে এ ধরনের কিছু পণ্ডিতমূর্খের আবির্ভাব ঘটেছে। এরা আবার রাজনীতি করেন। রাজনীতিতেও নানা কুতর্ক তুলে থাকেন। পাত্রাধার, না পাত্রের বিতর্কে নির্ধারিত হয়েছিল দুটিই অভিন্ন বস্তু। তা নিয়ে পাণ্ডিত্য ফলানোই আসলে মূর্খতা। বর্তমানে তর্ক তোলা হয়েছে তিনি পিতা, না স্থপতি? ফাদার, না আর্কিটেক্ট? এক পণ্ডিতমূর্খ যুক্তি দেখিয়েছেন তিনি স্বাধীনতার স্থপতি। পিতা নন। কেন নন? আমরা যদি আধুনিক নেশন স্টেটের সংজ্ঞা মেনে নিই, তাহলে এই নেশন স্টেটের কারিগর বা আর্কিটেক্টকে পিতা বলতে আপত্তি কি?
বিতর্ক ও বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা চলছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে। এতকাল তাকে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি হিসেবেও স্বীকার করা হয়নি। ৪০ বছর ধরে চলেছে ইতিহাস থেকে তার নাম মুছে ফেলার চেষ্টা। চেষ্টা চলেছে পিতৃচরিত্র হননের এবং মিথ্যার কুয়াশায় ঢেকে দিতে একটি গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। সেই চেষ্টা সফল হয়নি। খান্নাছের সকল ওয়াছওয়াছা ভেদ করে জাতির মনে সত্যের সূর্য জ্বলে উঠেছে। মুক্তিদাতা, জাতির জনক ও রাষ্ট্রের স্থপতিকে চিনে নিতে দেশের সর্বস্তরের মানুষের কিছুমাত্র ভুল হয়নি। তাদের কাছে পিতা ও স্থপতির কথা দুটোর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। যিনি নির্মাণ করেন তিনিই নির্মাতা বা পিতা। যিনি জন্ম দেন তিনিই জনক। এই সত্য মেনে নিতে ধর্মের কোনো নিষেধ নেই। বরং সমর্থন আছে।
বঙ্গবন্ধু নব্য বাঙালি জাতির জনক, বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্রের স্থপতি। আবার শৃঙ্খলিত জাতির শিকল ভাঙার যুদ্ধের তিনি সেনাপতি। তিনি মুক্তিদাতা। তাই দেশের মানুষ সশ্রদ্ধভাবে তার জন্মোৎসবে, শোকার্ত মৃত্যুদিবসেও অবনত মস্তকে জনক, স্থপতি ও মুক্তিদাতার উদ্দেশে শ্রদ্ধা নিবেদন করে বলে- ‘মুক্তিদাতা, তোমারও ক্ষমা, তোমারও দয়া রবে চির পাথেয় চিরযাত্রায়।’ কুতার্কিকরা কেউ কেউ বলেন, আরে বাঙালি জাতির ইতিহাস তো হাজার বছরের। আর মুজিব জন্মালেন এই সেদিন। আর আগেই বাঙালি জাতির জন্ম হয়েছিল। তিনি কী করে জাতির জনক হন? এদের কুতর্কের জবাবে বলতে হয়, তুর্কিরা তো আরও প্রাচীন জাতি। তাদের বিশাল সাম্রাজ্য ছিল। তাহলে এই সেদিন যে তুরস্ক নামক রাষ্ট্রের জন্ম তার জনক ও স্থপতি কী করে কামাল পাশা হন? তাকে কেন বলা হয় আতাতুর্ক বা তুর্কিদের পিতা? এ প্রশ্নের জবাব, তুরস্ক এককালে যত বড় সাম্রাজ্যই থাকুক, তা কালচক্রে বহুধাবিভক্ত হয়ে হারিয়ে গিয়েছিল। মোস্তফা কামাল পাশা একটি সশস্ত্র যুদ্ধের দ্বারা আধুনিক নেশন স্টেট হিসেবে তুরস্কের জন্ম দিয়েছিলেন, তুর্কি জাতির পরিচয় আবার প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাই তিনি নব্য তুর্কির জনক আতাতুর্ক। শেখ মুজিবুর রহমানও আতাতুর্কের মতো নব্য বাংলার জনক। বাংলাদেশকেও বহুধাবিভক্ত করে বাংলাদেশ ও বাঙালি নামের পরিচয় মুছে ফেলা হয়েছিল। পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশ ছিল পূর্ব পাকিস্তান। আমাদের একমাত্র পরিচয় ছিল পাকিস্তানি। আমাদের হাজার বছরের জাতিসত্তার নাম ও পরিচয় মুছে ফেলা হয়েছিল। টুঙ্গিপাড়ার শেখ মুজিব সেই নাম ও পরিচয় উদ্ধারের জন্য আবার যুদ্ধে নামেন। তিনিই ঢাকার পল্টন ময়দানের সভায় দাঁড়িয়ে ঘোষণা দেন- ‘আজ থেকে এই ভূখণ্ডের নাম আবার বাংলাদেশ। আমাদের বড় পরিচয় আমরা বাঙালি।’ সেদিনের সাড়ে সাত কোটি মানুষের মনে এই ঘোষণা আবার আত্মপরিচয় ফিরিয়ে এনেছিল। বাঙালির স্বাধীন নেশন স্টেট প্রতিষ্ঠার যুদ্ধের সূচনা সেদিন ওই একটি ঘোষণাতেই- ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।’
৪০ বছর হয়ে গেছে বাঙালি তার জনককে হারিয়েছে। কিন্তু রয়ে গেছে তার নির্মাণ-ভাস্কর্য স্বাধীন বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশের রক্তসূর্যখচিত পতাকা জনকের রক্তে রঞ্জিত। এই রক্তসূর্যের আলোকেই কুতর্ক ও বিভ্রান্তির সব কুয়াশা কেটে যাবে। যেমন কাটতে শুরু করেছে এখন। প্রতি বছর পনের আগস্ট তারিখে শোক থেকে যে শক্তি জেগে ওঠে বাঙালির মনে, তাই তার অস্তিত্ব ও স্বাধীনতার সবচেয়ে বড় রক্ষাকবচ। প্রতি বছর পনের আগস্টের তারিখে মনে হয়- বঙ্গবন্ধু তুমি নেই, কিন্তু ছড়িয়ে আছ সারা বাংলাদেশজুড়ে। তুমি অমিতায়, তোমার মৃত্যু নেই।