এই বর্ষায় পেয়ারাবাজারের সঙ্গে অনেক কিছু ফ্রি

হাওর বার্তা ডেস্কঃ গত বছর থেকে ঝালকাঠির ভাসমান পেয়ারার বাজারে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। সেই ইচ্ছা পূরণ হলো এবার, ভ্রমণ গ্রুপ ট্র্যাভেল বাজ বিডির মাধ্যমে। ১৪০০ টাকায় ঘুরে এলাম অপরূপ পেয়ারাবাজার। এর সঙ্গে বিনামূল্যে দেখলাম দর্শনীয় অনেক স্থান, খেলাম মজাদার অনেক খাবার, যা স্মৃতির আয়নায় থাকবে অনেক দিন।

গত ১৩ জুলাই বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার আগেই হাজির হই ঢাকা নদীবন্দর সদরঘাট টার্মিনালে। উঠে পড়লাম দৈত্যাকার পারাবত-১২ লঞ্চে। আগে থেকেই আমাদের জন্য লঞ্চের তৃতীয় তলার একদম পেছনের ডেকে জায়গা রেখেছিলেন গ্রুপের অ্যাডমিন তমাল ও তাঁর সহযোগীরা। এই লঞ্চে করে আমরা যাব বরিশাল। একে একে আমাদের ৩৮ জন সহযাত্রী হাজির হন। লঞ্চের বিশাল ছাদে বসে উপভোগ করি অপরূপ সূর্যাপ্ত। আর বুড়িগঙ্গার মনমাতানো রূপ। ভাগ্যিস বুড়িগঙ্গার নিকষ কালো দুর্গন্ধযুক্ত পানি ছিল না। নয়তো  নাক টিপে বসে থাকতে হতো দীর্ঘক্ষণ।


রাত সাড়ে ৯টায় আমাদের লঞ্চ ছাড়ে। নদীর শীতল বাতাসে জুড়িয়ে যায় শরীর। কিছুক্ষণ পর চলে আসে রাতের খাবার। প্যাকেটে ভরা গরম গরম মোরগ পোলাও। অসাধারণ তার স্বাদ। লঞ্চ ছাড়ার আগমুহূর্তে সেগুলো আমাদের দিয়ে যান পুরান ঢাকার কলতাবাজারের নাছির উদ্দিন সরদার লেনের আল্লার দান রাজমহল রেস্তোরাঁর মালিক শাহাদত ভাই।

উদরপূর্তির পর চলে যাই লঞ্চের ছাদে। চলে আড্ডা, অনেক রাত পর্যন্ত। অনেকে আবার নাক ডেকে ঘুমিয়েছে। আরেকটি বিষয়, এই লঞ্চে শুধু আমরাই ছিলাম না। আরো অনেক ভ্রমণ দল ছিল। ‘বেড়াই বাংলাদেশ’, ‘নারায়ণগঞ্জ ট্র্যাভেলার্স গ্রুপ’সহ (এনটিজি) আরো অনেক দলের পুরোনো ভ্রমণসঙ্গীদের সঙ্গে পুনর্মিলনী হয়ে যায়।

ভোর সাড়ে ৪টায় আমাদের লঞ্চ পৌঁছায় বরিশাল নদীবন্দরে। ভোরের আলো ফোটার পর আমরা টার্মিনাল থেকে বের হই। নাশতা করে নিই বরিশালের ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম মুসলিম হোটেলে। এরপর আমরা উঠি আমাদের জন্য রিজার্ভ করা বাসে। এ ক্ষেত্রে আমাদের সহযোগিতা করেন হাসান আহমেদ সোহাগ ভাই। সকালের আলোয় রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের অপরূপ বরিশাল দেখতে দেখতে চলে যাই বানারীপাড়া ব্রিজ। সেখানে বাস থেকে নেমে উঠে পড়ি আগে থেকে ঠিক করা দুটি ট্রলারে। আমরা ১৯ জন করে দুই ট্রলারে বসে পড়ি। সাঁতার না জানা লোকজন লাইফ জ্যাকেট পরে ফেলেন। স্বরূপকাঠি নদী হয়ে একের পর এক খাল বেয়ে ছুটে চলে আমাদের ট্রলার। সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে আশপাশের ছবি তুলতে। খালগুলোর পাশে হরেক রকমের গাছপালা। পেয়ারা, আমড়া, পেঁপে, কলা, কাঁঠাল, চালতা, বিলাতি গাব, পান, কাকরোল—এত গাছ যে লিখে শেষ করা যাবে না। মাঝেমধ্যে ছোট ছোট নৌকায় করে সেসব নিয়ে বাজারে যাচ্ছিলেন চাষিরা। পথে পড়ে পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলার কুড়িয়ানা বাজার। সেই বাজারের উদ্দেশে ট্রলারে করে নৌকা নিয়ে যাচ্ছিলেন ব্যবসায়ীরা। কুড়িয়ানা বাজার পার হয়ে ঢুকে পড়ি সরু সরু খালে। একটু এদিক সেদিক হলে আটকে যাবে ট্রলার। কিন্তু মাঝি বেশ দক্ষতার সঙ্গে সেটি চালান। মাঝেমধ্যে আমাদের কয়েকজন ট্রলারের হাল ধরেন। সকাল সাড়ে ৯টার মধ্যে চলে আসি ঝালকাঠি সদর উপজেলার ভীমরুলীর ভাসমান বাজারে।

