ঢাকা ১০:৪১ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হাওরের হাহাকারে ত্রাণ পাচ্ছেন না অনেকে

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৫:১২:৫৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৮ অগাস্ট ২০১৭
  • ৩১২ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ ৪০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে শণের ঘর তোলেন রেহানা বেগম। মাস দুয়েক আগে হাওরের ঢেউ কেড়ে নিয়েছে তাঁর সেই ঘর। অন্যের ঘরে এখন তাঁর বাস। কোলে আছে সাত মাস বয়সী দুধের শিশু। অপর পাঁচ সন্তানের মধ্যে দুই কিশোরী মেয়েকে কাজের জন্য পাঠিয়েছেন ঢাকায়। গত সাত দিন শুধু আটার রুটি খেয়ে কেটেছে তাঁর। অথচ ঘরহারা রেহানা পাননি কোনো ত্রাণ। তাঁর গ্রামের নাম জয়পুর নয়াআঁটি। এটি সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার উত্তর শ্রীপুর ইউনিয়নের একটি গ্রাম।

রেহানার মতো সুনামগঞ্জের তাহিরপুর, শাল্লা ও দিরাই উপজেলার অনেক হতদরিদ্র পরিবারের মানুষের খোঁজ মিলেছে, যাঁরা ত্রাণ পাওয়ার যোগ্য, কিন্তু ত্রাণ পাননি। গত তিন দিনে উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামগুলো ঘুরে মিলেছে এই চিত্র। ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাতর এসব মানুষের অভিযোগ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অনেকে তাঁদের পছন্দের লোকদের ত্রাণ দিয়েছেন।

সাধারণত হাওর অঞ্চলে বৈশাখ মাসে ঘরে ধান তোলেন কৃষক। যে পরিমাণ ধান হাওরে হয়, তাতে অধিকাংশ লোকের চাল কেনা লাগে না। ধানের সময় এখানকার দরিদ্র মানুষেরাও দিনমজুরি করে ভালো আয় করে। আর বর্ষার সময় হাওরে নির্দিষ্ট অঞ্চলে মাছ ধরে মোটামুটিভাবে চলে তাঁদের জীবন। কিন্তু গত চৈত্র মাসে পাহাড়ি ঢলে বাঁধ ভেঙে ১ লাখ ৬৬ হাজার ৬১২ হেক্টর জমির ধান তলিয়ে যায়। বর্গাচাষিদের প্রায় সবাই স্থানীয় মহাজন আর বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে ধানের আবাদ করেন। হাওরের ধান তলিয়ে যাওয়ার পর থেকে এলাকায় মানুষের মধ্যে অভাব বাড়তে থাকে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক পরিবারের সংখ্যা ৩ লাখ ২৫ হাজার ৯৯০।

হাওরের ঢেউ নিয়ে গেছে রেহানার ঘর। তিনি সরকারি ত্রাণ পাননি। ছবিটি রোববার সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার জয়পুর নতুন হাঁটি থেকে তোলা। ছবি: আসাদুজ্জামান

এর মধ্যে সরকার ১ লাখ ৬৮ হাজার পরিবারকে ভিজিএফ দিচ্ছে। অর্থাৎ, এসব পরিবার প্রতি মাসে ৩০ কেজি চাল আর ৫০০ টাকা আর্থিক সহায়তা পাচ্ছে। জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা ক্ষতিগ্রস্ত হতদরিদ্র পরিবারের তালিকা করেন।

তাহিরপুরের উমেদপুর নয়াআঁটি গ্রামের বাসিন্দা আমেনা খাতুন। স্বামী আলী নূর। ৩৫ বছরের এই নারীর ছেলেমেয়ে সাতজন। চারজন ছেলে আর মেয়ে তিনজন। সবার ছোট ইব্রাহীম হাসান। বয়স এখন সাত মাস। তাঁর ভাষ্য, তিনবেলা তিন মুঠো ভাত ছেলেমেয়েদের মুখে তুলে দিতে পারছেন না। আটার রুটিই বেশির ভাগ খেতে দিচ্ছেন। স্বামী আলী নূরে হাওরে মাছ ধরেন। কিন্তু আয় হয় ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। তিনিও ভিজিএফ পাননি।

