ঢাকা ০৩:৫৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নির্বাচনের আগে গুমের তালিকা প্রকাশ করবে বিএনপি

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১১:২৭:৫২ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২০ জুলাই ২০১৭
  • ২১৬ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ  সারা দেশে গুমের তালিকা তৈরি করছে বিএনপি। তালিকা তৈরিতে গোপনীয়তা অবলম্বন করা হচ্ছে। প্রস্তুত করা খসড়া তালিকার কপি যুগান্তরের কাছে এসেছে। তালিকায় ২০১০ সালের মার্চে নিখোঁজ চৌধুরী আলম এবং পরবর্তী সময়ে গুম হওয়া নেতাকর্মী ও সমর্থকদের নাম স্থান পেয়েছে। সর্বশেষ এ খসড়া তালিকা অনুযায়ী সারা দেশে দলটির শতাধিক নেতাকর্মী ও সমর্থক গুম হয়েছেন। গুমের পর যাদের লাশ পাওয়া গেছে তাদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

তালিকায় গুম হওয়া নেতাকর্মীর নাম ও পদবি এবং তাদের পিতামাতার নামসহ স্থায়ী ঠিকানা উল্লেখ রয়েছে। কোন স্থান থেকে, কিভাবে গুম হয়েছেন সে বর্র্ণনাও স্থান পেয়েছে। গুমের হালনাগাদ তালিকাটি বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক, দাতা ও মানবাধিকার সংস্থাকে দেয়া হবে। এর মধ্য দিয়ে গুম-খুন নিয়ে বিএনপির অভিযোগ আওয়ামী লীগের নাকচ করার জবাব দেয়া হবে। মূলত আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচনার জবাব দিতেই তালিকাটি হালনাগাদ করা হচ্ছে। তালিকা চূড়ান্ত হওয়ার পর সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে বসে বিশ্লেষণের পর আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেবেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তালিকাটি প্রকাশ করা হতে পারে বলে দলের নীতিনির্ধারণী সূত্রে জানা গেছে।

জানতে চাইলে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর যেসব নেতাকর্মী ও সমর্থক খুন ও গুম হয়েছেন তাদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী শুধু গুমের সংখ্যাই শতাধিক। গুম-খুন মিলে এ সংখ্যা প্রায় সাড়ে ছয়শ’। বিএনপি ছাড়া অন্য রাজনৈতিক দল এবং সাধারণ মানুষ মিলে সারা দেশে প্রায় এক হাজার লোক খুন ও গুমের স্বীকার হয়েছেন।

তিনি বলেন, চূড়ান্ত তালিকা বলতে কিছু নেই। কারণ প্রতিনিয়তই নেতাকর্মী ও সাধারণ সমর্থকরা গুম-খুনের শিকার হচ্ছেন।

এক প্রশ্নের জবাবে রিজভী বলেন, অনানুষ্ঠানিকভাবে মাঝে মাঝে আমরা গণমাধ্যমেও খুন ও গুমের সংখ্যা জানাচ্ছি। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে গুম-খুনের তালিকা প্রকাশ করা হবে কিনা তা চেয়ারপারসন ও সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

গুম হওয়া নেতাকর্মী ও সমর্থকদের অনেকের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তারা জানান, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর পরিচয়ে আটকের পর থেকে তারা নিখোঁজ। দিন দিন অপেক্ষার প্রহর গুনে অনেকেই গুরুতর অসুস্থ। কেউ বা আবার স্বজনদের শোকে মৃত্যুবরণও করেছেন। উত্তরা ছাত্রদলের নেতা নিখোঁজ নিজামউদ্দিন মুন্নার পিতা পুত্র শোকে সম্প্রতি ইন্তেকাল করেন। গুম হওয়া এসব পরিবার ও বিএনপি নেতাদের অভিযোগ বিরোধী দল ও মতের লোকদের রাজনৈতিকভাবে ঘায়েল করতে না পেরে সরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে এসব গুম-খুনের ঘটনা ঘটিয়েছে। নিখোঁজ পরিবারের সদস্যদের এখন একটাই চাওয়া- জীবিত না পেলেও তারা ফিরে পেতে চান অন্তত স্বজনদের লাশ।

