ঢাকা ০৫:২৬ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

দক্ষ শিক্ষক সঙ্কট আর মুখস্থনির্ভরতাই কারণ

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০১:২৮:২৬ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৫ জুলাই ২০১৭
  • ৩৫৭ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ  দক্ষ শিক্ষক সঙ্কট ও প্রশিক্ষণের অভাব, মুখস্থনির্ভর শিক্ষা, কারিকুলাম অনুযায়ী পাঠদান ও মূল্যায়ন না হওয়াই এবারের উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) পরীক্ষায় ইংরেজি বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ। শিক্ষাবিদ, প্রধান পরীক্ষক ও ইংরেজি বিষয়ে অভিজ্ঞ কয়েকজন শিক্ষক গতকাল হাওর বার্তাকে  এমনটিই জানান। তাদের মতে, যোগাযোগধর্মী (কমিউনিকেটিভ) কারিকুলাম চালু করা হলেও তা এখনও কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। ফলে শিক্ষার্থীরা এখনও গতানুগতিক ধারায় মুখস্থনির্ভরই রয়ে গেছে। তাছাড়া এবার উত্তরপত্র মূল্যায়নে নতুন পদ্ধতিও ইংরেজি বিষয়ে পাসের হারে ধস নামিয়েছে। গত ২৩ জুলাই এ বছরের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষর ফল প্রকাশ করা হয়। ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এবার এই পরীক্ষায় এইচএসসিতে পাসের হার গত ১০ বছরের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন হয়েছে। কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডে অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থী ফেল করেছে। এই বোর্ডে শুধু ইংরেজি বিষয়ে প্রায় ৩৮ ভাগ শিক্ষার্থী ফেল করেছে। বাকি বোর্ডগুলোতেও অন্যান্য বিষয়ের তুলনায় ইংরেজিতে ফেলের হার বেশি। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে প্রায় ২৪ ভাগ, রাজশাহী বোর্ডে প্রায় ২৬ ভাগ, যশোর ও বরিশাল বোর্ডে প্রায় ২৮ ভাগ করে, চট্টগ্রাম বোর্ডে প্রায় ২৭ ভাগ, দিনাজপুর বোর্ডে প্রায় ৩০ ভাগ এবং সিলেট বোর্ডে প্রায় ১৮ ভাগ শিক্ষার্থী ইংরেজি বিষয়ে ফেল করেছে। এই বিপর্যয়ের কারণ সম্পর্কে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন দুই কমিটিরই সদস্য অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ জানান, নতুন কারিকুলামে পরীক্ষা নেওয়া হলেও শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ যথেষ্ট নয়। যারা প্রশিক্ষণ পেয়েছেন তারা সেটা রপ্ত করতে পারেননি। তাই শিক্ষার্থীদেরও পড়াতে পারেননি। তাছাড়া কলেজগুলোতে ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক সঙ্কট রয়েছে। এছাড়া আগে যেভাবে গ্রামারভিত্তিক ইংরেজি শেখানো হতো এখন তা নেই। নতুন কারিকুলামে ইংরেজি শিক্ষা যোগাযোগভিত্তিক। যেসব দেশের মাতৃভাষা ইংরেজি তাদের জন্য এ কারিকুলামে শিক্ষা অর্জন সহজ। কিন্তু আমাদের দেশের জন্য এই পদ্ধতির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে পূণর্মূল্যায়ন প্রয়োজন। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের ইংরেজি প্রথম পত্র বিষয়ের প্রধান পরীক্ষক মিরপুর গার্লস আইডিয়াল ল্যাবরেটরি ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মঞ্জুরুল আমিন শেখর জানান, আগের প্রান্তিক নম্বর অর্থাত্ যেখানে গ্রেড পরিবর্তন হয় সেসব ক্ষেত্রে দু/তিন নম্বর বেশি দিয়ে দিতেন শিক্ষকরা। যেমন-২৭/২৮ পেলে ৩৩ নম্বর, ৭৮/৭৯ পেলে ৮০ নম্বর করে দেওয়া হতে। কিন্তু এবার পরীক্ষকরা এমন কোনো গ্রেস দেননি। তাছাড়া শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ এখনও মানসম্মত হয়নি। যের কারণে এখনও অনেক পরীক্ষক সঠিকভাবে খাতা দেখতে পারেন না। এসব কারণে এবার সব বোর্ডেই ইংরেজিতে পাসের হার কমে গেছে। এই প্রধান পরীক্ষক মনে করেন, খাতা নেওয়ার আগে ইংরেজি বিষয়ে শিক্ষকদের যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় তা