বালুকা বেলায় ও হারিয়ে গেছে
এক আশ্চর্য বালক-
ফিরে তাকালো না পেছনে পড়ে থাকা
সায়ন্ত—নী ঝিনকের দিকে-
ভেজা ভেজা মনোরম তরঙ্গের মতো স্রোতধারার মতো জগৎপাবিনী মহাসমুদ্র, মহাকাল ভাসিয়ে নিয়েছে তাকে। ভাবিনি কখনও এমনি করে অকাল প্রয়াত হবে শক্তিমান পাখিটি-আমাদের পরিবারের বড় সন্তান এ কে এম লিয়াকত হোসাইন মানিক।
১৯ আগষ্ট ২০০৯। আমাদের জন্য হারাবার দিন, শোকার্ত বিষণ্য দিবস। দেখতে দেখতে বছর হয়ে গেল কিন্তু তরতজা শোকের আচ্ছন্নতা আজও কাটেনি। ঘন পাতার আচ্ছাদনে ফুলগুলো এখনও আধ ভেজা, দুর্বাদলে বৃষ্টিজলের ঢেউ কাঁপানো সেই মূর্ছিত সংগীত, ঈশান কোণে বেদনার ঝড়-সবাই যেন প্রতীকী প্রতিচ্ছবি- তার পেছনে রেখ যাওয়া মানুষগুলোর কালো মেঘে আচ্ছন্ন হৃদয়ের প্রতিভাস।
আমার ননদের ছেলে লিয়াকত বাবাকে হারায়-খুবই অল্প বয়সে। বাবা জনাব রহিম উদ্দিন মাস্টার এর নয়নমনি তখন পথহারা। সঙ্গে তার একটি ছোট বোন আনোয়ারা। আমি আমার ¯স্বামী আলহাজ্ব মোহাম্মদ হোসাইন আলীকে বলে গ্রাম থেকে তাদের আমার কাছে কিশোরগঞ্জ শহরে নিয়ে আসি। আমার তখনও কোনো সন্তান কোলে না আসায় লিয়াকতই সে প্রথম স্থানটি অবলীলায় দখল করে নিয়েছিল। আনন্দ বেদনা সুখ-দুঃখ, মিছিল মিটিং সমাজকল্যাণমূলক কাজ, সংগ্রাম ও আন্দোলন এবং চলমান জীবনের সবকিছুতে আমার সঙ্গে তার সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং সেই সাথে তার একটি পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে বেড়ে ওঠা। বিজ্ঞান বিভাগে গ্রাজুয়েশন করে তার এলএলবি পাশ। পেশায় এডভোকেট এবং প্রেসক্লাব, বার এসোসিয়েশন সহ বিভিন্ন সংগঠনে তার নেতৃত্ব। মৃত্যুর পূর্ব সময়টাতেও কিশোরগঞ্জে পাবলিক প্রসিকিউটর ছিল। শিশু-সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তার দৃপ্ত পদচারণা। বলতে গেলে সে জেলা শহরটির বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব এবং স্বনামধন্য মানুষ হিসেবে পরিণত হয়। মনে পড়ে একাত্তরের মুক্তি সংগ্রামে আমাদের যৌথ প্রয়াস পরিবারের সবার চোখের পানি আর দৃপ্ত সাহসের ডিঙায় ভেসে পাড়ি দিল স্বাধীনতার রক্তভেজা বাংলার বিশাল প্রাপ্ত। মেঘালয় সেক্টরের অনন্য বীর মুক্তিযোদ্ধা এ কে এম লিয়াকত হোসাইন মানিক গর্বিত হই তবু স্বকেন বুকের ভিতর পাখিটি কেঁদে অশনি সংকেতে। ভাবি ধীনতা নিয়ে আসবে আমার ছেলে আবার ভাবি সে ফিরে আসবে তো!