খসড়া তালিকা অনুযায়ী, গুমের সংখ্যা ঢাকা মহানগরীতে সবচেয়ে বেশি। এখানে গুম হয়েছেন ৪০ জন। এদের বেশির ভাগই ছাত্রদলের নেতাকর্মী ও সমর্থক। এদের মধ্যে আছেন সাবেক কমিশনার চৌধুরী আলম, ৩৮নং ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাজেদুল ইসলাম সুমন, জাহিদুল করিম তানভীর, কাশেম, ছাত্রদলের মফিউল ইসলাম রাসেল, মাহবুব হাসান সুজন (সূত্রাপুর), লিটন (গুলিস্তান), সেলিম রেজা পিন্টু (সূত্রাপুর), সম্রাট মোল্লা (সূত্রাপুর), খালেদ হাসান (সূত্রাপুর), কাজী ফরহাদ হোসেন (সবুজবাগ), পারভেজ হোসেন (কোতোয়ালি), চঞ্চল হোসেন (কোতোয়ালি), মাহফুজুর রহমান সোহেল (কোতোয়ালি), জহিরুল ইসলাম (কোতোয়ালি), তরিকুল ইসলাম জন্টু, তরিকুল ইসলাম তারা, আসাদুজ্জামান রানা (জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়), মাজহারুল ইসলাম রাসেল (জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়), আল আমিন (জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়), আশিক (ঢাবি), জিয়াউর রহমান শাহীন (ঢাবি), সোহেল ওরফে চাচা সোহেল (বংশাল), রানা (৫৭নং ওয়ার্ড), পারভেজ হোসেন ও জসিম (বংশাল), কাসেম (কাফরুল), মো. নিজাম উদ্দিন মুন্না (উত্তরা), নূর হোসেন হিরু ও মনির হোসেন (উত্তরা), জাকির হোসেন, জিহাদুর রহমান ও মো. রাহাত (তেজগাঁও), শামীম ও মাসুদ রানা (সূত্রাপুর), স্বেচ্ছাসেবক দলের এএম আদনান চৌধুরী (তেজগাঁও), কাউছার, মজিদ, যুবদলের নূরে আলম (পল্লবী) ও লিটন (শাহবাগ) প্রমুখ।

প্রাপ্ত তথ্য ও বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, দলটির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য এম ইলিয়াস আলী ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল রাতে বনানীর বাসার কাছ থেকে তার ড্রাইভার আনছার আলীসহ নিখোঁজ হন। তাদের এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি।

জানতে চাইলে ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর লুনা বলেন, আর কোনো স্ত্রীকে যেন আমার মতো অপেক্ষার প্রহর গুনতে না হয়। প্রতিমুহূর্তে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। তিনি বলেন, এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়েছিলাম, আমাকে আশ্বস্তও করেছিলেন কিন্তু আজও আশান্বিত হওয়ার মতো কোনো খবর পাচ্ছি না। কান্নাজড়িত কণ্ঠে লুনা বলেন, আমার শাশুড়ি বলেছেন, তিনি মৃত্যুর আগে তার ছেলেকে দেখতে চান। জানি না তার আশা পূরণ হবে কিনা।

ঢাকা মহানগর ৩৮নং ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাজেদুল ইসলাম সুমন ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকা থেকে নিখোঁজ হন। এখন পর্যন্ত তার সন্ধান পাওয়া যায়নি। সুমনের বোন ফেরদৌসী আরা বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তাকে তুলে নেয়া হয়।

গুমের তালিকায় স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে জেলাওয়ারি তালিকা করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, চট্টগ্রামে বিএনপি নেতা এএসএম শহিদুল ইসলাম, নজরুল ইসলাম চেয়ারম্যান, জসীম উদ্দিন ও মোশারফ হোসেন গুম হন। সিলেট জেলায় বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য এম ইলিয়াস আলী ও তার ড্রাইভার আনছার আলী নিখোঁজ হন। যদিও তারা ঢাকা থেকেই গুম হয়েছেন। ছাত্রদল নেতা ইফতেকার আহমেদ দিনার ও জুনেদ আলী নিখোঁজ হন। বরিশাল যুবদলের মিরাজ খান, খুলনায় বিএনপির মো. ইসলাম, ঝিনাইদহে নাছির উদ্দীন ও নজরুল ইসলাম, সাতক্ষীরায় কাজী হাসান ও হাফেজ কাজী হেলাল, বাগেরহাটে ছাত্রদল নেতা সাব্বির হাসান, কুমিল্লায় বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য সাইফুল ইসলাম হিরু ও হুমায়ুন কবির পারভেজ, লক্ষ্মীপুরে বিএনপির ইকবাল মাহমুদ জুয়েল, বেলাল হোসেন, ওমর ফারুক, যুবদলের আলমগীর হোসেন, আবদুল কাদের ও রাজু, ঠাকুরগাঁওয়ে বিএনপির জিল্লুর হোসেন, নাটোরে ইব্রাহিম খলিল, গাইবান্ধায় বিএনপির মতিয়ার পারভেজ ও মুছা আহমেদ, নীলফামারীর বিএনপি নেতা আশরাফ আলী, আবদুর রহমান, রাহেদুল ইসলাম, আ. খালেক, আ. মালেক, মাহিদুল ইসলাম, ছকিনউদ্দীন মেম্বার, বাবুল হোসেন ও স্বেচ্ছাসেবক দলের আজিজুল ইসলাম, নরসিংদীতে জেলা ছাত্রদলের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান নাহিদ প্রমুখ।