যথেষ্ট নয়। ইংরেজি বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের জন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের বিষয়ে ঢাকার সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের সহযোগী অধ্যাপক রণজিত্ পোদ্দার বলেন, সরকারের বেশিরভাগ প্রজেক্টই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়। কিন্তু কলেজের শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণের সুযোগ খুবই কম। এখন পর্যন্ত অল্প কিছু শিক্ষক প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ঢাকা কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের ১২ জন ইংরেজি শিক্ষকের মধ্যে এক, সিটি কলেজের ২৪ জন শিক্ষকের মধ্যে মাত্র দুজন প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। কলেজ পর্যায়ের শিক্ষকদের এমন চিত্র সারাদেশে। এজন্য যেসব শিক্ষক ইংরেজি বোঝেন তারাও শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে পাঠদান করতে পারেন না। আর যারা প্রশিক্ষণ পেয়েছেন তারা তা কাজে লাগাচ্ছেন কি না সেটা মনিটরিং করারও কেউ নেই। এছাড়া উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের কারিকুলাম পরীক্ষার ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন হয়নি জানিয়ে প্রায় ২০ বছর ধরে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া এই প্রশিক্ষক বলেন, এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র এখনও শিক্ষকরা দায়সারাভাবে করেন। আর শিক্ষার্থীরাও এমনভাবে পড়ে, যাতে শুধু পাস করা যায়। শহর এলাকায় ইংরেজিতে পাসের হার বেশি হওয়ার পেছনে শিক্ষকদের অবদান খুবই কম। এখানে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকায় এবং শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সচেতনতা ও ইচ্ছাই ইংরেজিতে ভালো করার মূল কারণ। রণজিত্ পোদ্দার বলেন, উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, রাষ্ট্র কারিকুলাম তৈরি করলেও তা বাস্তবায়নে অবহেলা আছে। যার কারণে কলেজ শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের সুযোগ কম। আবার শিক্ষকরাও নিজেরা প্রশিক্ষণ নিতে আগ্রহী নন। অথচ কারিকুলামের লক্ষ্য অনুযায়ী, শিক্ষার্থীদের ইংরেজি বলতে, লিখতে, পড়তে ও শুনে বুঝতে পারার ক্ষেত্রে দক্ষ করতে হলে আগে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। একইসঙ্গে প্রশিক্ষকদেরও প্রশিক্ষণ দিতে হবে। সরকার একসঙ্গে সব শিক্ষককে না পারলে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে পারে। যেমন-টেলিভিশনের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দিতে পারে। তাও সম্ভব না হলে প্রত্যেক কলেজ থেকে কমপক্ষে একজনকে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাকে বাধ্যতামূলকভাবে নিজ প্রতিষ্ঠানের বাকি শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার নিয়ম চালু করতে পারে। একই সঙ্গে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর শিক্ষকরা তা কাজে লাগাচ্ছেন কি না তা মনিটরিং করার ব্যবস্থা করতে হবে। রাজশাহী সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের ইংরেজি বিষয়ের সহযোগী অধ্যাপক ঊর্মিলা খালেদ বলেন, বেশ কিছুদিন ধরে আমাদের দেশে পরীক্ষা পদ্ধতিতে কিছু ভুল ‘প্র্যাকটিস’ ছিল। পাসের হার বাড়ানোর জন্য বোর্ডগুলোর মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা ছিল। প্রশিক্ষণ নিতে আসা শিক্ষকরা অভিযোগ করতেন, তাদের সহজ প্রশ্ন করার জন্য বোর্ড থেকে নির্দেশনা দেওয়া হতো। প্রয়োজনে গাইড থেকে প্রশ্ন করার জন্য বলা হতো। খাতা দেখার সময় নির্দেশনা দেওয়া হতো, যে যা-ই লেখুক না কেন নম্বর দিতে হবে। বোর্ডের এসব অলিখিত নির্দেশনার কারণে আমরা যত প্রশিক্ষণই দেই না কেন, শিক্ষকরা বাধ্য হয়ে বইয়ের সহজ কয়েকটি অধ্যায় এবং গাইড থেকে সবসময় প্রশ্ন করতেন। এছাড়া অনেক ভালো কলেজেও ইংরেজি প্রথম পত্রের বইটি ভালোভাবে পড়ায় না। তারা গাইড পড়ার জন্য শিক্ষার্থীদের উত্সাহিত করে। ফলে শিক্ষার্থীরাও পুরো বই না পড়ে সবসময় সে অধ্যায়গুলোর প্রতি জোর দিয়ে থাকে। কিন্তু এবার শিক্ষকদের মডেল উত্তরপত্র দিয়ে দেওয়ার কারণে সেভাবে তাদের নম্বর দিতে হয়েছে। যে কারণে শিক্ষার্থীরা খারাপ করেছে। তবে শুধু উত্তরপত্র মূল্যায়ন পদ্ধতি পরিবর্তনেই ইংরেজিতে শিক্ষার্থীদের দক্ষতা অর্জন সম্ভব নয় বলে মনে করেন এই ইংরেজিতে অভিজ্ঞ শিক্ষক। তিনি বলেন, সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতিতে চারটি জিনিসের প্রতি আমরা জোর দেই। এগুলো হল-শিক্ষার্থীরা ইংরেজিতে কথা বলতে পারবে, শুনে বুঝতে পারবে, নিজে লিখতে পারবে ও পড়তে পারবে। এজন্য ইংরেজি বিষয়ে ২০১২ সাল থেকে যোগাযোগধর্মী (কমিউনিকেটিভ) কারিকুলাম চালু করা হয়েছে। কিন্তু এটি এখনও পুরোপুরি কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। প্রশ্নপত্রে এ বিষয়টি এখনও আসেনি। কারণ শিক্ষকদের প্রায় অর্ধেকের ইংরেজির ভিত দুর্বল। তারা শিক্ষাদান ও পড়ানোর ধরন সম্পর্কে ভালোভাবে জানলেও অনেকেরই ইংরেজি ভাষায় দুর্বলতা রয়েছে। তাই শিক্ষার্থীরাও এখনও ইংরেজিতে মুখস্থনির্ভর শিক্ষা অর্জন করছে। ফলে পাস করে গেলেও বেশিরভাগ শিক্ষার্থী ইংরেজি বলতে ও লিখতে পারে না। শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে ইংরেজি মূল্যায়ন করতে হলে পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের ধরন পরিবর্তন করতে হবে। শুধু লিখিত পরীক্ষা নিলে হবে না। এর সঙ্গে শিক্ষার্থীরা ইংরেজি বলতে, পড়তে ও শুনে বুঝতে পারে কি না তা মূল্যায়ন করতে হবে। আর শিক্ষকদের ভাষাগত দুর্বলতা কাটাতে ও দক্ষতা অর্জন করতে ব্রিটিশ কাউন্সিল বা এমন কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে ইংরেজি ভাষার ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

দক্ষ শিক্ষক সঙ্কট আর মুখস্থনির্ভরতাই কারণ

আপডেট টাইম : ০১:২৮:২৬ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৫ জুলাই ২০১৭

হাওর বার্তা ডেস্কঃ  দক্ষ শিক্ষক সঙ্কট ও প্রশিক্ষণের অভাব, মুখস্থনির্ভর শিক্ষা, কারিকুলাম অনুযায়ী পাঠদান ও মূল্যায়ন না হওয়াই এবারের উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) পরীক্ষায় ইংরেজি বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ। শিক্ষাবিদ, প্রধান পরীক্ষক ও ইংরেজি বিষয়ে অভিজ্ঞ কয়েকজন শিক্ষক গতকাল হাওর বার্তাকে  এমনটিই জানান। তাদের মতে, যোগাযোগধর্মী (কমিউনিকেটিভ) কারিকুলাম চালু করা হলেও তা এখনও কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। ফলে শিক্ষার্থীরা এখনও গতানুগতিক ধারায় মুখস্থনির্ভরই রয়ে গেছে। তাছাড়া এবার উত্তরপত্র মূল্যায়নে নতুন পদ্ধতিও ইংরেজি বিষয়ে পাসের হারে ধস নামিয়েছে। গত ২৩ জুলাই এ বছরের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষর ফল প্রকাশ করা হয়। ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এবার এই পরীক্ষায় এইচএসসিতে পাসের হার গত ১০ বছরের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন হয়েছে। কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডে অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থী ফেল করেছে। এই বোর্ডে শুধু ইংরেজি বিষয়ে প্রায় ৩৮ ভাগ শিক্ষার্থী ফেল করেছে। বাকি বোর্ডগুলোতেও অন্যান্য বিষয়ের তুলনায় ইংরেজিতে ফেলের হার বেশি। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে প্রায় ২৪ ভাগ, রাজশাহী বোর্ডে প্রায় ২৬ ভাগ, যশোর ও বরিশাল বোর্ডে প্রায় ২৮ ভাগ করে, চট্টগ্রাম বোর্ডে প্রায় ২৭ ভাগ, দিনাজপুর বোর্ডে প্রায় ৩০ ভাগ এবং সিলেট বোর্ডে প্রায় ১৮ ভাগ শিক্ষার্থী ইংরেজি বিষয়ে ফেল করেছে। এই বিপর্যয়ের কারণ সম্পর্কে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন দুই কমিটিরই সদস্য অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ জানান, নতুন কারিকুলামে পরীক্ষা নেওয়া হলেও শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ যথেষ্ট নয়। যারা প্রশিক্ষণ পেয়েছেন তারা সেটা রপ্ত করতে পারেননি। তাই শিক্ষার্থীদেরও পড়াতে পারেননি। তাছাড়া কলেজগুলোতে ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক সঙ্কট রয়েছে। এছাড়া আগে যেভাবে গ্রামারভিত্তিক ইংরেজি শেখানো হতো এখন তা নেই। নতুন কারিকুলামে ইংরেজি শিক্ষা যোগাযোগভিত্তিক। যেসব দেশের মাতৃভাষা ইংরেজি তাদের জন্য এ কারিকুলামে শিক্ষা অর্জন সহজ। কিন্তু আমাদের দেশের জন্য এই পদ্ধতির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে পূণর্মূল্যায়ন প্রয়োজন। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের ইংরেজি প্রথম পত্র বিষয়ের প্রধান পরীক্ষক মিরপুর গার্লস আইডিয়াল ল্যাবরেটরি ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মঞ্জুরুল আমিন শেখর জানান, আগের প্রান্তিক নম্বর অর্থাত্ যেখানে গ্রেড পরিবর্তন হয় সেসব ক্ষেত্রে দু/তিন নম্বর বেশি দিয়ে দিতেন শিক্ষকরা। যেমন-২৭/২৮ পেলে ৩৩ নম্বর, ৭৮/৭৯ পেলে ৮০ নম্বর করে দেওয়া হতে। কিন্তু এবার পরীক্ষকরা এমন কোনো গ্রেস দেননি। তাছাড়া শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ এখনও মানসম্মত হয়নি। যের কারণে এখনও অনেক পরীক্ষক সঠিকভাবে খাতা দেখতে পারেন না। এসব কারণে এবার সব বোর্ডেই ইংরেজিতে পাসের হার কমে গেছে। এই প্রধান পরীক্ষক মনে করেন, খাতা নেওয়ার আগে ইংরেজি বিষয়ে শিক্ষকদের যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় তা যথেষ্ট নয়। ইংরেজি বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের জন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের বিষয়ে ঢাকার সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের সহযোগী অধ্যাপক রণজিত্ পোদ্দার বলেন, সরকারের বেশিরভাগ প্রজেক্টই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়। কিন্তু কলেজের শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণের সুযোগ খুবই কম। এখন পর্যন্ত অল্প কিছু শিক্ষক প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ঢাকা কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের ১২ জন ইংরেজি শিক্ষকের মধ্যে এক, সিটি কলেজের ২৪ জন শিক্ষকের মধ্যে মাত্র দুজন প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। কলেজ পর্যায়ের শিক্ষকদের এমন চিত্র সারাদেশে। এজন্য যেসব শিক্ষক ইংরেজি বোঝেন তারাও শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে পাঠদান করতে পারেন না। আর যারা প্রশিক্ষণ পেয়েছেন তারা তা কাজে লাগাচ্ছেন কি না সেটা মনিটরিং করারও কেউ নেই। এছাড়া উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের কারিকুলাম পরীক্ষার ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন হয়নি জানিয়ে প্রায় ২০ বছর ধরে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া এই প্রশিক্ষক বলেন, এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র এখনও শিক্ষকরা দায়সারাভাবে করেন। আর শিক্ষার্থীরাও এমনভাবে পড়ে, যাতে শুধু পাস করা যায়। শহর এলাকায় ইংরেজিতে পাসের হার বেশি হওয়ার পেছনে শিক্ষকদের অবদান খুবই কম। এখানে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকায় এবং শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সচেতনতা ও ইচ্ছাই ইংরেজিতে ভালো করার মূল কারণ। রণজিত্ পোদ্দার বলেন, উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, রাষ্ট্র কারিকুলাম তৈরি করলেও তা