আবদুল মালেকের বাড়ি নুনুয়ার চরে। বয়স ৬০ বছর। তাঁর গ্রামের নাম নুনুয়ার চর। ইউনিয়নের নাম চরনারচর। উপজেলা দিরাই। তিনি এক লাখ টাকা ঋণ করে গত বছরে মেয়েকে বিয়ে দেন। ধান লাগানোর সময় স্থানীয় এক মহাজনের কাছ থেকে নেন আরও ৫০ হাজার টাকা। ঋণগ্রস্ত মালেকের দুই ছেলে আর দুই মেয়ে। হতদরিদ্র এই মানুষটিও জানালেন, তিনি সরকারের কোনো ত্রাণ পাননি। যাঁদের ত্রাণ পাওয়ার কথা নয়, তাঁরাই পেয়েছেন বেশি।

মহিমার বয়স ৫০ বছর। ২০ বছর আগে তাঁর স্বামী জনমত আলী তিন ছেলে রেখে মারা গেছেন। স্বামীকে হারিয়ে অনেক কষ্টে তিন ছেলেকে মানুষ করেছেন। এখন ছেলেরা হাওরে মাছ ধরেন। কিন্তু মাছ তেমন পাওয়া যায় না। মহিমা বললেন, তিনিও ত্রাণ পাননি।

নয় সন্তানের জননী নূর-এ-মদিনা। তিনিও কোনো ত্রাণ পাননি। ছবিটি গত রোববার টাঙ্গুয়ার হাওরের জয়পুর নয়াআঁটি থেকে তোলা। ছবি: আসাদুজ্জামানএকদিকে এঁদের ভাগ্যে জোটেনি সরকারি কোনো সহযোগিতা, আবার অন্যদিকে তাঁদের রোজগার কম। এমন অনেক পরিবার দেখা গেল, ঘরে চাল নেই। স্বামী কাজে গেছেন। স্ত্রী স্বামীর ফেরার অপেক্ষায় বসে থাকেন। কখন আনবেন চাল? আর যদি জালে মাছ না ধরা পড়ে, তাহলে খালি হাতে ফিরে আসেন। কেবলই তাঁরা খাচ্ছেন আলু, শুঁটকি আর আটার রুটি। এমন অনেক নারীর দেখা মিলেছে, যাঁদের কোলে দুধের শিশু। অথচ দিনের পর দিন কেবলই আটা আর মরিচভর্তা খেয়ে দিন পার করছেন। অথচ এঁরা ত্রাণ পাননি।

হতদরিদ্র রেহানার পরিবার কেন ভিজিএফ পায়নি—জানতে চাওয়া হলে তাহিরপুরের উত্তর শ্রীপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান খসরুল আলম প্রথমে দাবি করেন, ইউপি সদস্যরা তালিকা করেন। তাঁদের তালিকা অনুযায়ী দেওয়া হচ্ছে ত্রাণ। রেহানা যদি তাঁর কষ্টে থাকার কথা জানাতেন, তাহলে তিনি অবশ্যই ভিজিএফ কার্ডের ব্যবস্থা করতেন।

আমেনাসহ আরও একটি গ্রামের হতদরিদ্র পরিবারের ভিজিএফ কার্ড না পাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করলেন তাহিরপুরের দক্ষিণ শ্রীপুরের ইউপির চেয়ারম্যান বিশ্বজিৎ সরকার। তাঁর ভাষ্য, ইউপি সদস্যের তালিকা অনুযায়ী ত্রাণ দেওয়া হয়। মহিমার বিষয়ে শাল্লার আটগাঁও ইউপির চেয়ারম্যান আবুল কাশেম আজাদ বলেন, এলাকার সব হতদরিদ্রকে তাঁর একার পক্ষে চেনা সম্ভব নয়। মালেকের ব্যাপারে জানতে চাইলে চরনারচর ইউপির চেয়ারম্যানের মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া গেছে।