দার“ন সাহসে সময়ের স্রোতে ভেসে চলি
কখনও অদূরে মোহনাতে যাই
যেখানে সূর্যের শেষ আলো ছড়িয়েছে
স্বাধীনতার অরুণ বিহ্ন
ক্ষয়িষ্ণু হৃদয়ের অলিগলিতে কষ্টের নদী বয়ে যায়। জীবনের পরতে পরতে আছড়ে পড়া মানুষের কর“ণ আর্তি। স্বপ্নের জালবোনা চোখে কুয়াশার হিমেল প্রপাত। জোৎস্নার পালঙ্কে সাজানো হিরন্ময় স্মৃতিগুলো পুড়ছে-
এতটুকু বালক। কত বিশাল হল। সংগ্রাম ও আন্দোলনে নেতা হল। আমার অবুঝ ছেলেমেয়েদের ‘বড়ভাই’ হল। আমার সুখ দুঃখের সাথী হল, সংগ্রাম ও আন্দোলনে সঙ্গী হল-চারদিকে পুষ্পিত উদ্যান সুরভিত হল। আমার ব্যক্তিগত জীবনেও পূর্ণতা এলো স্ত্রী-পুত্র-কন্যার শুভ সান্নিধ্যে। এই প্রাপ্তি ঈর্ষিত লগ্নটিতে মেনে এলো কেমন কালোছায়া-উদ্যত মৃত্যুর করাল গ্রাস। হারিয়ে গেছে ও।
মনে পড়ে তার রাজনৈতিক জীবনের বিভিন্ন কথা। আমাদের আজকের রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এডভোকেট তার সিনিয়র। একসঙ্গে দু’জনের পথচলা। কিশোরগঞ্জের রাজনীতিতে তাদের দৃপ্ত পদচারণা ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে। কিশোরগঞ্জ গুর“দয়াল কলেজে তাদের ছাত্রজীবনের রাজনৈতিক উতথান অনেকটাই আমার গোচরীভূত। আমি তখন স্থানীয় এসভি সরকারি (প্রথমে বেসরকারি) বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা। ভিতরেই বাসা। এই বাসায় তাদের ছোটখাট আলোচান সভা অথবা বিরাম বিশ্রামের একটি আশ্রয় ছিল। লিয়াকত পড়াশুনা করার চেয়ে এইসব উদ্দাম উচ্ছ¡ল তার“ন্যের অগ্রসরমান কাজগুলোকে প্রাধান্য দিত। তার মামা মাঝে মাঝে তাগিদ দিলে, কঠোর শাসন করলে তাকে ছায়াবৃত রেখে আমি দু’ধরনের কাজেরই সমন্বয় করতাম। প্রতিভাধর ছাত্র হতে না পারলেও লিয়াকত প্রতিভাময় ভাস্কর দেশপ্রেমিক ও কর্মী হতে পেরেছিলেন। এখানেই তার গৌরব। প্রতিভাময় মাহামান্য রাষ্ট্রপতি জনাব মো. আবদুল হামিদ এডভোকেট সাহেবের গৌরব আরও অনেক অনেক বেশি ছাড়িয়ে গেছে-দুজনেই আমার পুত্রবৎ। তাদের আরও দু’চারজন সহযাত্রীও আমার সঙ্গে বিশেষ পরিচিত ছিল। তাদের তার“ন্য আমাকে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখাতো।
লিয়াকত তখন নিতান্ত— বালক-পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ছে। ওকে আজিমুদ্দিন হাই স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলাম। ও চুল কাটতে চাইতো না, সাবান ঘসে ভাল করে গোসল করতে চাইতো না। আমাদের পুকুর ঘাট থেকে লাফ দিয়ে পানিতে সাঁতার দিয়ে ঘুরে আসতো সারা পুকুর-তারপর ঘাটে ফিরে এসে সামান্য গা ঘসে টুপ করে ডুব দিয়ে উঠে আসা। আমার মা আমার সঙ্গে ছিলেন তিনি ওকে খুব বেশি আদর করতেন। তাঁর জন্যে ওকে বেশি শাসন করা যেত না। বলতেন, এতিম ছেলৈ। ওকে আলাহ সাহায্য করবেন। হ্যাঁ, আলাহ তাকে সাহায্য করেছেন-বড় হয়ে ও পরিচ্ছন্ন ব্যক্তিত্বের মানুষ হয়েছিল।