বাজারে খালের দুই পাশে বেশ কিছু আড়ত। ছোট ছোট নৌকায় পেয়ারা, লেবু, কাঁচকলা, কাকরোলসহ সবজি নিয়ে সেখানে ভিড় করেছেন চাষিরা। করছেন দরদাম। দামে না পোষালে নৌকা নিয়ে চলে যাচ্ছেন আরেক আড়তে। আস্তে আস্তে নৌকাভর্তি ফল ও সবজি নিয়ে ভিড় করেন আরো অনেক চাষি।

ভাসমান বাজার দেখে ভীমরুলীর ব্রিজ পার হয়ে আমরা কয়েকজন চলে যাই গ্রামের ভেতর। সেখানে খাল দিয়ে নৌকাভর্তি পেয়ারা নিয়ে যাচ্ছিলেন এক চাষি। পেয়ারা দেখে পছন্দ হয়। চাষি বললেন, প্রায় তিন মণ পেয়ারা আছে। দামাদামি করে ১৪০০ টাকা দিয়ে গ্রুপের সবার জন্য সেই পেয়ারা কেনা হয়। আরেক চাষির কাছ থেকে কিনি সুস্বাদু কলা। এরপর দুটি নৌকা নিয়ে চলে আসি ভীমরুলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ঘাটে আগে থেকে ভিড়ানো আমাদের ট্রলারের কাছে। সেখানে আমাদের লোকজন নৌকায় বসে পেয়ারা নিয়ে ছবি তোলা শুরু করে। এর মধ্যে ঘটে মজার ঘটনা। একজন পেয়ারার নৌকায় বসে বৈঠা হাতে নিয়ে ছবি তোলার পর উল্টে যায় নৌকা। অল্পের জন্য আমি সেই দৃশ্য মিস করি। আমি দেখি আমাদের ট্রলারের পাশ থেকে রাশি রাশি পেয়ারা ভেসে যাচ্ছে। আমাদের লোকজন ও আশপাশের লোকজন যে যেভাবে পারছে পেয়ারা সংগ্রহ করছে। কিন্তু অনেক কাঁচা পেয়ারা পানিতে তলিয়ে যায়। চাষিকে নিয়ে আমাদের কয়েকজন নৌকাটি উদ্ধার করে।

গ্রুপের এডমিন তমাল চাষিকে নিয়ে চলে যান বাজারে, আবার পেয়ারা কিনতে। কিছুক্ষণ পর তিনি আরো দুই নৌকা পেয়ারা ও ৫২০ পিস লেবু নিয়ে হাজির হন। এরপর শুরু হয় পেট ভরে পেয়ারা খাওয়ার পালা। কিন্তু অনেক পেয়ারা রয়ে যায়। সেগুলো আমরা পরে ভাগাভাগি করে নিই।

এদিকে আমাদের কয়েকজন খালে গোসল করা শুরু করে। কয়েকজন লাইফজ্যাকেট নিয়ে নেমে পড়ে। কয়েকজন ব্রিজ থেকে লাফ দেয় খালের পানিতে। কিছুক্ষণ পর আরো বেশ কিছু ভ্রমণ গ্রুপ ভিড় করে ঘাটে। অনেকে ঝালকাঠি ও পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি থেকে ট্রলার ভাড়া করে হৈ-হুল্লোড় করে আমাদের সামনে দিয়ে চলে যায়। তাদের ট্রলারে ছিল সাউন্ড বক্স, বাজছিল বাংলা, হিন্দি ও ইংরেজি গান। গানের তালে তালে নাচছিল শিশু-কিশোর থেকে বৃদ্ধরা। তাদের আনন্দ দেখে মনে হচ্ছিল ঈদের আনন্দ উদযাপন করছে। এ রকম অন্তত অর্ধশত ট্রলার চোখে পড়েছে।