সাত সন্তানের জননী আমেনা খাতুনও কোনো ত্রাণ পাননি। ছবিটি রোববার তাহিরপুরের উমেদপুর গ্রাম থেকে তোলা। ছবি: আসাদুজ্জামান

স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ভাষ্য, ক্ষতিগ্রস্ত লোকের চেয়ে ভিজিএফ কার্ডের সংখ্যা কম হওয়ায় সব গরিব মানুষকে তাঁদের পক্ষে ত্রাণ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে তাহিরপুরের একজন চেয়ারম্যান অভিযোগের ভিত্তিতে ৩০টি ভিজিএফ কার্ড আটক রেখেছেন। অভিযোগ, যাঁরা পেয়েছেন, তাঁরা হতদরিদ্র নন। আর স্থানীয় সাংসদ মোয়াজ্জেম হোসেন রতন বললেন, কারা ত্রাণ পাবেন, তা ঠিক করেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। অনেকে হতদরিদ্র ব্যক্তিদের না দিয়ে নিজেদের আত্মীয়স্বজনদের ত্রাণ দিচ্ছেন।

হাওর অঞ্চলে ঘুরে দেখা গেল, ঘরে ঘরে হাহাকার। কাজ নেই। হতদরিদ্র ব্যক্তিদের অনেকে তিনবেলা খেতে পাচ্ছেন না। আটার রুটি, পান্তাভাত, আলু, মরিচ ও শুঁটকিভর্তা দিয়ে খেয়ে দিন কাটছে। পুষ্টিকর খাবার পাচ্ছে না শিশুরা।

এলাকার লোকজন, স্থানীয় সাংসদ, ইউপির চেয়ারম্যানসহ সবাই বলছেন, হাওরের লোকজন যেভাবে দিন কাটাচ্ছেন, তা অনেক কষ্টের। মানুষের মধ্যে বিরাজ করছে চরম হতাশা। দেখা যাচ্ছে, ঘরে চাল নেই, কাজ নেই, কীভাবে চলবেন, কীভাবে সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দেবেন—এ নিয়ে সবাই দিশেহারা। আগামী ফসল না ওঠা পর্যন্ত সরকারি সহায়তার আওতায় সব মানুষ আনতে হবে। তা না হলে সামনের দিনগুলোয় আর তাঁদের পক্ষে সংসার চালানো সম্ভব হবে না।

জেলা প্রশাসক মো. সাবিরুল ইসলামকে এ ব্যাপারে জানানো হলে হাওর বার্তাকে তিনি বলেন, আজ মঙ্গলবার থেকে ১৫ দিনের জন্য ওএমএস চালু হচ্ছে। আগামী অক্টোবর পর্যন্ত ভিজিএফ চালু থাকবে। যেসব এলাকার হতদরিদ্র ব্যক্তিরা ভিজিএফ ত্রাণের আওতায় আসেননি, তাঁদের এর আওতায় আনা হবে।

ছোট্ট শিশু প্রিয়াঙ্কা। তার বাবা কালু সরকার। এই পরিবারটি কোনো ত্রাণ পায়নি। ছবিটি গত রোববার তাহিরপুর উপজেলার উমেদপুর পূর্বআঁটি থেকে তোলা। ছবি: আসাদুজ্জামানভিজিএফের আওতার বাইরে বহু লোক, তাঁদের সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন, তা জেলা প্রশাসক নিজেই বলেন। জানান, সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে তিনি চিঠিও দিয়েছেন। সুনামগঞ্জের হাওর অঞ্চলের হাহাকারের এই খবর জানানো হয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব শাহ কামালকে। সরকারি সহায়তার বাইরে থাকা লোকদের কীভাবে এর আওতায় আনা যায়, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন, জেলা প্রশাসক যদি এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠান, তিনি তা উপস্থাপন করবেন। আর ত্রাণ বিতরণের অনিয়মের বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন বলে হাওর বার্তাকে জানান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) মো. রিয়াজ আহমেদ।

