এ বছর উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) ও সমমানের পরীক্ষায় আটটি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের ফল বিপর্যয়ের ধারাবাহিকতা রাজধানীর নামিদামি কলেজগুলোতেও পড়েছে। এবার র্যাংকিং ব্যবস্থা না থাকায় কলেজগুলোর তুলনা করার সুযোগ নেই। তবে গত বছরের দেশসেরা হিসেবে পরিচিত রাজউক উত্তরা মডেল কলেজেও এবার জিপিএ ৫ কমেছে, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে এবার পাসের হার ৯৯ দশমিক ৪ শতাংশ, নটর ডেমে পাসের হার ও জিপিএ ৫ দুটোই কমেছে এবং মতিঝিল আইডিয়ালে স্মরণকালের ভয়াবহ ফল বিপর্যয় ঘটেছে।
গত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় এবারের ফল কিছুটা খারাপ হলেও আনন্দ-উল্লাসের কমতি ছিল না রাজধানীর সেরা এই চার কলেজে। ফল হাতে পাওয়ার পরই উল্লাসে ফেটে পড়েন শিক্ষার্থীরা। কেউ গানের তালে তালে নাচতে থাকেন, কেউ বা বন্ধু ও আপনজনকে জড়িয়ে ধরেন। আনন্দে অনেকের চোখে পানিও চলে আসে। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি আনন্দ-উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠেন শিক্ষক-অভিভাবকরাও। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সারাদেশের তুলনায় রাজধানীর প্রতিষ্ঠানগুলোতেই জিপিএ ৫ ও পাসের হার বেশি।রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ :রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ থেকে এক হাজার ২১৬ শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নেয়। পাস করেছেন এক হাজার ২১৩ জন। পাসের হার ৯৯ দশমিক ৮ শতাংশ। জিপিএ ৫ পেয়েছেন ৭২২ জন। এটা মোট পরীক্ষার্থীর প্রায় ৬০ শতাংশ। বিজ্ঞান বিভাগে ৭৪৬ পরীক্ষার্থীর ৫৬০ জন পেয়েছেন পূর্ণ জিপিএ। বাণিজ্যিক শিক্ষায় এ সংখ্যা ৩৬২ জনে ১৩৩।
মানবিক শাখায় জিপিএ ৫ পেয়েছেন ১০৮ পরীক্ষার্থীর ২৯ জন। ফল ঘোষণা করে রাজউক কলেজের জ্যেষ্ঠ উপাধ্যক্ষ আমিনুর রহমান খান বলেন, ‘সারাদেশে ফল বিপর্যয় ঘটেছে। সে তুলনায় খুবই ভালো করেছে রাজউক। এবার সেরা প্রতিষ্ঠান নির্বাচন করা না হলেও ফলাফল বলছে, আমরাই সেরা।’
গত বছর রাজউকের ৭৮ শতাংশ পরীক্ষার্থী পূর্ণ জিপিএ পেয়েছিল। এ বছর তা কমে যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে আমানুর রহমান বলেন, ‘পরীক্ষার সময় সারাদেশে একটি অস্বস্তিকর পরিস্থিতি ছিল। বারবার পরীক্ষার তারিখ বদল হয়েছে। হরতাল-অবরোধের কারণে কয়েক ঘণ্টার নোটিশেও পরীক্ষা স্থগিতের ঘটনা ঘটেছে।’ জিপিএ ৫ কমে যাওয়ায় ফল প্রকাশের পর রাজউক কলেজ প্রাঙ্গণে হাসি-কান্না দুই-ই ছিল। যারা জিপিএ ৫ পেয়েছেন, তারা ভেসেছেন আনন্দে। লাউড স্পিকারে গান বাজিয়ে তারা তালে নেচে-গেয়ে উল্লাস প্রকাশ করেছেন। আর যারা জিপিএ ৫ পাননি, তারা ছিলেন অশ্রুসিক্ত। তাদের জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন জিপিএ ৫ পাওয়া বন্ধুরাই।
মানবিকের শিক্ষার্থী মিথিলা জিপিএ ৫ না পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। কথা বলতেই রাজি হলেন না। শুধু বললেন, ‘পরীক্ষা এত খারাপ হয়নি যে ৪.৬০ জিপিএ পাব।’ প্রত্যাশামাফিক ফল করা বন্ধুরা সান্ত্বনা দিচ্ছে মিথিলাকে। বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী ফারজানা আফরিন হ্যাপি, অভিজিৎ দাস ও সেঁজুতি বণিক পূর্ণ জিপিএ পেয়ে জানান, পরিশ্রমের ফল পেয়েছেন। কিন্তু এখন ভয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা। গত বছরে জিপিএ ৫ পেয়ে ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করেছেন প্রায় ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী। তাই ভালো ফলও স্বস্তি দিচ্ছে না।
ভিকারুননিসায় পাসের হার ৯৯ দশমিক ৪ শতাংশ: চলতি বছর এইচএসসি পরীক্ষায় রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এক হাজার ৪৪১ শিক্ষার্থী অংশ নেন। এর মধ্যে কৃতকার্য হয়েছেন এক হাজার ৪৩৭ জন। পাসের হার ৯৯ দশমিক ৪ শতাংশ। জিপিএ ৫ পেয়েছেন ৯৩৩ শিক্ষার্থী। বিজ্ঞানে ৯৮১ পরীক্ষার্থীর মধ্যে ৮৩৩ জন, ব্যবসায় শিক্ষায় ২৯২ জনের মধ্যে ৭৬ জন ও মানবিকে ১৬৯ জনের মধ্যে ২৪ জন জিপিএ ৫ পেয়েছেন। মানবিকে চারজন ও বিজ্ঞানে দুই শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছেন।
গত বছর প্রকাশিত ফলে ৯৩ দশমিক শূন্য ৯ পয়েন্ট নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি ঢাকা বোর্ডে পঞ্চম ও সারাদেশে সপ্তম স্থান অর্জন করেছিল। তবে এবার র্যাংকিং না থাকায় ফল নিয়ে খুশি প্রতিষ্ঠানটি। কলেজের অধ্যক্ষ মোছা. সুফিয়া খাতুন বলেন, ভালো প্রতিষ্ঠানগুলোতে অনেক শিক্ষার্থী পরীক্ষা দেয়। এর মধ্যে একজন অকৃতকার্য হলেই ওই প্রতিষ্ঠান র্যাংকিংয়ে পিছিয়ে পড়ে। তিনি বলেন, এবারের পরীক্ষায় সারাদেশে পাসের হার কমলেও ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে পাসের হার বেড়েছে। তবে রাজনৈতিক অস্থিরতা সার্বিক ফলে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ফৌজিয়া মাহবুব বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ ৫ পেয়েছেন। উচ্ছ্বসিত এ শিক্ষার্থী সমকালকে বলেন, জিপিএ ৫ পেয়ে আমরা সবাই অনেক আনন্দিত। শিক্ষক ও বাবা-মায়ের পরিশ্রমের কারণেই এ ফল সম্ভব হয়েছে। পড়ালেখা শেষে প্রকৌশলী হতে চাই। তার মা শামীমা আক্তার বলেন, বাসায় অভিভাবকরা সচেতন থাকলে সন্তানরা ভালো ফল করে।
নটর ডেমে পাসের হার ও জিপিএ ৫ কমেছে: এ বছর কলেজ থেকে দুই হাজার ৫৬৫ পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাস করেছে দুই হাজার ৫৪৪ জন। অকৃতকার্য হয়েছেন ২১ জন। পাসের হার ৯৯ দশমিক ১৮ শতাংশ। গত বছর পাসের হার ছিল ৯৯ দশমিক ৮৫ শতাংশ। এ বছর জিপিএ ৫ পেয়েছেন এক হাজার ৬৩৭ জন। গত বছর ছিল দুই হাজার ৪৪ জন।
পরীক্ষার ফলে কলেজের অধ্যক্ষ ড. হেমন্ত পিউস রোজারিও সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তিনি সমকালকে বলেন, কয়েকজন পরীক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেনি। কয়েকজন ছাত্র অসুস্থ থাকায় তাদের পরীক্ষাও খারাপ হয়েছিল। এতে পরীক্ষার ফলে কিছুটা প্রভাব পড়েছে। এ বছর থেকে কলেজগুলোর র্যাংকিং ব্যবস্থা না থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ ব্যবস্থা না থাকায় ভালো হয়েছে। কলেজগুলোর মধ্যে প্রথম হওয়া নিয়ে অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলে। এখন কলেজগুলো পাঠদান ও জ্ঞানার্জনের দিকে নজর দেবে।
নটর ডেম কলেজের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এক হাজার ৪৯১ পরীক্ষার্থীর মধ্যে জিপিএ ৫ পেয়েছেন এক হাজার ৩৪৫ জন এবং অকৃতকার্য হয়েছেন একজন। মানবিক বিভাগ থেকে ৩৯৩ জনের মধ্যে জিপিএ ৫ পেয়েছেন ১৪ জন, অকৃতকার্য হয়েছেন ১৪ জন। ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ থেকে ৬৮৪ জনের মধ্যে জিপিএ ৫ পেয়েছেন ২৬৯ জন, অকৃতকার্য হয়েছেন পাঁচজন।
মতিঝিল আইডিয়ালে স্মরণকালে ফল বিপর্যয়: রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল কলেজে স্মরণকালের ফল বিপর্যয় হয়েছে। এবার ২৫ শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছেন। গত বছর এ সংখ্যা ছিল মাত্র দু’জন। এ বছর তিন বিভাগ থেকে মোট এক হাজার ৮৪ শিক্ষার্থী অংশ নেন। এর মধ্যে কৃতকার্য হয়েছেন এক হাজার ৫৯ জন। বিজ্ঞান বিভাগ থেকে ৬২৪ জন, বাণিজ্য বিভাগ থেকে ৩০৪ ও মানবিক বিভাগ থেকে ১৫৬ পরীক্ষার্থী অংশ নিয়েছিলেন। মানবিক বিভাগ থেকে ১৮, বিজ্ঞান বিভাগের দু’জন ও বাণিজ্য বিভাগের তিন পরীক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছেন। তবে প্রতিষ্ঠানটির পাসের হার ৯৭ দশমিক ৯৭ ভাগ, যা গত বছর ছিল ৯৯ দশমিক ৮৩ ভাগ।
প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আবদুস সালাম খান বলেন, গত বছরের তুলনায় এবার ফল একটু খারাপ হয়েছে। এর কারণ খতিয়ে দেখা হবে। মানবিকে শিক্ষার্থীরা সৃজনশীল প্রশ্ন ভালোভাবে বুঝতে না পারায় বেশি ফল বিপর্যয়। ২০১৪ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় মতিঝিল আইডিয়াল কলেজ থেকে এক হাজার ১৫৪ পরীক্ষার্থী অংশ নিয়েছিল। এদের মধ্যে বিজ্ঞান বিভাগ ও ব্যবসা শিক্ষা অনুষদ থেকে শতভাগ কৃতকার্য হয়। আর মানবিক বিভাগ থেকে ২০০ শিক্ষার্থীর মধ্যে ১৯৮ জন পরীক্ষায় অংশ নিয়ে সবাই কৃতকার্য হয়েছিল।