ঢাকা ১২:২০ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙা করতে ভূমিকা রাখছে মিল্কভিটা

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১২:০৬:২৮ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৪ অগাস্ট ২০১৫
  • ৬৪৭ বার

১৯৭৩ সালের কথা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উত্তরবঙ্গে একটি কর্মসূচি শেষ করে ঢাকায় ফিরছিলেন। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের বাঘাবাড়িতে ফেরি পারাপারের ব্যবস্থা ছিল তখন। ফেরিতে ওঠার সময় দেখলেন বঙ্গবন্ধু, যারাই হেঁটে যাচ্ছেন তাদের সঙ্গেই একপাল গরু।
একজন রাখালকে ডাকলেন, জানতে চাইলেন, ‘গরু নিয়ে কই যাও?’।
জবাব আসলো, ‘গরু পালি, দুধ বেচি’।
‘কত করে বেচো?’-সরল মনে জানতে চাইলেন প্রান্তজনের অন্তঃপ্রাণ মুজিব।
লোকটি বললো, ‘স্যার গ্রামে গ্রামে বেচি। মহাজনরা যা দেয় তাই পাই।’
কথোপকথন শেষ। ফেরিতে উঠেই মুজিব ভাবলেন, মহাজনদের হাত থেকে বাঁচাতে হবে এই প্রান্তজনদের। কিছু একটা করতে আবু সাঈদকে (আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক তথ্যমন্ত্রী) প্রধান করে একটি কমিটি করেন। ওই কমিটিকে ভারতের আমুল ডেইরি ফার্ম দেখার জন্য পাঠালেন। এর আমলে বাংলাদেশেও একটি প্রতিষ্ঠান গড়ার ইচ্ছার কথা বলেন।
প্রতিনিধিদল ভারত ঘুরে এসে ধারণা দিল। সেই অনুযায়ী গড়ে তোলা হল আজকের মিল্কভিটা। সমবায়ের মাধ্যমে গড়ে তোলা এই প্রতিষ্ঠানটির গোড়াপত্তনের ইতিহাস এভাবেই সংক্ষেপে তুলে ধরলেন মিল্কভিটার চেয়ারম্যান শেখ নাদির হোসেন লিপু। বললেন, ‘মিল্কভিটা গড়ে তোলার পেছনে বঙ্গবন্ধুর লক্ষ্য ছিল একটাই, মানুষ যেন পুষ্টিহীনতায় মারা না যায়। তিনি কত উঁচু মানের নেতা ছিলেন, কত দূরদর্শী ছিলেন তার একটা উদাহরণ এই প্রতিষ্ঠান।’
নাদির হোসেন লিপু নিজেও একজন সমবায়ী। ২৮ বছর ধরে সমবায়ের সঙ্গে তার পথচলা। তার বাবাও একজন সমবায়ী ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ জাতীয় সমবায় ইউনিয়নেরও চেয়ারম্যান।
নানা চড়াই উৎড়াই পেরিয়ে দুধের বাজারে মানুষের আস্থার প্রতীক হয়ে উঠেছে মিল্কভিটা। চেয়ারম্যান বললেন, নানা সমস্যা কাটাতে পারলে আরও বহুদূর যাওয়ার সুযোগ আছে। জানালেন, গুঁড়োদুধ প্রকল্প হাতে নিয়েছেন তারা। আলাপচারিতায় ছিলেন- হাবিবুল্লাহ ফাহাদ
মিল্কভিটা গড়ে তোলার পেছনে উদ্দেশ্য কী ছিল?
মানুষের পুষ্টির চাহিদা মেটানোর জন্য মিল্কভিটার জন্ম। উদ্দেশ্য ছিল, ‘না লাভ, না লোকসান’ এই ভিত্তিতে এটা চলবে। যাতে দেশের সাধারণ হতদরিদ্র মানুষ কম টাকায় মিল্কভিটার দুধ কিনতে পারে, খেতে পারে।
শুরুতে কতগুলো প্লান্ট করা হয়েছিল?
বঙ্গবন্ধু একই সঙ্গে পাঁচটি প্লান্ট বাংলাদেশে স্থাপন করেন। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার বাঘাবাড়িতে, টাঙ্গাইলে, মানিকগঞ্জে, টেকেরহাটে এবং রাজধানীর মিরপুরে এখন যে কারখানা আছে সেটি।
প্রতিষ্ঠানটি সমবায় ভিত্তিতে করার কারণ কি?
একে সমবায়ের মাধ্যমে গড়ে তোলার পেছনে কারণ ছিল। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে কোনো বড় ধরনের শিল্প কারখানা ছিল না। বঙ্গবন্ধুর একটা সম্পদ ছিল, সাড়ে সাত কোটি বাঙালি। এই জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগানোর জন্য তিনি সমবায় সৃষ্টি করেন। দেশের সংবিধানে তিন ধরনের মালিকানা আছে। একটি রাষ্ট্রীয় মালিকানা, ব্যক্তি মালিকানা এবং সমবায় ভিত্তিক মালিকানা।
মিল্কভিটার অধীনে এখন কতগুলো সমিতি আছে, এর সদস্য সংখ্যা কত?
মিল্কভিটার অধীনে এক হাজার ৮০০ প্রাথমিক দুগ্ধ সমিতি আছে। যার সদস্য সংখ্যা এক লাখ। এই সদস্যরাই মিল্কভিটার মালিকানার অংশীদার।
এই সমবায় কী পদ্ধতিতে কাজ করে?
মিল্কভিটা দুধ উৎপাদন করার জন্য সমবায় সমিতির মাধ্যমে খামারি তৈরি করে। তাদের বিনা সুদে নামমাত্র সার্ভিস চার্জের বিনিময়ে গরু কেনার জন্য ঋণ দেয়া হয়।
এই গরুগুলো লালন-পালনে আপনাদের কোনো ভূমিকা আছে?