সরকারি সহায়তা হাওরের প্রত্যন্ত অঞ্চলের এসব মানুষের একেবার দোরগোড়ায় নেওয়ার ‘হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও’ আন্দোলনের আহ্বায়ক বজলুল মজিদ চৌধুরীর ভাষ্য, সরকারকে আগামী মার্চ মাস পর্যন্ত ওএমএস, ভিজিএফসহ বিভিন্ন কর্মসূচি অব্যাহত রাখতে হবে। তা হতে হবে একেবারই ওয়ার্ডভিত্তিক। যদি না হয়, তাহলে দু-এক মাসের মধ্যে পরিস্থিতির চরম অবনতি হবে।

ত্রাণ পাননি জমিলাও। ছবিটি শনিবার শাল্লার উজানগাঁও গ্রাম থেকে তোলা। ছবি: আসাদুজ্জামানহতদরিদ্রদের জন্য সরকারের নেওয়া ওএমএস, ভিজিএফসহ বিভিন্ন কর্মসূচিকে এক পদ্ধতিতে আনার পরামর্শ দিয়েছেন ব্র্যাকের দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিভাগের পরিচালক গওহর নঈম ওয়ারা। তাঁর মতে, সরকার যে এত কর্মসূচি নিয়েছে, তার প্রয়োজন নেই। হাওরের এসব অঞ্চলে পূর্ণাঙ্গ রেশনিং ব্যবস্থা চালু করতে হবে, ভারতের পশ্চিম বাংলায়ও যা চালু। একেবারই যাঁরা দরিদ্র, যাঁদের জমি নেই, দিনমজুর, তাঁদের জন্য একধরনের কার্ড বানাতে হবে। তাঁদের সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দিতে হবে, যা আগামী মার্চ পর্যন্ত চালু রাখতে হবে। এঁদের থেকে যাঁদের অবস্থা একটু ভালো, তাঁদের জন্য আরেক কার্ড। নামমাত্র টাকা নিয়ে তাঁদের নিতে হবে। রেশন দোকান খুলতে হবে ইউনিয়ন পর্যায়ে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

হাওরের হাহাকারে ত্রাণ পাচ্ছেন না অনেকে

আপডেট টাইম : ০৫:১২:৫৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৮ অগাস্ট ২০১৭

হাওর বার্তা ডেস্কঃ ৪০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে শণের ঘর তোলেন রেহানা বেগম। মাস দুয়েক আগে হাওরের ঢেউ কেড়ে নিয়েছে তাঁর সেই ঘর। অন্যের ঘরে এখন তাঁর বাস। কোলে আছে সাত মাস বয়সী দুধের শিশু। অপর পাঁচ সন্তানের মধ্যে দুই কিশোরী মেয়েকে কাজের জন্য পাঠিয়েছেন ঢাকায়। গত সাত দিন শুধু আটার রুটি খেয়ে কেটেছে তাঁর। অথচ ঘরহারা রেহানা পাননি কোনো ত্রাণ। তাঁর গ্রামের নাম জয়পুর নয়াআঁটি। এটি সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার উত্তর শ্রীপুর ইউনিয়নের একটি গ্রাম।

রেহানার মতো সুনামগঞ্জের তাহিরপুর, শাল্লা ও দিরাই উপজেলার অনেক হতদরিদ্র পরিবারের মানুষের খোঁজ মিলেছে, যাঁরা ত্রাণ পাওয়ার যোগ্য, কিন্তু ত্রাণ পাননি। গত তিন দিনে উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামগুলো ঘুরে মিলেছে এই চিত্র। ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাতর এসব মানুষের অভিযোগ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অনেকে তাঁদের পছন্দের লোকদের ত্রাণ দিয়েছেন।

