হাওর বার্তা ডেস্কঃ আদিবাসী জনগোষ্ঠীর কাছে কুচিয়া মাছ এক জনপ্রিয় খাবারের নাম। দেখতে সাপের মত হলেও এটি আসলে বাইম ও গুচি জাতীয় মাছ। যা খুবই পুষ্টিকর, সুস্বাদু ও ঔষধি গুণসম্পন্ন।
অতীতে বাংলাদেশের সর্বত্র কুচিয়ার প্রাপ্যতা ছিল। তবে সিলেট, ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল জেলার অগভীর বিল ও বোরো ধান ক্ষেতের আইলে, জলজ আাগাছার ঝোঁপ-ঝাঁড়ে কুচিয়া বেশি পাওয়া যেতো। কিন্তু বৈষ্ণিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বর্তমানে বাংলাদেশের জলাভূমিগুলোর জীববৈচিত্র, ইকোসিস্টেম, পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। এজন্য কুচিয়ার প্রাপ্যতা অপ্রতুল হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশ ছাড়া পাকিস্তান, নেপাল ও ভারতে কুচিয়া পাওয়া যায়। যা মূলত দুই ধরনের। দেশীয় কুচিয়া মাছের বৈজ্ঞানিক নাম ‘মনোপটেরাস কুচিয়া’ আর চীনসহ বিভিন্ন দেশে যে কুচিয়া মাছ পাওয়া যায় তার বৈজ্ঞনিক নাম ‘মনোপটেরাস এলভাস’। দেশীয় একটি কুচিয়ার ওজন সাধারণত ৩০০ থেকে ১৫০০ গ্রাম পর্যন্ত হয়। চায়না প্রজাতির ‘মনোপটেরাস এলভাস’ কুচিয়ার ওজন সাধারণত ১০০০ গ্রামের বেশি হয় না। ফলে বিদেশে বাংলাদেশি কুচিয়ার চাহিদা বেশি।
প্রতিবছর বাংলাদেশের বিভিন্ন খাল-বিল থেকে আহরিত কুচিয়া সাধারণত দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, লাওস, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ায় রপ্তানি হয়। পাশাপাশি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ময়মনসিংহ, শেরপুরের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রকৃতি থেকে প্রজননক্ষম মা কুচিয়া সংগ্রহ করে রপ্তানি করা হচ্ছে।
কুচিয়া মাছের প্রজনন:
কুচিয়া মাছের ডিমের সংখ্যা খুবই কম। কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে যে পরিমান পোনা পাওয়া যায় তা দিয়ে চাষের পোনার চাহিদা মেটানো সম্ভব নয়। তাই প্রাকৃতিক প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদনের পথ বেছে নিতে হবে।
পুরুষ ও স্ত্রী কুচিয়া চিহ্নিতকরণ:
পুরুষ: পেট গোলাকার, অপেক্ষাকৃত শক্ত। পায়ুপথ সামান্য লম্বা, লাললে বর্ণের। লেজ ছোট ও শরীরের রং উজ্জ্বল বাদামী।
স্ত্রী: পেট নরম ও গোলাকার। পায়ুপথ স্ফীত, গোলাকার, মাংশল ও গোলাপী বর্ণের। লেজ চ্যাপ্টা ও শরীরের রং তুলনামূলক ফ্যাকাশে।
কুচিয়ার আবাসস্থল নির্মাণ:
১. পুকুর পাড় বা খামারের উঁচু জায়গায় ৯.০মিx৩.০মিx০.৫মি আয়তনের একটি ডিচ নির্মাণ করতে হবে। ডিচের আয়তন অনুযায়ী ডিচের সমপরিমাণ সাইজের পলিথিন বিছিয়ে তার ওপর ত্রিপল বিছিয়ে দিতে হবে।
২. তলদেশের ১ম স্তর ১০ সে.মি ঘনত্বে কাঁদামাটি (এটেল ৮০% ও দোঁয়াশ ২০% মিশ্রিত), ২য় স্তর ১০ সে.মি ঘনত্বে চুন, গোবর, কচুরীপানা ও খড়মিশ্রিত কমপোস্ট, ৩য় স্তর ২ সে.মি ঘনত্বে সাত দিনের শুকনো কলাপাতা এবং উপরের ৪র্থ স্তর ১০ সে.মি ঘনত্বে কাঁদামাটি (এটেল ৮০% এবং দোঁয়াশ ২০% মিশ্রিত) দিয়ে স্তরে স্তরে সাজাতে হবে।