গরু লালন-পালনের জন্য মিল্কভিটা থেকে চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়। গরুর জন্য যাবতীয় ওষুধ সরবরাহ করা হয়। পাশাপাশি বেশি দুধ উৎপাদনের জন্য যে ধরনের ঘাস গরুকে খাওয়াতে হয় সেই ঘাসের বীজ বিদেশ থেকে এনে খামারিদের দেয়া হয়েছে। তারা এই ঘাস চাষ করে গরুকে খাওয়ায়। তবে এখানে রবীন্দ্রনাথের কথা না বললে তাকে ছোট করা হবে।
রবীন্দ্রনাথের কী অবদান রয়েছে?
সিরাজগঞ্জ, বাঘাবাড়ী এবং পাবনাতে আমাদের যে বাথান ভূমি রয়েছে এগুলোর মালিক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি গরিব চাষিদের কথা চিন্তা করেই বাথানভূমিগুলো তাদের দিয়ে গেছেন। এসব জায়গাতেই ঘাস চাষ করে খামারিদের সরবরাহ করা হয়।
আপনি মিল্কভিটা চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়েছেন কবে? আর এসে কী পেয়েছেন?
এ বছরের ৩০ মার্চ দায়িত্ব নিয়েছি। দায়িত্ব নেয়ার পর আমি পেলাম ৪৩ বছরের পুরোনো শিল্প কারখানা। অনেকদিনের পুরোনো মেশিনপত্র। যেগুলো বার্ধক্যজনিত কারণে নানান সমস্যায় জড়ানো। এইসব মেশিনপত্রের যে পরিমাণ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল তা কমে এসেছে।
মেশিনপত্রের উৎপাদন ক্ষমতা কমে আসায় কী ধরনের সমস্যা হচ্ছে?
এক উত্তরবঙ্গেই সমবায়ীদের মাধ্যমে প্রতিদিন ছয় লাখ লিটার দুধ উৎপাদন হচ্ছে। সমবায়ীদের বাইরে সবাইকে মিলিয়ে মোট ১২ লাখ লিটার দুধ উৎপাদন হয়। কিন্তু মিল্কভিটা সমবায়ীদের উৎপাদিত দুধের দেড় থেকে দুই লাখ লিটার দুধ নিতে পারে। বাকিটা নিতে পারে না।
এই সমস্যা কেন তৈরি হয়েছে?
বিএমআরই (কারখানার ভারসাম্যতা, আধুনিকায়ন, পুনর্বাসন ও সম্প্রসারণ) না হওয়ায় এই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক অবস্থা কেমন ছিল?
আমি যোগ দেয়ার আগে প্রতিষ্ঠানটি অর্থনৈতিকভাবে লোকসানে ছিল। প্রতিমাসে তিন থেকে চার কোটি টাকা ক্ষতি গুণতে হতো। সেই প্রতিষ্ঠানকে লাভে ফিরিয়ে এনেছি। প্রতিমাসেই লাভের হার বাড়ছে। প্রথম মাসে এক কোটি ২৫ লাখ, দ্বিতীয় মাসে এক কোটি ৫৫ লাখ, তৃতীয় মাসে এক কোটি ৭৫ লাখ এবং গত জুলাই মাসে তিন কোটি ৭০ লাখ টাকা লাভ হয়েছে।
আপনারা কারখানার আধুনিকায়নের কী উদ্যোগ নিয়েছেন?
হ্যাঁ, আমরা প্রতিটি কারখানাতেই পর্যায়ক্রমে বিএমআরই করার উদ্যোগ নিয়েছি।
মিল্কভিটাকে ক্ষতি থেকে লাভের দিকে নিয়ে আসতে কোন দিকগুলোতে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন?
গত চার মাসে আমি কোনো জাদু দেখাইনি যে প্রতিষ্ঠান লাভে চলে এসেছে। আমি খুঁজে বের করেছি কোথায় খরচ বেশি হচ্ছে। কিছু কিছু জায়গায় আমরা খরচ কমিয়ে এনেছি। তাই প্রতিষ্ঠান লাভের মুখ দেখেছে।
কোন কোন ক্ষেত্রে এটা করেছেন?
নিয়ম হচ্ছে, একজন সমবায়ী গাভীর দুধ সংগ্রহ করার পর তার সমিতির কার্যালয়ে নিয়ে আসবে। সেখান থেকে মিল্কভিটার নিজস্ব পরিবহণের মাধ্যমে দুধগুলো আমাদের কারখানায় আনা হয়। এখানে কিলোমিটার ভিত্তিতে একটা খরচ ঠিক করা আছে। কার অফিস কতদূরে এটা পরিমাপ করে নির্দিষ্ট টাকা সমিতিকে দেয়া হয়। সেখানে দেখা গেছে, এই ক্ষেত্রে কিছু অনিয়ম ছিল।
কীভাবে এই অনিয়মটা হতো?
যেমন- একটি সমিতির অফিস মিল্কভিটার ফ্যাক্টরি থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে। সেখানে এটাকে দেখানো হতো ৩০ থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে। এই হারেই টাকা পরিশোধ করা হতো। এভাবে টাকার অপব্যবহার হতো।
আমি এই বিষয়গুলোতে গুরুত্ব দেই। সিরাজগঞ্জ-পাবনা অঞ্চলে আমাদের নয়শর মতো সমিতি। বাকি নয়শ দেশের অন্যান্য জায়গায়। মিল্কভিটার কারখানা থেকে কোন সমিতির কার্যালয় কতদূরে সেটা জরিপ করি। এতে দেখা গেছে, সমিতিগুলোর দূরত্ব অনেকটা কমে এসেছে। এখানে অনিয়ম বন্ধ করার পর খরচের একটি বড় অংশ কমে আসে।
কেনাকাটায় অনিয়মের কথা শোনা যেতো…
গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙা করতে ভূমিকা রাখছে মিল্কভিটা
কেনাকাটাতেও বড় ধরনের অনিয়ম হতো। আমি এগুলো বন্ধে নজরদারি বাড়াতে পরিচালনা পরিষদের সদস্যদের দিয়ে একটি করে সাব-কমিটি করে দেই। কোথাও কোনো কেনাকাটা হলে এই কমিটিতে তা উপস্থাপন করা হয়। কমিটি সব যাচাই-বাছাই করে অনুমোদন দেয়। এতে আর অনিয়ম করার সুযোগ থাকছে না। এই খাতেও বড় অংকের টাকা বেঁচে যাচ্ছে।
প্রায়ই শোনা যেতো মিল্কভিটার দুধ পঁচে যাচ্ছে। পত্রিকাতে এনিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হতো…
আসলে প্রচার না থাকার কারণে এটা হচ্ছে। মানুষকে বোঝাতে হবে যে, মিল্কভিটা হচ্ছে পাস্তুরিত দুধ। এটা মানুষকে বোঝানোর দরকার ছিল। ইতিপূর্বে যারা দায়িত্বে ছিলেন তারা এই বিষয়টি মানুষকে জানাতে ব্যর্থ হয়েছে।
পাস্তুরিত দুধ মাইনাস দুই ডিগ্রি তাপমাত্রায় রাখতে হবে। ডিলারদের যে ধরনের ট্রান্সপোর্ট সুবিধা থাকা উচিত ছিল তা নেই। ডিলাররা যে ভ্যানে করে দুধগুলো নিচ্ছে সেটার ভেতরের তাপমাত্রা ঠিকঠাক আছে কি না সেটা গুরুত্বপূর্ণ।
এখানে সমস্যা কোথায় হচ্ছে?