বাস্তবায়নে অবহেলা আছে। যার কারণে কলেজ শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের সুযোগ কম। আবার শিক্ষকরাও নিজেরা প্রশিক্ষণ নিতে আগ্রহী নন। অথচ কারিকুলামের লক্ষ্য অনুযায়ী, শিক্ষার্থীদের ইংরেজি বলতে, লিখতে, পড়তে ও শুনে বুঝতে পারার ক্ষেত্রে দক্ষ করতে হলে আগে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। একইসঙ্গে প্রশিক্ষকদেরও প্রশিক্ষণ দিতে হবে। সরকার একসঙ্গে সব শিক্ষককে না পারলে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে পারে। যেমন-টেলিভিশনের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দিতে পারে। তাও সম্ভব না হলে প্রত্যেক কলেজ থেকে কমপক্ষে একজনকে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাকে বাধ্যতামূলকভাবে নিজ প্রতিষ্ঠানের বাকি শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার নিয়ম চালু করতে পারে। একই সঙ্গে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর শিক্ষকরা তা কাজে লাগাচ্ছেন কি না তা মনিটরিং করার ব্যবস্থা করতে হবে। রাজশাহী সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের ইংরেজি বিষয়ের সহযোগী অধ্যাপক ঊর্মিলা খালেদ বলেন, বেশ কিছুদিন ধরে আমাদের দেশে পরীক্ষা পদ্ধতিতে কিছু ভুল ‘প্র্যাকটিস’ ছিল। পাসের হার বাড়ানোর জন্য বোর্ডগুলোর মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা ছিল। প্রশিক্ষণ নিতে আসা শিক্ষকরা অভিযোগ করতেন, তাদের সহজ প্রশ্ন করার জন্য বোর্ড থেকে নির্দেশনা দেওয়া হতো। প্রয়োজনে গাইড থেকে প্রশ্ন করার জন্য বলা হতো। খাতা দেখার সময় নির্দেশনা দেওয়া হতো, যে যা-ই লেখুক না কেন নম্বর দিতে হবে। বোর্ডের এসব অলিখিত নির্দেশনার কারণে আমরা যত প্রশিক্ষণই দেই না কেন, শিক্ষকরা বাধ্য হয়ে বইয়ের সহজ কয়েকটি অধ্যায় এবং গাইড থেকে সবসময় প্রশ্ন করতেন। এছাড়া অনেক ভালো কলেজেও ইংরেজি প্রথম পত্রের বইটি ভালোভাবে পড়ায় না। তারা গাইড পড়ার জন্য শিক্ষার্থীদের উত্সাহিত করে। ফলে শিক্ষার্থীরাও পুরো বই না পড়ে সবসময় সে অধ্যায়গুলোর প্রতি জোর দিয়ে থাকে। কিন্তু এবার শিক্ষকদের মডেল উত্তরপত্র দিয়ে দেওয়ার কারণে সেভাবে তাদের নম্বর দিতে হয়েছে। যে কারণে শিক্ষার্থীরা খারাপ করেছে। তবে শুধু উত্তরপত্র মূল্যায়ন পদ্ধতি পরিবর্তনেই ইংরেজিতে শিক্ষার্থীদের দক্ষতা অর্জন সম্ভব নয় বলে মনে করেন এই ইংরেজিতে অভিজ্ঞ শিক্ষক। তিনি বলেন, সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতিতে চারটি জিনিসের প্রতি আমরা জোর দেই। এগুলো হল-শিক্ষার্থীরা ইংরেজিতে কথা বলতে পারবে, শুনে বুঝতে পারবে, নিজে লিখতে পারবে ও পড়তে পারবে। এজন্য ইংরেজি বিষয়ে ২০১২ সাল থেকে যোগাযোগধর্মী (কমিউনিকেটিভ) কারিকুলাম চালু করা হয়েছে। কিন্তু এটি এখনও পুরোপুরি কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। প্রশ্নপত্রে এ বিষয়টি এখনও আসেনি। কারণ শিক্ষকদের প্রায় অর্ধেকের ইংরেজির ভিত দুর্বল। তারা শিক্ষাদান ও পড়ানোর ধরন সম্পর্কে ভালোভাবে জানলেও অনেকেরই ইংরেজি ভাষায় দুর্বলতা রয়েছে। তাই শিক্ষার্থীরাও এখনও ইংরেজিতে মুখস্থনির্ভর শিক্ষা অর্জন করছে। ফলে পাস করে গেলেও বেশিরভাগ শিক্ষার্থী ইংরেজি বলতে ও লিখতে পারে না। শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে ইংরেজি মূল্যায়ন করতে হলে পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের ধরন পরিবর্তন করতে হবে। শুধু লিখিত পরীক্ষা নিলে হবে না। এর সঙ্গে শিক্ষার্থীরা ইংরেজি বলতে, পড়তে ও শুনে বুঝতে পারে কি না তা মূল্যায়ন করতে হবে। আর শিক্ষকদের ভাষাগত দুর্বলতা কাটাতে ও দক্ষতা অর্জন করতে ব্রিটিশ কাউন্সিল বা এমন কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে ইংরেজি ভাষার ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণ দিতে হবে।