সাধারণত হাওর অঞ্চলে বৈশাখ মাসে ঘরে ধান তোলেন কৃষক। যে পরিমাণ ধান হাওরে হয়, তাতে অধিকাংশ লোকের চাল কেনা লাগে না। ধানের সময় এখানকার দরিদ্র মানুষেরাও দিনমজুরি করে ভালো আয় করে। আর বর্ষার সময় হাওরে নির্দিষ্ট অঞ্চলে মাছ ধরে মোটামুটিভাবে চলে তাঁদের জীবন। কিন্তু গত চৈত্র মাসে পাহাড়ি ঢলে বাঁধ ভেঙে ১ লাখ ৬৬ হাজার ৬১২ হেক্টর জমির ধান তলিয়ে যায়। বর্গাচাষিদের প্রায় সবাই স্থানীয় মহাজন আর বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে ধানের আবাদ করেন। হাওরের ধান তলিয়ে যাওয়ার পর থেকে এলাকায় মানুষের মধ্যে অভাব বাড়তে থাকে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক পরিবারের সংখ্যা ৩ লাখ ২৫ হাজার ৯৯০।

হাওরের ঢেউ নিয়ে গেছে রেহানার ঘর। তিনি সরকারি ত্রাণ পাননি। ছবিটি রোববার সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার জয়পুর নতুন হাঁটি থেকে তোলা। ছবি: আসাদুজ্জামান

এর মধ্যে সরকার ১ লাখ ৬৮ হাজার পরিবারকে ভিজিএফ দিচ্ছে। অর্থাৎ, এসব পরিবার প্রতি মাসে ৩০ কেজি চাল আর ৫০০ টাকা আর্থিক সহায়তা পাচ্ছে। জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা ক্ষতিগ্রস্ত হতদরিদ্র পরিবারের তালিকা করেন।

তাহিরপুরের উমেদপুর নয়াআঁটি গ্রামের বাসিন্দা আমেনা খাতুন। স্বামী আলী নূর। ৩৫ বছরের এই নারীর ছেলেমেয়ে সাতজন। চারজন ছেলে আর মেয়ে তিনজন। সবার ছোট ইব্রাহীম হাসান। বয়স এখন সাত মাস। তাঁর ভাষ্য, তিনবেলা তিন মুঠো ভাত ছেলেমেয়েদের মুখে তুলে দিতে পারছেন না। আটার রুটিই বেশির ভাগ খেতে দিচ্ছেন। স্বামী আলী নূরে হাওরে মাছ ধরেন। কিন্তু আয় হয় ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। তিনিও ভিজিএফ পাননি।

আবদুল মালেকের বাড়ি নুনুয়ার চরে। বয়স ৬০ বছর। তাঁর গ্রামের নাম নুনুয়ার চর। ইউনিয়নের নাম চরনারচর। উপজেলা দিরাই। তিনি এক লাখ টাকা ঋণ করে গত বছরে মেয়েকে বিয়ে দেন। ধান লাগানোর সময় স্থানীয় এক মহাজনের কাছ থেকে নেন আরও ৫০ হাজার টাকা। ঋণগ্রস্ত মালেকের দুই ছেলে আর দুই মেয়ে। হতদরিদ্র এই মানুষটিও জানালেন, তিনি সরকারের কোনো ত্রাণ পাননি। যাঁদের ত্রাণ পাওয়ার কথা নয়, তাঁরাই পেয়েছেন বেশি।

মহিমার বয়স ৫০ বছর। ২০ বছর আগে তাঁর স্বামী জনমত আলী তিন ছেলে রেখে মারা গেছেন। স্বামীকে হারিয়ে অনেক কষ্টে তিন ছেলেকে মানুষ করেছেন। এখন ছেলেরা হাওরে মাছ ধরেন। কিন্তু মাছ তেমন পাওয়া যায় না। মহিমা বললেন, তিনিও ত্রাণ পাননি।

নয় সন্তানের জননী নূর-এ-মদিনা। তিনিও কোনো ত্রাণ পাননি। ছবিটি গত রোববার টাঙ্গুয়ার হাওরের জয়পুর নয়াআঁটি থেকে তোলা। ছবি: আসাদুজ্জামানএকদিকে এঁদের ভাগ্যে জোটেনি সরকারি কোনো সহযোগিতা, আবার অন্যদিকে তাঁদের রোজগার কম। এমন অনেক পরিবার দেখা গেল, ঘরে চাল নেই। স্বামী কাজে গেছেন। স্ত্রী স্বামীর ফেরার অপেক্ষায় বসে থাকেন। কখন আনবেন চাল? আর যদি জালে মাছ না ধরা পড়ে, তাহলে খালি হাতে ফিরে আসেন। কেবলই তাঁরা খাচ্ছেন আলু, শুঁটকি আর আটার রুটি। এমন অনেক নারীর দেখা মিলেছে, যাঁদের কোলে দুধের শিশু। অথচ দিনের পর দিন কেবলই আটা আর মরিচভর্তা খেয়ে দিন পার করছেন। অথচ এঁরা ত্রাণ পাননি।

হতদরিদ্র রেহানার পরিবার কেন ভিজিএফ পায়নি—জানতে চাওয়া হলে তাহিরপুরের উত্তর শ্রীপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান খসরুল আলম প্রথমে দাবি করেন, ইউপি সদস্যরা তালিকা করেন। তাঁদের তালিকা অনুযায়ী দেওয়া হচ্ছে ত্রাণ। রেহানা যদি তাঁর কষ্টে থাকার কথা জানাতেন, তাহলে তিনি অবশ্যই ভিজিএফ কার্ডের ব্যবস্থা করতেন।

আমেনাসহ আরও একটি গ্রামের হতদরিদ্র পরিবারের ভিজিএফ কার্ড না পাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করলেন তাহিরপুরের দক্ষিণ শ্রীপুরের ইউপির চেয়ারম্যান বিশ্বজিৎ সরকার। তাঁর ভাষ্য, ইউপি সদস্যের তালিকা অনুযায়ী ত্রাণ দেওয়া হয়। মহিমার বিষয়ে শাল্লার আটগাঁও ইউপির চেয়ারম্যান আবুল কাশেম আজাদ বলেন, এলাকার সব হতদরিদ্রকে তাঁর একার পক্ষে চেনা সম্ভব নয়। মালেকের ব্যাপারে জানতে চাইলে চরনারচর ইউপির চেয়ারম্যানের মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া গেছে।

সাত সন্তানের জননী আমেনা খাতুনও কোনো ত্রাণ পাননি। ছবিটি রোববার তাহিরপুরের উমেদপুর গ্রাম থেকে তোলা। ছবি: আসাদুজ্জামান

স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ভাষ্য, ক্ষতিগ্রস্ত লোকের চেয়ে ভিজিএফ কার্ডের সংখ্যা কম হওয়ায় সব গরিব মানুষকে তাঁদের পক্ষে ত্রাণ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে তাহিরপুরের একজন চেয়ারম্যান অভিযোগের ভিত্তিতে ৩০টি ভিজিএফ কার্ড আটক রেখেছেন। অভিযোগ, যাঁরা পেয়েছেন, তাঁরা হতদরিদ্র নন। আর স্থানীয় সাংসদ মোয়াজ্জেম হোসেন রতন বললেন, কারা ত্রাণ পাবেন, তা ঠিক করেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। অনেকে হতদরিদ্র ব্যক্তিদের না দিয়ে নিজেদের আত্মীয়স্বজনদের ত্রাণ দিচ্ছেন।

হাওর অঞ্চলে ঘুরে দেখা গেল, ঘরে ঘরে হাহাকার। কাজ নেই। হতদরিদ্র ব্যক্তিদের অনেকে তিনবেলা খেতে পাচ্ছেন না। আটার রুটি, পান্তাভাত, আলু, মরিচ ও শুঁটকিভর্তা দিয়ে খেয়ে দিন কাটছে। পুষ্টিকর খাবার পাচ্ছে না শিশুরা।

এলাকার লোকজন, স্থানীয় সাংসদ, ইউপির চেয়ারম্যানসহ সবাই বলছেন, হাওরের লোকজন যেভাবে দিন কাটাচ্ছেন, তা অনেক কষ্টের। মানুষের মধ্যে বিরাজ করছে চরম হতাশা। দেখা যাচ্ছে, ঘরে চাল নেই, কাজ নেই, কীভাবে চলবেন, কীভাবে সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দেবেন—এ নিয়ে সবাই দিশেহারা। আগামী ফসল না ওঠা পর্যন্ত সরকারি সহায়তার আওতায় সব মানুষ আনতে হবে। তা না হলে সামনের দিনগুলোয় আর তাঁদের পক্ষে সংসার চালানো সম্ভব হবে না।