আমরা দুধটা দিয়ে আসি সকাল ৫ থেকে ৬টার দিকে। ডিলাররা দোকানে সরবরাহ করতে করতে দুপুর ১২টা থেকে একটা বেজে যায়। এছাড়া ক্রেতাদেরও অসাবধানতা আছে।
অনেক সময় ক্রেতারা দোকান থেকে দুধ কেনার পর ঘণ্টার পর ঘণ্টা এটাকে বাইরে ফেলে রাখছে। ফ্রিজেও রাখছে না, আবার ফুটাচ্ছে না। আবার ফ্রিজে রাখলেও ডিপে তোলে না। এ কারণে অনেক সময় দুধ নষ্ট হয়ে যায়। তখন মানুষ বলে, মিল্কভিটার দুধ ভাল না। আসলে তারা পাস্তুরিত দুধ সংরক্ষণের বিষয়টা ভালভাবে জানে না বলেই এই সমস্যা হচ্ছে।
তাহলে কতটুকু সময় ফ্রিজের বাইরে বা না ফুটিয়ে রাখা যায়?
নিয়ম হচ্ছে, কোনো অবস্থাতেই ১৫ মিনিটের বেশি মাইনাস দুই ডিগ্রি তাপমাত্রার বাইরে দুধ রাখা যাবে না।
আপনাদের মোট ডিলার সংখ্যা কত?
আমাদের ৪৭ জন ডিলার আছে ঢাকাতে। এটা ৪৭টি সমবায় সমিতির মাধ্যমে পরিচালিত হয়।
মিল্কভিটার সমবায়ের মাধ্যমে কী পরিমাণ মানুষ উপকৃত হয়েছে?
আমাদের সমবায়ের তিন ধরনের সমিতি । একটি হচ্ছে প্রাথমিক সমিতি, কয়েকটা প্রাথমিক সমিতির মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সমিতি তৈরি হয়। আবার বেশকিছু কেন্দ্রীয় সমিতির মাধ্যমে জাতীয় সমিতি। মিল্কভিটা একটা জাতীয় সমিতি। সবমিলিয়ে এখন প্রাথমিক সমিতির সদস্য সংখ্যা এক লাখ। তাদের উৎপাদিত দুধই আমরা কিনে নেই।
বাজারে আরও অনেক পাস্তুরিত দুধ বিক্রি হয়। এগুলোর সঙ্গে মিল্কভিটার মূল পার্থক্য কোথায়?
প্রাণ, ব্র্যাকের আড়ং, আকিজগ্রুপের ফার্মফ্রেশ, টাটকা নামে দুধ বাজারে আছে। তাদের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য হচ্ছে, তাদের নিজস্ব খামারি নেই। আমরা নিজেরাই দুধ উৎপাদন করি এবং সেই দুধ বাজারজাত করি।
দামে কোনো পার্থক্য?
হ্যাঁ, দুধের দামেও পার্থক্য আছে। খামারিদের কাছ থেকে কেনার ক্ষেত্রে লিটার প্রতি এই ব্যবধান আট থেকে ১০ টাকা। কিন্তু বাজারে তাদের দুধের দাম আমাদের সমান। আমরা এখানে সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে লাভকে গুরুত্ব দেই না।
দুধের দাম আপনারা কীভাবে নির্ধারণ করেন?
দুধের গুণগত মানের ওপর নির্ভর করে দুধের দাম নির্ধারণ করা হয়।
কী ধরনের গুণগত মানের কথা বলছেন?
চার শতাংশের ওপরে ফ্যাট যত বেশি হবে দুধটা ততো ভাল থাকবে। ২৭ ল্যাক্টো থাকলে দুধটা ভাল হবে। আগে এই নিয়মগুলো ছিল কিন্তু মানা হতো না।
খামারিরা আগে মাঝেমধ্যে দুধ রাস্তায় ঢেলে বিক্ষোভ করতো। তাদের অভিযোগ নিতো না মিল্কভিটা…
মেশিনগুলো বয়স হয়ে গেছে, এমন অজুহাতে খামারিদের সব দুধ নেয়া সম্ভব হতো না। দুধ ফেরত যেতো। খামারিরা দুধ রাস্তায় ঢেলে বিক্ষোভ করেছে, এটা পত্রপত্রিকায় এসেছে।
আপনি আসার পর এ ব্যাপারে কী উদ্যোগ নিয়েছেন?
আমি আসার পর প্রথম শাহজাদপুর গিয়ে সব কর্মকর্তাদের ডেকে একটা কথাই বললাম, যখন দুধ খামারিরা ফ্যাক্টরিতে নিয়ে আসবে তখন এগুলো আর ফেরত দেয়া যাবে না, দুধ রাখতে হবে। এগুলো প্রক্রিয়াজাত করে বাজারজাত করতে হবে।
মিল্কভিটার বিক্রি কী বেড়েছে?