গ্রাজুয়েশনের পর ও নিজ ইচ্ছায় আমাদের দেশের বাড়িতে গ্রামের একটি স্কুলে প্রধান শি¶ক হিসেবে কাজ করার দায়িত্ব নিয়ে চলে যায়। কিন্তু মাত্র ৫/৬ মাস। কিশোরগঞ্জের মাটি ও মমতার ঢল, রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক অঙ্গন এবং আমার একান্ত— রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক অঙ্গন এবং আমার তাকে ওখান থেকে ফিরিয়ে আনে। আমি বাধ্য করি ল’পড়ার জন্যে এবং পরে তাই হয়েছিল। আমি জানতাম এই পরিবেশ ছেলে ও রাজনীতি সংস্কৃতি কোনটাই করতে পারবে না। তার মামাও এই ব্যাপারে কঠোর ছিলেন-তাকে ল’পাশ করতেই হবে।
নিভৃত পলীর ছায়াঘেরা গৃহখানি তাকে শান্তি—র প্রলেপ নয়-শূন্যতার মর“ময় চরাচর পুড়িয়ে দিচ্ছে তাকে। তিনি ধর্মপ্রাণ-নিবিষ্টতার নিবিড় আচ্ছান্নতায় কোনোমত কাটতে দিন-মেয়েটি আছে তার কাছাকাছি। শোকানল পুড়ছে দুটি হৃদয়কে। এদিকে তার স্ত্রী-পুত্র-কন্যা ওদের কথা বলার অপক্ষো রাখে না- বিষন্ততার ব্যাকুল প্রাণগুলো বজ্রপাতের মতোন গ্রহণ করেছে লিয়াকতের আকস্মিক মৃত্যুকে। কারো যেন সাধ না মিটিল, আশা না পুরিল, সকলি ফুরিয়ে গেল।
ওমর খৈয়ামের ভাষায়-
ক্ষণস্থায়ী মানবজীবন
নহে ইহা চিরশ্যাম তৃণের মতোন
নিষ্পেষিত হয়ে তবু বাঁচবে আবার-
জীবন দলিত হলে জাগে নাকো আর।
যদি এমন না হতো-
একদম শুর“ থেকে নতুন করে
আবার সাজাতাম প্রিয় ছেলেটিকে
যা কিছু বাদ গেছে সব নিয়ে
ঢেলে সাজাতাম অবাক রাজপুত্রের
অবাক কাঁঠাল চাঁপার গন্ধে ভরে উঠতো মন।
আজ মনে পড়ে মাতৃত্বের প্রথম আদর দিয়ে, কঠোর শান ও সোহাগ দিয়ে তাকে ব্যক্তিশীল একজন ভালো মানুষ করে গড়ে তোলার জন্যে, দেশপ্রেমিক ও সমাজসেবী করে তোলার জন্যে কত চেষ্টা করেছি ও আমার ইচ্ছাপূরণ করেছে। আলাহর কাছে হাজার শোকর। তবে পিকাসোর ভাষায় বলতে চাই- ও রং হড়ঃ ঃৎঁব ঃযধঃ ঃযব ড়িৎশ ড়ভ সধহ রং ভরহরংযবফ.
প্রতিটি মানুষ একটি সিঁড়ি তৈরি করে মাত্র-ক্রমান্বয়ে গড়ে ওঠে মাইলস্টোন-উন্নতি ও অগ্রগতির দিকে এগিয়ে যাই আমরা। লিয়াকত সে পথযাত্রায় এগিয়ে গেছে খানিক হলেও সমগ্রের দিকে মানুষের অভিযাত্রা চলছে চলবে অনন্ত—কাল।
কালের সে যাত্রাধ্বনিতে আমরা লিয়াকতের কণ্ঠধ্বনিও শুনবো; ও থাকবে নীরবে আমাদের সবার মাঝে-
তাই বলি মৃত্যু নয়
মুক্তিযোদ্ধা, হে বালক
সৃষ্টিতে তোমার পরিচয়
¯স্বাধীনতার লাল গোলাপ যে
পাপড়ি ছড়িয়েছে
সেখানে তোমার নাম আশায়।
হাওর বার্তা