জেলা প্রশাসক মো. সাবিরুল ইসলামকে এ ব্যাপারে জানানো হলে হাওর বার্তাকে তিনি বলেন, আজ মঙ্গলবার থেকে ১৫ দিনের জন্য ওএমএস চালু হচ্ছে। আগামী অক্টোবর পর্যন্ত ভিজিএফ চালু থাকবে। যেসব এলাকার হতদরিদ্র ব্যক্তিরা ভিজিএফ ত্রাণের আওতায় আসেননি, তাঁদের এর আওতায় আনা হবে।

ছোট্ট শিশু প্রিয়াঙ্কা। তার বাবা কালু সরকার। এই পরিবারটি কোনো ত্রাণ পায়নি। ছবিটি গত রোববার তাহিরপুর উপজেলার উমেদপুর পূর্বআঁটি থেকে তোলা। ছবি: আসাদুজ্জামানভিজিএফের আওতার বাইরে বহু লোক, তাঁদের সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন, তা জেলা প্রশাসক নিজেই বলেন। জানান, সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে তিনি চিঠিও দিয়েছেন। সুনামগঞ্জের হাওর অঞ্চলের হাহাকারের এই খবর জানানো হয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব শাহ কামালকে। সরকারি সহায়তার বাইরে থাকা লোকদের কীভাবে এর আওতায় আনা যায়, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন, জেলা প্রশাসক যদি এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠান, তিনি তা উপস্থাপন করবেন। আর ত্রাণ বিতরণের অনিয়মের বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন বলে হাওর বার্তাকে জানান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) মো. রিয়াজ আহমেদ।

সরকারি সহায়তা হাওরের প্রত্যন্ত অঞ্চলের এসব মানুষের একেবার দোরগোড়ায় নেওয়ার ‘হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও’ আন্দোলনের আহ্বায়ক বজলুল মজিদ চৌধুরীর ভাষ্য, সরকারকে আগামী মার্চ মাস পর্যন্ত ওএমএস, ভিজিএফসহ বিভিন্ন কর্মসূচি অব্যাহত রাখতে হবে। তা হতে হবে একেবারই ওয়ার্ডভিত্তিক। যদি না হয়, তাহলে দু-এক মাসের মধ্যে পরিস্থিতির চরম অবনতি হবে।

ত্রাণ পাননি জমিলাও। ছবিটি শনিবার শাল্লার উজানগাঁও গ্রাম থেকে তোলা। ছবি: আসাদুজ্জামানহতদরিদ্রদের জন্য সরকারের নেওয়া ওএমএস, ভিজিএফসহ বিভিন্ন কর্মসূচিকে এক পদ্ধতিতে আনার পরামর্শ দিয়েছেন ব্র্যাকের দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিভাগের পরিচালক গওহর নঈম ওয়ারা। তাঁর মতে, সরকার যে এত কর্মসূচি নিয়েছে, তার প্রয়োজন নেই। হাওরের এসব অঞ্চলে পূর্ণাঙ্গ রেশনিং ব্যবস্থা চালু করতে হবে, ভারতের পশ্চিম বাংলায়ও যা চালু। একেবারই যাঁরা দরিদ্র, যাঁদের জমি নেই, দিনমজুর, তাঁদের জন্য একধরনের কার্ড বানাতে হবে। তাঁদের সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দিতে হবে, যা আগামী মার্চ পর্যন্ত চালু রাখতে হবে। এঁদের থেকে যাঁদের অবস্থা একটু ভালো, তাঁদের জন্য আরেক কার্ড। নামমাত্র টাকা নিয়ে তাঁদের নিতে হবে। রেশন দোকান খুলতে হবে ইউনিয়ন পর্যায়ে।