অবশ্যই বেড়েছে। আগে ৮০ হাজার থেকে এক লাখ লিটার দুধ বিক্রি করা হতো। আমি দায়িত্ব নেয়ার পর এটাকে গড়ে এক লাখ ৭০ হাজার লিটারে নিয়ে এসেছি। পুরো রোজার মাসে প্রতিদিন চার লাখ লিটার দুধ সরবরাহ করেছি।
মিল্কভিটা নিয়ে আপনাদের নতুন কোনো পরিকল্পনা রয়েছে?
শাহজাদপুরের বাঘাবাড়িতে আমাদের একটি গুড়োদুধের প্লান্ট স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে। গত একনেক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী মিল্কভিটার এই প্রকল্পটি অনুমোদন দিয়েছেন। এটা ১০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প। অর্থায়নের ৭৫ শতাংশ দেবে সরকার। বাকিটা মিল্কভিটার নিজস্ব।
এই প্রকল্পের লক্ষ্যমাত্রা কী, কাজ নাগাদ উৎপাদনে যাওয়া যাবে বলে মনে করছেন?
এই প্রকল্পের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে, প্রতিদিন ২৫ টন গুড়াদুধ উৎপাদন করা। প্রকল্পের প্রাথমিক কাজ শুরু হয়ে গেছে। দরপত্র আহ্বায়ন প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে। আগামী দুই বছরের মধ্যে যেন প্লান্টটি উৎপাদনে যেতে পারে, এই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছি।
মিল্কভিটার দুধের বাইরেও অনেক পণ্য আছে। যেমন- দই, ঘি, মাখন, আইসক্রিম, চকলেট, লাবাং ইত্যাদি। প্রচার-প্রচারণার অভাবে এগুলো দুধের মতো অতটা জনপ্রিয় হয়নি বলে মনে করা হয়…
এটা অনেকটা ঠিক। এর বাইরেও কারণ আছে। বাজারে আমাদের প্রতিযোগী যারা আছেন, তাদের মধ্যে একটি অংশ হয়তো পেছন থেকে নানা ধরনের তৎপরতা চালাচ্ছে।
কী ধরনের তৎপরতার কথা বলছেন?
হতে পারে মিল্কভিটার উৎপাদন, বিপণনের গতি কমিয়ে দেয়ার চেষ্টাও কোনো কোনো ক্ষেত্রে হচ্ছে। যে কারণে বাজারে আমাদের অবস্থান যেখানে থাকার কথা ছিল সেটা নেই।
বিপণনকে ঢেলে সাজানোর কোনো পরিকল্পনা কী আছে?
আমরা মিল্কভিটার মার্কেটিংকে ঢেলে সাজানোর শুরু করেছি। সারাদেশে এর বিপণন ব্যবস্থাতে পরিবর্তন আনছি। মার্কেটিং টিমের সঙ্গে সম্প্রতি বৈঠক করে তাদের টার্গেট দিয়ে দেয়া হয়েছে। তারা যদি এটা পূরণ করতে না পারে তাহলে তাদের বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বন্ধ থাকবে বলে জানিয়ে দেয়া হয়েছে।
ডিলার সংখ্যা বাড়ানোর কোনো উদ্যোগ কী নিয়েছেন?
সারাদেশে আমাদের যে ৪৭টি পরিবেশক আছে, তারা হাইকোর্টে একটি রিট করেছিল যাতে আমরা আর এই সংখ্যা বাড়াতে না পারি। এই রিটের নিষ্পত্তির জন্য আইনি প্রক্রিয়া চলছে। এটি নিষ্পত্তি হলে আমরা আরও নতুন নতুন পরিবেশক দিতে পারবো।
বিপণন বাড়িয়ে মিল্কভিটাকে কোন পর্যায়ে নিয়ে যেতে চান?
আমাদের লক্ষ্য তরল দুধ দৈনিক তিন লাখ লিটার বিক্রি করবো। পাশাপাশি অন্যান্য পণ্যগুলোর বিক্রি দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা আছে।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় ও সমবায় অধিদপ্তর থেকে কী ধরনের সমর্থন বা সহযোগিতা পাচ্ছেন?
মাননীয় এলজিআরডি মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন দায়িত্ব নেয়ার পর তিনি, প্রতিমন্ত্রী, সমবায় সচিব, অধিদপ্তরের মহাপরিচালক থেকে শুরু করে সবাই খুব সহযোগিতা করছেন। মন্ত্রণালয় এবং অধিদপ্তর মিলে এত সহযোগিতা অতীতে কেউ পেয়েছে এমন নজির নেই। মিল্কভিটার উন্নয়নে যেকোনো সিদ্ধান্তের ফাইল মন্ত্রণালয় এবং অধিদপ্তরে পাঠালে দ্রুত সিদ্ধান্ত দেয়া হচ্ছে। এতে আমার জন্য কাজ অনেক সহজ হয়ে যাচ্ছে।
নতুন মন্ত্রী দায়িত্ব নেয়ার পর গরুর দুধের পাশাপাশি মহিষের দুধ উৎপাদনে গুরুত্বারোপ করেছেন। এ ব্যাপারে আপনাদের কোনো পরিকল্পনা রয়েছে?
আমরা এরই মধ্যে এনিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছি। নোয়াখালীর সুবর্ণচর এবং মাদারীপুর জেলার টেকেরহাটে পাইলট প্রকল্প নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি বরিশালের গলাচিপায় আরেকটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে।
গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙা করার কথা বলা হয়, মিল্কভিটা এক্ষেত্রে কী অবদান রাখছে?