সবার গোসল শেষে দুপুর আড়াইটায় আমরা চলে যাই স্বরূপকাঠির আটঘর কুড়িয়ানা বাজারে দুপুরের খাবার খেতে। আগে থেকে ঠিক করা ছিল আমরা সেখানকার বিখ্যাত বৌদির হোটেলে খাব। গিয়ে দেখি হোটেলের নাম সকাল-সন্ধ্যা হোটেল। মালিক হিসেবে নাম লেখা বরুণ সিকদারের। কিন্তু হোটেলটি পরিচিত বৌদির হোটেল নামে। কারণ বোঝা গেল খাবার খেয়ে। ভাতের সঙ্গে প্রথমে দেওয়া হয় অল্প করে কলা, ডাল, আলু ও পেঁপে ভর্তা। এরপর আসে মিষ্টিকুমড়ার পাতা ও ডগা দিয়ে তরকারি। এসব দিয়েই সাবাড় করি দেড় প্লেট ভাত। এরপর পাতে আসে নদীর বড় রুই মাছের টুকরা। কেউ কেউ মাছের বদলে মুরগির টুকরো নেয়।

পেটপুরে খাওয়ার পর হামলা চালাই কুড়িয়ানা বাজারে নরেন বিশ্বাসের ঋতুপর্ণা মিষ্টান্নভাণ্ডারে। এই হামলা সেই হামলা নয়, এটি ছিল সুস্বাদু রসমঞ্জুরি (কুমিল্লার রসমালাইয়ের মতো) ও মালাই খাওয়ার হামলা। কী বলব, অপূর্ব সেই স্বাদ। এই মিষ্টি খাওয়ার জন্য হলেও কুড়িয়ানা বাজারে আসতে হবে। মিষ্টি খাওয়া শেষ করে আবার উঠে পড়ি ট্রলারে। বানারীপাড়া ব্রিজের ঘাটে ভেড়ার পর আমাদের সবাইকে ভাগ করে পেয়ারা দেওয়া হয়। সেই পেয়ারা নিয়ে উঠে পড়ি বাসে।

পথে উজিরপুর উপজেলার গুটিয়া এলাকার চাংগুরিয়ায় অবস্থিত বায়তুল আমান জামে মসজিদ ও ঈদগাহ কমপ্লেক্স মসজিদের সামনে বাস থামে। মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা এস সরফুদ্দিন আহমেদ সান্টু। এত সুন্দর মসজিদ। আমাদের মতো আরো অনেক নারী-পুরুষ বিশাল মসজিদের ভেতর ঘুরতে থাকে। কেউ কেউ ছবি তোলা শুরু করে। মসজিদের স্তম্ভটি মুসলমানদের ২১টি পবিত্র স্থানের মাটি ও জমজমের পানি দিয়ে বানানো বলে মসজিদের একটি শ্বেতপাথরে লেখা।

মসজিদ দেখে আবার বাসে। বাস থামে এবার ঐতিহাসিক দীঘি দুর্গাসাগরের সামনে। বিশাল দীঘি। মাঝখানে দ্বীপের মতো বানানো হয়েছে। দীঘির চারপাশে হাঁটার রাস্তা বানানো হয়েছে। এক পাশে কয়েকটি হরিণ খাঁচাবন্দি করে রাখা আছে। দীঘির শুরুতে বরিশাল জেলা প্রশাসনের লেখা সাইনবোর্ডে লেখা আছে, ‘…চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের পঞ্চদশ রাজা শিবনারায়ণ ১৭৮০ সালে তাঁর স্ত্রী দুর্গারানীর প্রতি অগাধ ভালোবাসার গভীরতা প্রমাণের জন্য এবং এলাকাবাসীর পানি সংকট নিরসনের জন্য মাধবপাশায় ঐতিহাসিক এই দীঘি খনন করেন। তাঁর রানী শ্রীমতি দুর্গারানীর নামানুসারে দীঘির নামকরণ করেন দুর্গাসাগর।’

