মনোয়ার হোসাইন রনিঃ কিশোরগঞ্জে জেলা সমবায় অডিটোরিয়ামে রাসেল আহমেদের (তুহিন) উদ্যোগে ১৫ই আগস্টের ভিন্নরকম স্মৃতি চারনা মূলক অনুষ্ঠান ‘১৫ই আগষ্টের শোকগাথা’ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
রাসেল আহমেদ (তুহিন) রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের মেজ ছেলে। তিনি একজন সমাজসেবক ও রাজনীতিবিদ।
অনুষ্ঠানে ১৯৭৫ ও ৭৫ পরবর্তী সময়ের স্মৃতিচারন করেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দাফনের সাথে সংশ্লিষ্ট ও তৎকালীন টুঙ্গীপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুল জলিল শেখ।
১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। পরদিন ১৬ আগস্ট সামরিক হেলিকপ্টারে করে তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়। সেখানে থমথমে অবস্থার মধ্যে দায়সারাভাবে দাফন করা হয় জাতির পিতার মরদেহ।
বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী হেলিকপ্টারটি টুঙ্গিপাড়ার মাটি স্পর্শ করার আগেই হেলিকপ্টার থেকে নেমে পজিশন নেয় সশস্ত্র সেনারা। মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিতে তারা যাচ্ছেতাই আচরণ করে। হত্যার হুমকি দেয়া হয় পুলিশ ও প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের। কয়েকজন শ্রমিকসহ ২৪/২৫ জন বঙ্গবন্ধুর জানাজায় অংশ নেন। তখনও তার গায়ে ছিল রক্তাক্ত পাঞ্জাবি। রেডক্রস অফিস থেকে আনা ত্রাণের সাদা কাপড় এনে তা দিয়ে কাফন দেয়া হয়।
১৫ আগস্ট কিশোরগঞ্জে জাতীয় শোক দিবসে শোকগাথা অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর মৃতদেহের জানাজা, দাফনসহ সেদিনের অজানা অনেক কথা এভাবেই তুলে ধরলেন টঙ্গিপাড়া থানার সেসময়কার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ও বঙ্গবন্ধুর মরদেহ দাফনকারী পুলিশ কর্মকর্তা আবদুল জলিল শেখ। শহরের একটি কমিউনিটি সেন্টারে শোকগাথা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের ছেলে রাসেল আহমেদ তুহিন।
রাসেল আহমেদ তুহিনের পরিচালনায় অনুষ্ঠানে কিশোরগঞ্জ-২ আসনের এমপি অ্যাড. সোহরাব উদ্দিন, সংরক্ষিত আসনের এমপি দিলারা আসমা, জেলা ও দায়রা জজ মাহবুব-উল ইসলাম, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাড. মো. জিল্লর রহমান, পুলিশ সুপার মো. আনোয়ার হোসেন খান, রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. আ ন ম নওশাদ খান, জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক কমান্ডার মো. আসাদ উল্লাহ, মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার কামালসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর মরদেহ দাফনের দায়িত্বে থাকা পুলিশ কর্মকর্তা মো. আবদুল জলিল বলেন, ‘লাশ নিয়ে আসা হবে। এ খবর শুনে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির আশপাশে খোঁজ নিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। বঙ্গবন্ধুর বাড়ির পাশে বঙ্গবন্ধুর দূর সম্পর্কের এক মামাকে পাওয়া গেল। তার নাম ছিল পান্নু শেখ। তিনি জানালেন বঙ্গবন্ধু তাকে বলেছেন, তার মৃত্যু হলে যেনো বাবা-মায়ের কবরের পাশে কবর দেয়া হয়। সে অনুযায়ী চারজন লেবার দিয়ে কবর খোড়ার ব্যবস্থা করলাম। বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দক্ষিণ পাশে খালের পাড়ে একটা হাসপাতাল ছিল। রেডক্রস হাসপাতাল। সেখান থেকে মরদেহ পরিবহন করার জন্য স্ট্রেচারসহ অন্যান্য জিনিস এনে যেখানে হেলিকপ্টার নামবে তার পাশে রাখলাম। টুঙ্গিপাড়া ডাকবাংলোর পাশেই হেলিপ্যাড তৈরি করা হয়েছিল।টুঙ্গিপাড়া থানার পাশে আরেকটা ক্যাম্প ছিল। বারবাড়িয়া পুলিশ ক্যাম্প। সেখান থেকে ফোর্স এনে রাস্তায় ও বাড়িতে মোতায়েন করলাম। বেলা ১১টার দিকে গোপালগঞ্জের ম্যজিস্ট্রেট আবদুল কাদের এবং সিআই আব্দুর রহমান এসডিপিও নূরুল আলম এলেন। তারা জানালেন লাশ আনা হচ্ছে।’
জাতির জনকের মরদেহ টুঙ্গিপাড়ায় নিয়ে যাওয়ার মুহূর্তটি বর্ণনা করতে গিয়ে বার বার চোখ ভিজে যাচ্ছিল আবদুল জলিলের। বলতে থাকেন, ‘সকাল থেকে পুরো এলাকা ছিল থমথমে আর প্রায় জনমানব শূণ্য। দুপুর একটার দিকে হেলিকপ্টারের আওয়াজ শোলা গেল। কিন্তু হেলিকপ্টারটি না নেমে কয়েকটা চক্কর দিতে লাগলো। এ অবস্থা দেখে কয়েকজন লোকজন যারা ছিল, তারাও ভয়ে চলে গেল। এক সময় হেলিকপ্টার ল্যান্ড করল। মাটি স্পর্শ করার আগে দুই পাশের জানলা দিয়ে কয়েকজন ফোর্স নেমে পজিশন নিল। এরপর হেলিকপ্টার ল্যান্ড করার পর আর্মির মেজর তানভীর হায়দার আলী, ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন, একজন হাবিলদার ১০ জন সিপাহী হেলিকপ্টার থেকে নামলো।
ক্যাপ্টেন সাহেব তিনজন সিপাহী নিয়ে অস্ত্র তাক করে আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম সেখানে আসল। তারা আমাদের পরিচয় জানতো চাইলো। পরিচয় দেয়ার পর তারা জানতে চাইল এখানে লাশ দাফনে কোনো অসুবিধা আছে কিনা। কোনো অসুবিধা নেই বলার পরও তারা অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে লাগল। বললো কোনো সমস্যা হলে তোমাদের শেষ করে দিয়ে যাব।
লাশ বহন করার জন্য কিছু লোক সংগ্রহ করে রেখেছিলাম। একজন আর্মি অফিসার তাদের তাড়িয়ে দিল। তারাও ভয়ে দৌড়ে ডাকবাংলোর পেছনে পুকুরে ঝাপিয়ে পড়ল। ম্যাজিস্ট্রেট কাদের সাহেবকে দৌড়ানি দিলে তিনি দৌড়ে পানির কাছাকাছি চলে যান। এসময় এসডিপিও সাহেব তাকে উদ্ধার করে নিয়ে এসে আর্মি কর্মকর্তাদের জানান তিনিতো ম্যাজিস্ট্রেট।
অনেক্ষণ পর হেলিকপ্টারের পেছন দিক থেকে কফিন বের করা হলো। কফিনের কোনো হাতল নেই। কফিন ওঠানো যাচ্ছিল না। খুব ভারী। এসময় ‘লোকজন রাখনি কেন’ বলে আর্মিরা আমাদের উল্টো গালিগালাজ করতে লাগলো। এসডিপিও সাহেব বললেন, ‘আপনারাইতো লোজনজনকে তাড়িয়ে দিলেন।’ এ সময় তাকেও গালিগালাজ করা হয়। আমাকে বললো লোক নিয়ে আস। আমি দৌড়ে রেডক্রস হাসপাতালের পেছনে একটি পাড়া আছে সেখান থেকে ৫ জন লোক নিয়ে আসি।
কয়েকজন শ্রমিক, ২ জন স্পিডবোটের ড্রাইভারসহ ৭/৮ জন মিলে কফিনটি বঙ্গবন্ধুর জন্য তৈরি করা কবরের পাশে নিয়ে রাখা হলো। সেখানে যাওয়ার পর পুরো কফিনসহ লাশটি কবরে নামানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু কবরতো এতো বড় করে খোড়া হয়নি। এটা নিয়ে আরেক দফা মারমুখী অবস্থা। ক্যাপ্টেন সাব মারতে আসেন, মেজর সাব ফেরান।
এ অবস্থায় বলা হয়, ডেডবডি বুঝিয়ে দিতে হবে। কাগজপত্র রেডি কর। এরই মধ্যে সেখান থেকে পালিয়ে যায় এহসান নামে স্থানীয় মাদরাসার মাওলানা। আর্মি কর্মকর্তাদের অনুরোধ করা হয় লাশের গোসল ও জানাজা করার জন্য অন্তত ৫ মিনিট সময় দিতে। রাগারাগির পর তারা রাজী হয়।
কফিন খুলে বঙ্গবন্ধুর মৃতদেহ কফিনের ডালার ওপর রাখা হয়। লাশ খুলে দেখা যায় নিচে পলিথিন দিয়ে এবং ওপরে সাদা কাপড়ে বরফ দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে। বরফ সরিয়ে লাশ নামালো হলো। বঙ্গবন্ধুর পরনে ছিল পাঞ্জাবি ও লুঙ্গি। পাঞ্জাবির এক পকেটে ছিল তামাক টানার একটি পাইপ ও চশমার ভাঙা এক টুকরা ফেম। মাওলানা সাহেব ব্লেড দিয়ে ওনার (বঙ্গবন্ধুর) গায়ের কাপড় কেটে সরাতে গিয়ে তার হাত কাপছিল। এসডিপিও সাহেব তাকে সহায়তা করলেন। তখন প্রশ্ন দেখা দিলো সাবান কোখায়, কাফনের কাপড় কোথায়? আমাকে পাঠানো হলো সাবান আনতে। দৌড়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে গেলাম। বাড়ির কেয়ারটেকার শ্রী বৈকুন্ঠ। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার খবর পেয়েই সে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়। খোঁজাখুঁজি করে একটা লাল সাবান পেলাম। সেটা এনে দেই। কিন্তু এর আগেই এসডিও সাহেব দোকান থেকে একটি সাবান কিনে আনান। এ সাবান দিয়ে বঙ্গবন্ধুর গোসল দেয়া হয়।’
বঙ্গবন্ধুর লাশ বুঝে নেয়ার বিষয়ে তিনি বলেন ‘এ সময় আর্মিরা লাশ বুঝে নেয়ার জন্য তাগাদা দিতে থাকে। এর মধ্যে আর্মিরা কাগজ তৈরি করে। বঙ্গবন্ধুর নাম. বাবার নাম, ঠিকানাসহ লাশ বুঝিয়া পাইলাম লেখা কাগজে বঙ্গবন্ধুর দূর সম্পর্কের মামা, এসডিপিও সাব ও আমার স্বাক্ষর নিল।
গোসল করানোর পর দেখা গেলো যে কাপড় দিয়ে বঙ্গবন্ধুর মৃতদেহ আনা হয়েছিল, সেটি রক্তে ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে। এটি দিয়ে কাফনের কাপড় হবে না। তাই সিআই আবদুল মালেক রেডক্রস হাসপাতাল থেকে দু’টি সাদা রঙের ত্রাণের কাপড় এনে কাফনের কাপড় তৈরি করালেন। লেবার, পুলিশের লোক মিলে ২৪/২৫ জন মিলে জানাজা করা হয়। জানাজার পর ১০/১২ জন মিলে বঙ্গবন্ধুর লাশ কবরে নামানো হয়।’
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে দেশে একটি কলঙ্কিত অধ্যায়ের সূচনা হয়। আর জাতির এ শেষ্ঠ সন্তানের লাশ দাফন ও তত্ত্বাবধানে নীরব সাক্ষী হয়ে থাকা সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মো. আবদুল জলিল জানান, ‘বঙ্গবন্ধুর কবরে মাটি দেয়া শেষ হতে না হতেই ঘটনাস্থল ছেড়ে চলে যায় সেনাবাহিনীর লোকজন। এভাবেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃতদেহ দাফন করা হয়। ওই দিন বিকেলে কবরে বাঁশের বেড়া দেয়া হয়।অনুষ্ঠান শেষে রাসেল আহমেদ বলেন “এই শোককে আমাদের শক্তিতে পরিণত করার মাধ্যমে আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জাতির জনকের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে হবে।”
হাওর বার্তা