বাংলাদেশ একটি গ্রামভিত্তিক দেশ। গ্রামীণ অর্থনীতি মজবুত না হলে দেশের অর্থনীতি কখনই মজবুত হবে না। এই গ্রামীণ অর্থনীতিকে মজবুত করার একটি পদক্ষেপ হচ্ছে মিল্কভিটা। বঙ্গবন্ধুর লক্ষ্য ছিল গ্রামের মানুষ যেন তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য দাম পায়। সেটি যে সমবায়ের মাধ্যমে সম্ভব এটা তার আরেকটি প্রমাণ।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙা করতে ভূমিকা রাখছে মিল্কভিটা

আপডেট টাইম : ১২:০৬:২৮ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৪ অগাস্ট ২০১৫

১৯৭৩ সালের কথা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উত্তরবঙ্গে একটি কর্মসূচি শেষ করে ঢাকায় ফিরছিলেন। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের বাঘাবাড়িতে ফেরি পারাপারের ব্যবস্থা ছিল তখন। ফেরিতে ওঠার সময় দেখলেন বঙ্গবন্ধু, যারাই হেঁটে যাচ্ছেন তাদের সঙ্গেই একপাল গরু।
একজন রাখালকে ডাকলেন, জানতে চাইলেন, ‘গরু নিয়ে কই যাও?’।
জবাব আসলো, ‘গরু পালি, দুধ বেচি’।
‘কত করে বেচো?’-সরল মনে জানতে চাইলেন প্রান্তজনের অন্তঃপ্রাণ মুজিব।
লোকটি বললো, ‘স্যার গ্রামে গ্রামে বেচি। মহাজনরা যা দেয় তাই পাই।’
কথোপকথন শেষ। ফেরিতে উঠেই মুজিব ভাবলেন, মহাজনদের হাত থেকে বাঁচাতে হবে এই প্রান্তজনদের। কিছু একটা করতে আবু সাঈদকে (আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক তথ্যমন্ত্রী) প্রধান করে একটি কমিটি করেন। ওই কমিটিকে ভারতের আমুল ডেইরি ফার্ম দেখার জন্য পাঠালেন। এর আমলে বাংলাদেশেও একটি প্রতিষ্ঠান গড়ার ইচ্ছার কথা বলেন।
প্রতিনিধিদল ভারত ঘুরে এসে ধারণা দিল। সেই অনুযায়ী গড়ে তোলা হল আজকের মিল্কভিটা। সমবায়ের মাধ্যমে গড়ে তোলা এই প্রতিষ্ঠানটির গোড়াপত্তনের ইতিহাস এভাবেই সংক্ষেপে তুলে ধরলেন মিল্কভিটার চেয়ারম্যান শেখ নাদির হোসেন লিপু। বললেন, ‘মিল্কভিটা গড়ে তোলার পেছনে বঙ্গবন্ধুর লক্ষ্য ছিল একটাই, মানুষ যেন পুষ্টিহীনতায় মারা না যায়। তিনি কত উঁচু মানের নেতা ছিলেন, কত দূরদর্শী ছিলেন তার একটা উদাহরণ এই প্রতিষ্ঠান।’
নাদির হোসেন লিপু নিজেও একজন সমবায়ী। ২৮ বছর ধরে সমবায়ের সঙ্গে তার পথচলা। তার বাবাও একজন সমবায়ী ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ জাতীয় সমবায় ইউনিয়নেরও চেয়ারম্যান।
নানা চড়াই উৎড়াই পেরিয়ে দুধের বাজারে মানুষের আস্থার প্রতীক হয়ে উঠেছে মিল্কভিটা। চেয়ারম্যান বললেন, নানা সমস্যা কাটাতে পারলে আরও বহুদূর যাওয়ার সুযোগ আছে। জানালেন, গুঁড়োদুধ প্রকল্প হাতে নিয়েছেন তারা। আলাপচারিতায় ছিলেন- হাবিবুল্লাহ ফাহাদ
মিল্কভিটা গড়ে তোলার পেছনে উদ্দেশ্য কী ছিল?
মানুষের পুষ্টির চাহিদা মেটানোর জন্য মিল্কভিটার জন্ম। উদ্দেশ্য ছিল, ‘না লাভ, না লোকসান’ এই ভিত্তিতে এটা চলবে। যাতে দেশের সাধারণ হতদরিদ্র মানুষ কম টাকায় মিল্কভিটার দুধ কিনতে পারে, খেতে পারে।
শুরুতে কতগুলো প্লান্ট করা হয়েছিল?
বঙ্গবন্ধু একই সঙ্গে পাঁচটি প্লান্ট বাংলাদেশে স্থাপন করেন। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার বাঘাবাড়িতে, টাঙ্গাইলে, মানিকগঞ্জে, টেকেরহাটে এবং রাজধানীর মিরপুরে এখন যে কারখানা আছে সেটি।
প্রতিষ্ঠানটি সমবায় ভিত্তিতে করার কারণ কি?
একে সমবায়ের মাধ্যমে গড়ে তোলার পেছনে কারণ ছিল। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে কোনো বড় ধরনের শিল্প কারখানা ছিল না। বঙ্গবন্ধুর একটা সম্পদ ছিল, সাড়ে সাত কোটি বাঙালি। এই জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগানোর জন্য তিনি সমবায় সৃষ্টি করেন। দেশের সংবিধানে তিন ধরনের মালিকানা আছে। একটি রাষ্ট্রীয় মালিকানা, ব্যক্তি মালিকানা এবং সমবায় ভিত্তিক মালিকানা।
মিল্কভিটার অধীনে এখন কতগুলো সমিতি আছে, এর সদস্য সংখ্যা কত?
মিল্কভিটার অধীনে এক হাজার ৮০০ প্রাথমিক দুগ্ধ সমিতি আছে। যার সদস্য সংখ্যা এক লাখ। এই সদস্যরাই মিল্কভিটার মালিকানার অংশীদার।
এই সমবায় কী পদ্ধতিতে কাজ করে?
মিল্কভিটা দুধ উৎপাদন করার জন্য সমবায় সমিতির মাধ্যমে খামারি তৈরি করে। তাদের বিনা সুদে নামমাত্র সার্ভিস চার্জের বিনিময়ে গরু কেনার জন্য ঋণ দেয়া হয়।
এই গরুগুলো লালন-পালনে আপনাদের কোনো ভূমিকা আছে?