দুর্গাসাগর দেখে আবার বাসে। বাস থামে বরিশাল নদীবন্দরে। আবার উঠে পড়ি পারাবত ১২-এর ডেকে। লঞ্চ ছাড়ার আগেই চলে আসে চট্টগ্রাম মুসলিম হোটেলের প্যাকেটজাত মুরগির বিরিয়ানি ও তেহারি। রাত ১০টায় খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। এক ঘুমেই সদরঘাট। এরপর যে যার বাসায় ফিরে যাই।

যেভাবে যাবেন

ভাসমান পেয়ারা বাজারে অনেকভাবে যাওয়া যায়। ঢাকার সদরঘাট থেকে বরিশাল লঞ্চে বা গাবতলী থেকে বাসে যেতে পারেন। লঞ্চের ডেকে ভাড়া পড়বে ২০০ টাকা করে। কেবিন নিলে এক হাজার টাকা বা এর বেশি খরচ পড়বে। গ্রুপের সাইজ বড় হলে একটি বাস রিজার্ভ করতে পারেন। আমাদের বাসের খরচ পড়েছিল ছয় হাজার টাকা। ছোট গ্রুপ হলে বরিশাল লঞ্চঘাট থেকে প্রথমে মাহেন্দ্র অটোতে করে নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনালে যেতে হবে। সেখান থেকে বাসে বা মাহেন্দ্র অটোতে করে বানারীপাড়া অথবা স্বরূপকাঠি যেতে পারেন। বানারীপাড়া যেতে মাহেন্দ্রতে ভাড়া নেবে ৫০ টাকা করে। তারপর সেখান থেকে রিকশা অথবা অটোতে যাবেন কুড়িয়ানা। একটু হেঁটে একটা ব্রিজ পার হয়ে আবার অটোতে করে চলে যেতে পারবেন আটঘর কুড়িয়ানা বাজারে। ভীমরুলী যেতে চাইলে বানারীপাড়া থেকে নৌকা বা ট্রলারে যাওয়াই ভালো। ভীমরুলী, আটঘর কুড়িয়ানাসহ আরো অনেক ছোট বাজার ও বাগান ঘুরিয়ে আনার জন্য ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা ভাড়া নেবে ছোট ট্রলারগুলো। আর বড় ট্রলারগুলোর ভাড়া পড়বে দেড় হাজার থেকে দুই হাজার টাকা। অবশ্যই দামাদামি করে ভাড়া ঠিক করবেন। আমাদের জন্য হাসান আহমেদ সোহাগ ভাই দুটি ট্রলার ঠিক করে রেখেছিলেন, ভাড়া পড়েছিল মোট তিন হাজার ৪০০ টাকা।

আরেকটি পথ হচ্ছে ঢাকার সদরঘাট থেকে হুলারহাট-ভাণ্ডারিয়াগামী যে কোনো লঞ্চে চড়ে ভোরে বানারীপাড়া অথবা পরের লঞ্চঘাট স্বরূপকাঠি নেমে সেখান থেকেই ট্রলার রিজার্ভ করা যায়।

কোথায় থাকবেন

আপনি দিনে গিয়ে দিনেও ফিরে আসতে পারেন। আর রাতে থাকতে চাইলে বরিশাল চলে আসতে পারেন। স্বরূপকাঠি অথবা এর অদূরে চাখারে জেলা পরিষদের ডাকবাংলোতে থাকতে পারেন। অথবা ঝালকাঠি শহরে গিয়েও হোটেল, রেস্টহাউস বা ডাকবাংলোতে থাকতে পারেন।

কোথায় খাবেন

ভীমরুলী, আটঘর কুড়িয়ানা বাজারের পাশেই খাবারের হোটেল আছে মোটামুটি মানের। অথবা জেলা সদরে ফিরে এসেও খাওয়াদাওয়া সেরে নিতে পারেন।

টিপস

গ্রুপ করে গেলে ভালো। সড়কপথ থেকে নৌপথে যাওয়াই ভালো। রেইনকোট বা ছাতা নিয়ে যাবেন। সাঁতার না জানলে নিতে হবে লাইফজ্যাকেট। বাগানে ঢুকে পেয়ারা ছিঁড়বেন না। চিপস, চানাচুর বা পানির বোতল নদী বা খালে ফেলবেন না।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর