হাওর বার্তা ডেস্কঃ রাজধানীর একটি সরকারি কলেজের লেকচারার রাজিয়া খানমের কাছে হঠাৎ একটি অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন আসে। তিনি যে মোবাইল অপারেটরের সিম ব্যবহার করেন সেই একই অপারেটরের নম্বর।
ফোনের ওপাশ থেকে বলা হয়, ‘আমি কাস্টমার সার্ভিস থেকে বলছি। আপনার জন্য একটি সুখবর আছে। আমরা বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশন করা সিমের মধ্য থেকে একটি লটারির আয়োজন করেছি এবং আপনার নম্বরটি প্রথম পুরষ্কার হিসেবে ২১ লাখ টাকা জিতেছে।
রাজিয়া বিরক্ত হন এসব শুনে। কেননা, তিনি দেশের খবরাখবর ভালোই রাখেন। এরকম অনেক ভুয়া লটারির খবর তিনি ইন্টারনেটে পড়েছেন। সহকর্মীদের কাছেও শুনেছেন। কাজেই ফোন কেটে দেওয়ার কথা ভাবছিলেন। কিন্তু থেমে গেলেন পরের কথাগুলো শুনে।
ওপাশ থেকে বলতে কেউ একজন বলতে থাকলেন, ‘আপনি নিশ্চয় গতকাল বিটিভিতে রাত ৮টার সংবাদের পর প্রচারিত অনুষ্ঠানটি দেখেছেন, ম্যাম। সেখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, যোগাযোগমন্ত্রী, আমাদের কোম্পানির সিইওসহ ৬৪ জেলার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। সেই অনুষ্ঠানেই লটারিটি অনুষ্ঠিত হয়।’
রাজিয়ার বিটিভি দেখা হয় না বললেই চলে। তিনি চিন্তায় পড়ে গেলেন। শুধু বললেন, ‘না, আমি দেখিনি। কিন্তু এটার প্রুফ কী?’ তখন তাকে জানানো হলো, অল্প সময়ের মধ্যেই কাস্টমার সার্ভিস থেকে একটি কনফার্মেশন এসএমএস আসবে। সেখানে প্রদত্ত ইন্সট্রাকশন ফলো করতে হবে। এরপর কাস্টমার ইনফরমেশন ভেরিফাই করার কথা বলে জেনে নেওয়া হয়, রাজিয়ার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক তথ্য। কিছুক্ষণ পর সত্যিই মোবাইল অপারেটরের নম্বর থেকে একটি কনফার্মেশন এসএমএস আসে। এরপর ফের ফোন আসে রাজিয়ার নম্বরে। বলা হয়, লটারি উইনার সিম হিসেবে সিমটি ফের রেজিস্ট্রেশন করতে হবে, যেটির ফি বাবদ ৩,৫০০ টাকা প্রদান করতে হবে। দেওয়া হয় একটি বিকাশ নম্বর। রাজিয়া কিছুটা সন্দেহ আর কৌতুহল নিয়ে বিকাশের মাধ্যমে টাকা পাঠিয়ে দেন।
দুইদিন পর Central Bank লেখা একটি নম্বর থেকে এসএমএস আসে রাজিয়ার নম্বরে, যেখানে লটারি জেতার জন্য অভিনন্দন জানিয়ে বলা হয়, লটারিতে জেতার টাকা প্রসেস করার জন্য কিছু ব্যাংকিং চার্জ আছে। এই চার্জ পরিশোধ করতে মোবাইল অপারেটরের নির্দেশনা অনুসরণ করতে হবে। পরে আবার সেই নম্বর থেকে ফোন আসে রাজিয়ার কাছে। বলা হয়, চার্জ বাবদ ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা বিকাশ করতে হবে।
রাজিয়া সেন্ট্রাল ব্যাংকের এসএমএস পাওয়ার পর বিশ্বাস করতে থাকেন লটারি জেতার বিষয়টি। তাই, চার্জ বাবদ টাকা পরিশোধ করে দেন দ্রুত। কয়েকদিন পর NBR লেখা নম্বর থেকে এসএমএস আসে সেখানেও একইভাবে অভিনন্দন জানিয়ে বলা হয়, এই সিমের জেতা অর্থের বিষয়ে সেন্ট্রাল ব্যাংকের এপ্রুভাল পাওয়া গেছে। তবে লটারিতে জেতা টাকার বিপরীতে ট্যাক্স পরিশোধ করতে হবে। এই ট্যাক্স পরিশোধ করতে মোবাইল অপারেটরের নির্দেশনা অনুসরণ করতে হবে। পরে আবার সেই নম্বর থেকে ফোন দিয়ে কিছু বিকাশ নম্বর ট্যাক্স বাবদ ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা পরিশোধ করতে বলা হয়। রাজিয়া আর অবিশ্বাসের কিছু দেখেন না। বিকাশে টাকা পাঠিয়ে দিলেন। এভাবে একের পর এক DUDOK, TnT, Parliament এরকম বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের নামে এসএমএস দিয়ে বিভিন্ন রকম ফি/চার্জ পরিশোধ করতে বলা হতে থাকে। প্রতিবারেই আগেরবারের সরকারি প্রতিষ্ঠানের এপ্রুভালের অথবা ক্লিয়ারেন্সের কথা উল্লেখ করা হয় এবং তার সঙ্গে বাড়তে থাকে টাকার অংকও। কিছুদিন যেতেই রাজিয়া বুঝতে পারেন, তিনি আসলে ডিজিটাল প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়েছেন। লটারির বিষয়টি মূলত ভুয়া। কিন্তু ততদিনে লটারিতে জেতা পুরষ্কারের লোভে প্রতারকদের হাতে তুলে দিয়েছেন সাড়ে সাত লক্ষ টাকা। আফসোস আর একরাশ হতাশা নিয়ে শেষ পর্যন্ত দ্বারস্থ হন পুলিশের।
ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে এ ধরনের বেশকিছু ডিজিটাল প্রতারণার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্তে নামে ডিএমপি’র কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগ। গত ১৭ জুলাই তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রাপ্ত তথ্যউপাত্ত বিশ্লেষণের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা করে ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা থানা এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় ডিজিটাল প্রতারক চক্রের তিন সদস্যকে। পরে তাদের স্বীকারোক্তির ওপর ভিত্তি করে অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা হয় আরো পাঁচজন প্রতারককে। গ্রেফতারকৃতরা হলো-মো. কামাল হোসেন, জাফর মুন্সি, মো. মিলন শিকদার, মো. আজিজুল হাকিম, তাপস সাহা, মানিক ওরফে বাবুল মুন্সী, মো. বকুল মুন্সী এবং ওলি মীর। এরা সবাই বিভিন্ন মোবাইল কোম্পানির কর্মকর্তা অথবা কাস্টমার সার্ভিসের পরিচয় দিয়ে সাধারণ মানুষকে নানা প্রলোভন দেখিয়ে বিশ্বাস অর্জন করে বিকাশের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিতেন।
কাউন্টার টেররিজম (সিটি) ইউনিট সূত্রে জানা যায়, গ্রেফতার প্রতারক চক্রের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। এরা সবাই ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা থানার ‘ওয়েলকাম’ নামক একটি প্রতিষ্ঠানের সদস্য। প্রতিষ্ঠানটির কাজই হচ্ছে এধরনের প্রতারণার মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নেওয়া। এজন্য তারা বিশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিভিন্ন মোবাইল অপারেটর ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের নামে ভুয়া এসএমএস পাঠাতেন, যাতে মানুষের মনে টাকা পাঠানোর ব্যাপারে কোনো সন্দেহের সৃষ্টি না হয়। টাকা সংগ্রহের জন্য তারা ব্যবহার করতেন ভিন্ন ভিন্ন বিকাশ নম্বর, যেগুলোর সবগুলোই ভুয়া রেজিস্ট্রেশন করা। টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পর তারা ব্যবহৃত মোবাইল ফোনসেট ও সিম দুটোই নষ্ট করে ফেলতেন যাতে কোনোভাবে তাদের শনাক্ত করা না যায়।
সিটি আরো জানায়, গ্রেফতারদের মধ্যে তিনজন ইতোমধ্যে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য ও তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে এই চক্রের বাকি সদস্যদের গ্রেফতারের অভিযান অব্যাহত আছে। একই সঙ্গে এধরনের ডিজিটাল প্রতারণার অন্য কোনো চক্র সক্রিয় আছে কিনা সেবিষয়েও কঠোর নজরদারি করা হচ্ছে।
সিটির সাইবার ক্রাইম ইউনিটের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার নাজমুল ইসলাম বলেন, মানুষজন যতই তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর হচ্ছেন ততই বাড়ছে এধরনের ডিজিটাল প্রতারণার সংখ্যা। প্রযুক্তির উৎকর্ষতার সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে প্রতারক চক্রের কাজের ধরন। সে কারণে সচেতন হতে হবে। নিশ্চিত না হয়ে অপরিচিত কারো কথায় আর্থিক লেনদেনের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে সব সময়।
যখনই এ ধরনের কোনো তথ্য আসবে, তখনই সংশ্লিষ্ট থানা-পুলিশকে অথবা গোয়েন্দা পুলিশকে বিষয়টি জানাতে হবে।