গরু লালন-পালনের জন্য মিল্কভিটা থেকে চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়। গরুর জন্য যাবতীয় ওষুধ সরবরাহ করা হয়। পাশাপাশি বেশি দুধ উৎপাদনের জন্য যে ধরনের ঘাস গরুকে খাওয়াতে হয় সেই ঘাসের বীজ বিদেশ থেকে এনে খামারিদের দেয়া হয়েছে। তারা এই ঘাস চাষ করে গরুকে খাওয়ায়। তবে এখানে রবীন্দ্রনাথের কথা না বললে তাকে ছোট করা হবে।
রবীন্দ্রনাথের কী অবদান রয়েছে?
সিরাজগঞ্জ, বাঘাবাড়ী এবং পাবনাতে আমাদের যে বাথান ভূমি রয়েছে এগুলোর মালিক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি গরিব চাষিদের কথা চিন্তা করেই বাথানভূমিগুলো তাদের দিয়ে গেছেন। এসব জায়গাতেই ঘাস চাষ করে খামারিদের সরবরাহ করা হয়।
আপনি মিল্কভিটা চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়েছেন কবে? আর এসে কী পেয়েছেন?
এ বছরের ৩০ মার্চ দায়িত্ব নিয়েছি। দায়িত্ব নেয়ার পর আমি পেলাম ৪৩ বছরের পুরোনো শিল্প কারখানা। অনেকদিনের পুরোনো মেশিনপত্র। যেগুলো বার্ধক্যজনিত কারণে নানান সমস্যায় জড়ানো। এইসব মেশিনপত্রের যে পরিমাণ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল তা কমে এসেছে।
মেশিনপত্রের উৎপাদন ক্ষমতা কমে আসায় কী ধরনের সমস্যা হচ্ছে?
এক উত্তরবঙ্গেই সমবায়ীদের মাধ্যমে প্রতিদিন ছয় লাখ লিটার দুধ উৎপাদন হচ্ছে। সমবায়ীদের বাইরে সবাইকে মিলিয়ে মোট ১২ লাখ লিটার দুধ উৎপাদন হয়। কিন্তু মিল্কভিটা সমবায়ীদের উৎপাদিত দুধের দেড় থেকে দুই লাখ লিটার দুধ নিতে পারে। বাকিটা নিতে পারে না।
এই সমস্যা কেন তৈরি হয়েছে?
বিএমআরই (কারখানার ভারসাম্যতা, আধুনিকায়ন, পুনর্বাসন ও সম্প্রসারণ) না হওয়ায় এই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক অবস্থা কেমন ছিল?
আমি যোগ দেয়ার আগে প্রতিষ্ঠানটি অর্থনৈতিকভাবে লোকসানে ছিল। প্রতিমাসে তিন থেকে চার কোটি টাকা ক্ষতি গুণতে হতো। সেই প্রতিষ্ঠানকে লাভে ফিরিয়ে এনেছি। প্রতিমাসেই লাভের হার বাড়ছে। প্রথম মাসে এক কোটি ২৫ লাখ, দ্বিতীয় মাসে এক কোটি ৫৫ লাখ, তৃতীয় মাসে এক কোটি ৭৫ লাখ এবং গত জুলাই মাসে তিন কোটি ৭০ লাখ টাকা লাভ হয়েছে।
আপনারা কারখানার আধুনিকায়নের কী উদ্যোগ নিয়েছেন?
হ্যাঁ, আমরা প্রতিটি কারখানাতেই পর্যায়ক্রমে বিএমআরই করার উদ্যোগ নিয়েছি।
মিল্কভিটাকে ক্ষতি থেকে লাভের দিকে নিয়ে আসতে কোন দিকগুলোতে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন?
গত চার মাসে আমি কোনো জাদু দেখাইনি যে প্রতিষ্ঠান লাভে চলে এসেছে। আমি খুঁজে বের করেছি কোথায় খরচ বেশি হচ্ছে। কিছু কিছু জায়গায় আমরা খরচ কমিয়ে এনেছি। তাই প্রতিষ্ঠান লাভের মুখ দেখেছে।
কোন কোন ক্ষেত্রে এটা করেছেন?
নিয়ম হচ্ছে, একজন সমবায়ী গাভীর দুধ সংগ্রহ করার পর তার সমিতির কার্যালয়ে নিয়ে আসবে। সেখান থেকে মিল্কভিটার নিজস্ব পরিবহণের মাধ্যমে দুধগুলো আমাদের কারখানায় আনা হয়। এখানে কিলোমিটার ভিত্তিতে একটা খরচ ঠিক করা আছে। কার অফিস কতদূরে এটা পরিমাপ করে নির্দিষ্ট টাকা সমিতিকে দেয়া হয়। সেখানে দেখা গেছে, এই ক্ষেত্রে কিছু অনিয়ম ছিল।
কীভাবে এই অনিয়মটা হতো?
যেমন- একটি সমিতির অফিস মিল্কভিটার ফ্যাক্টরি থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে। সেখানে এটাকে দেখানো হতো ৩০ থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে। এই হারেই টাকা পরিশোধ করা হতো। এভাবে টাকার অপব্যবহার হতো।
আমি এই বিষয়গুলোতে গুরুত্ব দেই। সিরাজগঞ্জ-পাবনা অঞ্চলে আমাদের নয়শর মতো সমিতি। বাকি নয়শ দেশের অন্যান্য জায়গায়। মিল্কভিটার কারখানা থেকে কোন সমিতির কার্যালয় কতদূরে সেটা জরিপ করি। এতে দেখা গেছে, সমিতিগুলোর দূরত্ব অনেকটা কমে এসেছে। এখানে অনিয়ম বন্ধ করার পর খরচের একটি বড় অংশ কমে আসে।
কেনাকাটায় অনিয়মের কথা শোনা যেতো…
গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙা করতে ভূমিকা রাখছে মিল্কভিটা
কেনাকাটাতেও বড় ধরনের অনিয়ম হতো। আমি এগুলো বন্ধে নজরদারি বাড়াতে পরিচালনা পরিষদের সদস্যদের দিয়ে একটি করে সাব-কমিটি করে দেই। কোথাও কোনো কেনাকাটা হলে এই কমিটিতে তা উপস্থাপন করা হয়। কমিটি সব যাচাই-বাছাই করে অনুমোদন দেয়। এতে আর অনিয়ম করার সুযোগ থাকছে না। এই খাতেও বড় অংকের টাকা বেঁচে যাচ্ছে।
প্রায়ই শোনা যেতো মিল্কভিটার দুধ পঁচে যাচ্ছে। পত্রিকাতে এনিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হতো…
আসলে প্রচার না থাকার কারণে এটা হচ্ছে। মানুষকে বোঝাতে হবে যে, মিল্কভিটা হচ্ছে পাস্তুরিত দুধ। এটা মানুষকে বোঝানোর দরকার ছিল। ইতিপূর্বে যারা দায়িত্বে ছিলেন তারা এই বিষয়টি মানুষকে জানাতে ব্যর্থ হয়েছে।
পাস্তুরিত দুধ মাইনাস দুই ডিগ্রি তাপমাত্রায় রাখতে হবে। ডিলারদের যে ধরনের ট্রান্সপোর্ট সুবিধা থাকা উচিত ছিল তা নেই। ডিলাররা যে ভ্যানে করে দুধগুলো নিচ্ছে সেটার ভেতরের তাপমাত্রা ঠিকঠাক আছে কি না সেটা গুরুত্বপূর্ণ।
এখানে সমস্যা কোথায় হচ্ছে?
আমরা দুধটা দিয়ে আসি সকাল ৫ থেকে ৬টার দিকে। ডিলাররা দোকানে সরবরাহ করতে করতে দুপুর ১২টা থেকে একটা বেজে যায়। এছাড়া ক্রেতাদেরও অসাবধানতা আছে।
অনেক সময় ক্রেতারা দোকান থেকে দুধ কেনার পর ঘণ্টার পর ঘণ্টা এটাকে বাইরে ফেলে রাখছে। ফ্রিজেও রাখছে না, আবার ফুটাচ্ছে না। আবার ফ্রিজে রাখলেও ডিপে তোলে না। এ কারণে অনেক সময় দুধ নষ্ট হয়ে যায়। তখন মানুষ বলে, মিল্কভিটার দুধ ভাল না। আসলে তারা পাস্তুরিত দুধ সংরক্ষণের বিষয়টা ভালভাবে জানে না বলেই এই সমস্যা হচ্ছে।
তাহলে কতটুকু সময় ফ্রিজের বাইরে বা না ফুটিয়ে রাখা যায়?
নিয়ম হচ্ছে, কোনো অবস্থাতেই ১৫ মিনিটের বেশি মাইনাস দুই ডিগ্রি তাপমাত্রার বাইরে দুধ রাখা যাবে না।
আপনাদের মোট ডিলার সংখ্যা কত?
আমাদের ৪৭ জন ডিলার আছে ঢাকাতে। এটা ৪৭টি সমবায় সমিতির মাধ্যমে পরিচালিত হয়।
মিল্কভিটার সমবায়ের মাধ্যমে কী পরিমাণ মানুষ উপকৃত হয়েছে?
আমাদের সমবায়ের তিন ধরনের সমিতি । একটি হচ্ছে প্রাথমিক সমিতি, কয়েকটা প্রাথমিক সমিতির মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সমিতি তৈরি হয়। আবার বেশকিছু কেন্দ্রীয় সমিতির মাধ্যমে জাতীয় সমিতি। মিল্কভিটা একটা জাতীয় সমিতি। সবমিলিয়ে এখন প্রাথমিক সমিতির সদস্য সংখ্যা এক লাখ। তাদের উৎপাদিত দুধই আমরা কিনে নেই।
বাজারে আরও অনেক পাস্তুরিত দুধ বিক্রি হয়। এগুলোর সঙ্গে মিল্কভিটার মূল পার্থক্য কোথায়?
প্রাণ, ব্র্যাকের আড়ং, আকিজগ্রুপের ফার্মফ্রেশ, টাটকা নামে দুধ বাজারে আছে। তাদের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য হচ্ছে, তাদের নিজস্ব খামারি নেই। আমরা নিজেরাই দুধ উৎপাদন করি এবং সেই দুধ বাজারজাত করি।
দামে কোনো পার্থক্য?
হ্যাঁ, দুধের দামেও পার্থক্য আছে। খামারিদের কাছ থেকে কেনার ক্ষেত্রে লিটার প্রতি এই ব্যবধান আট থেকে ১০ টাকা। কিন্তু বাজারে তাদের দুধের দাম আমাদের সমান। আমরা এখানে সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে লাভকে গুরুত্ব দেই না।
দুধের দাম আপনারা কীভাবে নির্ধারণ করেন?
দুধের গুণগত মানের ওপর নির্ভর করে দুধের দাম নির্ধারণ করা হয়।
কী ধরনের গুণগত মানের কথা বলছেন?
চার শতাংশের ওপরে ফ্যাট যত বেশি হবে দুধটা ততো ভাল থাকবে। ২৭ ল্যাক্টো থাকলে দুধটা ভাল হবে। আগে এই নিয়মগুলো ছিল কিন্তু মানা হতো না।
খামারিরা আগে মাঝেমধ্যে দুধ রাস্তায় ঢেলে বিক্ষোভ করতো। তাদের অভিযোগ নিতো না মিল্কভিটা…
মেশিনগুলো বয়স হয়ে গেছে, এমন অজুহাতে খামারিদের সব দুধ নেয়া সম্ভব হতো না। দুধ ফেরত যেতো। খামারিরা দুধ রাস্তায় ঢেলে বিক্ষোভ করেছে, এটা পত্রপত্রিকায় এসেছে।
আপনি আসার পর এ ব্যাপারে কী উদ্যোগ নিয়েছেন?
আমি আসার পর প্রথম শাহজাদপুর গিয়ে সব কর্মকর্তাদের ডেকে একটা কথাই বললাম, যখন দুধ খামারিরা ফ্যাক্টরিতে নিয়ে আসবে তখন এগুলো আর ফেরত দেয়া যাবে না, দুধ রাখতে হবে। এগুলো প্রক্রিয়াজাত করে বাজারজাত করতে হবে।
মিল্কভিটার বিক্রি কী বেড়েছে?
অবশ্যই বেড়েছে। আগে ৮০ হাজার থেকে এক লাখ লিটার দুধ বিক্রি করা হতো। আমি দায়িত্ব নেয়ার পর এটাকে গড়ে এক লাখ ৭০ হাজার লিটারে নিয়ে এসেছি। পুরো রোজার মাসে প্রতিদিন চার লাখ লিটার দুধ সরবরাহ করেছি।
মিল্কভিটা নিয়ে আপনাদের নতুন কোনো পরিকল্পনা রয়েছে?
শাহজাদপুরের বাঘাবাড়িতে আমাদের একটি গুড়োদুধের প্লান্ট স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে। গত একনেক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী মিল্কভিটার এই প্রকল্পটি অনুমোদন দিয়েছেন। এটা ১০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প। অর্থায়নের ৭৫ শতাংশ দেবে সরকার। বাকিটা মিল্কভিটার নিজস্ব।
এই প্রকল্পের লক্ষ্যমাত্রা কী, কাজ নাগাদ উৎপাদনে যাওয়া যাবে বলে মনে করছেন?
এই প্রকল্পের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে, প্রতিদিন ২৫ টন গুড়াদুধ উৎপাদন করা। প্রকল্পের প্রাথমিক কাজ শুরু হয়ে গেছে। দরপত্র আহ্বায়ন প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে। আগামী দুই বছরের মধ্যে যেন প্লান্টটি উৎপাদনে যেতে পারে, এই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছি।
মিল্কভিটার দুধের বাইরেও অনেক পণ্য আছে। যেমন- দই, ঘি, মাখন, আইসক্রিম, চকলেট, লাবাং ইত্যাদি। প্রচার-প্রচারণার অভাবে এগুলো দুধের মতো অতটা জনপ্রিয় হয়নি বলে মনে করা হয়…
এটা অনেকটা ঠিক। এর বাইরেও কারণ আছে। বাজারে আমাদের প্রতিযোগী যারা আছেন, তাদের মধ্যে একটি অংশ হয়তো পেছন থেকে নানা ধরনের তৎপরতা চালাচ্ছে।
কী ধরনের তৎপরতার কথা বলছেন?
হতে পারে মিল্কভিটার উৎপাদন, বিপণনের গতি কমিয়ে দেয়ার চেষ্টাও কোনো কোনো ক্ষেত্রে হচ্ছে। যে কারণে বাজারে আমাদের অবস্থান যেখানে থাকার কথা ছিল সেটা নেই।
বিপণনকে ঢেলে সাজানোর কোনো পরিকল্পনা কী আছে?
আমরা মিল্কভিটার মার্কেটিংকে ঢেলে সাজানোর শুরু করেছি। সারাদেশে এর বিপণন ব্যবস্থাতে পরিবর্তন আনছি। মার্কেটিং টিমের সঙ্গে সম্প্রতি বৈঠক করে তাদের টার্গেট দিয়ে দেয়া হয়েছে। তারা যদি এটা পূরণ করতে না পারে তাহলে তাদের বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বন্ধ থাকবে বলে জানিয়ে দেয়া হয়েছে।
ডিলার সংখ্যা বাড়ানোর কোনো উদ্যোগ কী নিয়েছেন?
সারাদেশে আমাদের যে ৪৭টি পরিবেশক আছে, তারা হাইকোর্টে একটি রিট করেছিল যাতে আমরা আর এই সংখ্যা বাড়াতে না পারি। এই রিটের নিষ্পত্তির জন্য আইনি প্রক্রিয়া চলছে। এটি নিষ্পত্তি হলে আমরা আরও নতুন নতুন পরিবেশক দিতে পারবো।
বিপণন বাড়িয়ে মিল্কভিটাকে কোন পর্যায়ে নিয়ে যেতে চান?
আমাদের লক্ষ্য তরল দুধ দৈনিক তিন লাখ লিটার বিক্রি করবো। পাশাপাশি অন্যান্য পণ্যগুলোর বিক্রি দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা আছে।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় ও সমবায় অধিদপ্তর থেকে কী ধরনের সমর্থন বা সহযোগিতা পাচ্ছেন?
মাননীয় এলজিআরডি মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন দায়িত্ব নেয়ার পর তিনি, প্রতিমন্ত্রী, সমবায় সচিব, অধিদপ্তরের মহাপরিচালক থেকে শুরু করে সবাই খুব সহযোগিতা করছেন। মন্ত্রণালয় এবং অধিদপ্তর মিলে এত সহযোগিতা অতীতে কেউ পেয়েছে এমন নজির নেই। মিল্কভিটার উন্নয়নে যেকোনো সিদ্ধান্তের ফাইল মন্ত্রণালয় এবং অধিদপ্তরে পাঠালে দ্রুত সিদ্ধান্ত দেয়া হচ্ছে। এতে আমার জন্য কাজ অনেক সহজ হয়ে যাচ্ছে।
নতুন মন্ত্রী দায়িত্ব নেয়ার পর গরুর দুধের পাশাপাশি মহিষের দুধ উৎপাদনে গুরুত্বারোপ করেছেন। এ ব্যাপারে আপনাদের কোনো পরিকল্পনা রয়েছে?
আমরা এরই মধ্যে এনিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছি। নোয়াখালীর সুবর্ণচর এবং মাদারীপুর জেলার টেকেরহাটে পাইলট প্রকল্প নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি বরিশালের গলাচিপায় আরেকটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে।
গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙা করার কথা বলা হয়, মিল্কভিটা এক্ষেত্রে কী অবদান রাখছে?
বাংলাদেশ একটি গ্রামভিত্তিক দেশ। গ্রামীণ অর্থনীতি মজবুত না হলে দেশের অর্থনীতি কখনই মজবুত হবে না। এই গ্রামীণ অর্থনীতিকে মজবুত করার একটি পদক্ষেপ হচ্ছে মিল্কভিটা। বঙ্গবন্ধুর লক্ষ্য ছিল গ্রামের মানুষ যেন তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য দাম পায়। সেটি যে সমবায়ের মাধ্যমে সম্ভব এটা তার আরেকটি প্রমাণ।