৩. ডিচের ভেতরের চারদিকে ৪০ সে.মি চওড়া ৮০% এটেল মাটি দিয়ে একটি পাড় নির্মাণ করতে হবে। নিরাপাদ আশ্রয়স্থল এবং তাপমাত্রা রোধ করার জন্য পাড়ের উপর নারিকেল গাছের পাতা দিয়ে ঢেকে দিতে হবে যেন পাড়টি উত্তপ্ত না হয়। লক্ষ্য রাখতে হবে যেন পাড়টি পানির স্তর থেকে সবসময় বেশি উচ্চতায় থাকে।
৩. ডিচে তেলাপিয়া বা কার্প জাতীয় মাছের পোনা ছেড়ে তিনদিন পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। মাছের পোনা মারা না গেলে বুঝতে হবে, ডিচটি কুচিয়া চাষের জন্য প্রস্তুত হয়েছে।
৪. উল্লিখিত সাইজের ডিচে ১৯০-২০০টি (২৫০-৪০০ গ্রাম) কুচিয়া (পুরুষ:স্ত্রী:১:২) অবমুক্ত করতে হবে।
৫. কুচিয়া সাধারণত বৈশাখ মাস থেকে শ্রাবণ মাস পর্যন্ত ডিম দিয়ে থাকে। তবে জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাস মূখ্য প্রজননকাল।
৬. ডিম দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডিমগেুলো সংগ্রহ করে একটি প্লাস্টিকের গামলাতে পানি দিয়ে অ্যারেটর সংযোগ দিতে হবে, যাতে পর্যাপ্ত পরিমাণ অক্সিজেন পায়।
৭. ডিম থেকে লার্ভিগুলো ক্রমান্বয়ে পরিস্ফুটন হতে তিন দিন পর্যন্ত সময় লাগে।
৮. লার্ভির ভেতরে ইয়োগ সেক শোষিত হতে নয় দিন লাগতে পারে।
৯. প্রথম খাবার হিসেবে প্রতি এক লক্ষ পোনার জন্য হাঁস বা মুরগীর একটি ডিমের কুসুম ব্যবহার করা যেতে পারে।
১০. দুই/তিন দিন পর খাবার হিসেবে প্রাণীজ কণা ময়না বা আর্টিমিয়া ব্যবহারের পাশাপাশি আস্তে আস্তে ৪০% আমিষযুক্ত খাবারে অভ্যস্ত করতে হবে।
চাষ পদ্ধতি:
কুচিয়া মাছ দুই পদ্ধতিতে চাষ করা যায়।
১. একুয়াকালচার পদ্ধতি
২. প্রাকৃতিক জলজ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি
একুয়াকালচার পদ্ধতি: এ পদ্ধতিটি প্রাকৃতিক প্রজনেন ব্যবহৃত ডিচের মত। ৯.০মিx৩.০মিx০.৫মি আয়তন বিশিষ্ট ডিচ নির্মাণ করে কুচিয়া মাছের পোনা ছাড়তে হবে। প্রতি বর্গমিটারে ৭০-৮০ গ্রাম ওজনের ১০০টি পোনা ছাড়তে হবে। পোনা ছাড়ার পূর্বে ডিচে তেলাপিয়া বা কার্প মাছের পোনা খাবার হিসেবে ছেড়ে প্রকৃতির ধান ক্ষেতের মত পরিবেশে সৃষ্টি করতে হবে। প্রতিদিন শারীরিক ওজনের ৫-৬% হারে ৪০% আমিষযুক্ত খাবার সরবরাহ করতে হবে।
প্রাকৃতিক জলজ সম্পদ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি: এ পদ্ধতিটি উত্তম। কারণ কুচিয়া মাছের ডিমের আকার বড় এবং সংখ্যায় কম। এমতাবস্থায় প্রাকৃতিক জলজ সম্পদকে কাজে লাগিয়ে এর ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ঘটাতে হবে। পাশাপাশি পোনা উৎপাদন এবং মাছ বড় করে বাজারজাত করার কৌশল অবলম্বন করতে হবে।
কুচিয়া মাছে আমিষের পরিমাণ বেশি থাকে। এছাড়া এ মাছ খেলে হজম শক্তি বাড়ে, ব্যাথানাশ হয়। কমে উচ্চরক্তচাপও। তাই বাজারের অন্যান্য সাধারণ মাছের তুলনায় এই মাছের দাম একটু বেশি।
আন্তর্জাতিক বাজারে কুচিয়া মাছের বিশাল চাহিদা রয়েছে। এই মাছ চাষ করে সহজে ভাগ্য বদলানোর পাশাপাশি বাড়বে রপ্তানী আয়ও।