সাবেক এমপি সাইফুল ইসলাম হিরু ও লাকসাম পৌর বিএনপির সভাপতি হুমায়ুন কবির পারভেজ ২০১৩ সালের ২৭ নভেম্বর কুমিল্লা বিশ্বরোডের কাছ থেকে নিখোঁজ হন। জানতে চাইলে হুমায়ুন কবির পারভেজের ভাই গোলাম ফারুক যুগান্তরকে বলেন, আমার ভাইকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেয়া হয়েছে। সবার কাছে গিয়েছি, প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপও কামনা করেছি। এ ঘটনায় বাবা রঙ্গু মিয়া বাদী হয়ে মামলাও করেছেন, যা এখন সিআইডিতে আছে। ভাইয়ের শোকে বাবাও দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। পারিবারের সবাই ভাইয়ের অপেক্ষায় আছে।

২০১০ সালের ৮ অক্টোবর গাজীপুর এলাকা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিচয়ে তুলে নেয়া হয় চট্টগ্রামের বোয়ালখালী থানার করেলডাঙ্গা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বিএনপি নেতা নজরুল ইসলামকে। এ ব্যাপারে তার ভাই বর্তমান চেয়ারম্যান হামিদুল হক মান্নান বাদী হয়ে জয়দেবপুর থানায় একটি মামলা করেন।

জানতে চাইলে মান্নান বলেন, তার ভাইকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে সাদা পোশাকে গাজীপুর থেকে তুলে নিয়ে যায়। ওই ঘটনায় আমি জয়দেবপুর থানায় মামলা করি। ভাইয়ের সন্ধানে সংশ্লিষ্ট সব জায়গায় গিয়েছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত ভাইকে পাইনি।

গুমের অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতী মাহমুদ খান বলেন, এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন। র‌্যাব সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে যথাযথ আইন মেনে আসামি গ্রেফতার করে। যে কোনো আসামিকে আটকের পর তথ্য প্রমাণসহ নির্দিষ্ট সময়ে সংশ্লিষ্ট থানায় সোপর্দ করা হয়। এক্ষেত্রে র‌্যাব সদস্যরা সব সময়ই আইনের প্রতি সর্বোচ্চ শ্রদ্ধাশীল থাকেন।

তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অনেক সময় অনেককে তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠে। তবে এটি ঠিক নয়। এ ধরনের কয়েকটি ঘটনায় আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া ভুয়া সেসব সদস্যদের গ্রেফতারও করেছি। আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য একটি চক্র এসব ঘটনা ঘটিয়ে থাকে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। প্রত্যেকটি নিখোঁজের ঘটনায় তার পরিবার জিডি করে থাকে। কিন্তু কী কারণে তিনি নিখোঁজ হয়েছেন, বা কোথাও গেছেন কিনা- সে ব্যাপারে তথ্য থাকে না। পরবর্তীতে তদন্ত করতে গিয়ে এমনও দেখা গেছে, নিখোঁজদের অনেকে জঙ্গি তৎপরতায় জড়িয়েছে। অনেকে আবার দেনার দায়ে নিজেই আত্মগোপনের নামে নিখোঁজ হয়েছে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

নির্বাচনের আগে গুমের তালিকা প্রকাশ করবে বিএনপি

আপডেট টাইম : ১১:২৭:৫২ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২০ জুলাই ২০১৭

হাওর বার্তা ডেস্কঃ  সারা দেশে গুমের তালিকা তৈরি করছে বিএনপি। তালিকা তৈরিতে গোপনীয়তা অবলম্বন করা হচ্ছে। প্রস্তুত করা খসড়া তালিকার কপি যুগান্তরের কাছে এসেছে। তালিকায় ২০১০ সালের মার্চে নিখোঁজ চৌধুরী আলম এবং পরবর্তী সময়ে গুম হওয়া নেতাকর্মী ও সমর্থকদের নাম স্থান পেয়েছে। সর্বশেষ এ খসড়া তালিকা অনুযায়ী সারা দেশে দলটির শতাধিক নেতাকর্মী ও সমর্থক গুম হয়েছেন। গুমের পর যাদের লাশ পাওয়া গেছে তাদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

তালিকায় গুম হওয়া নেতাকর্মীর নাম ও পদবি এবং তাদের পিতামাতার নামসহ স্থায়ী ঠিকানা উল্লেখ রয়েছে। কোন স্থান থেকে, কিভাবে গুম হয়েছেন সে বর্র্ণনাও স্থান পেয়েছে। গুমের হালনাগাদ তালিকাটি বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক, দাতা ও মানবাধিকার সংস্থাকে দেয়া হবে। এর মধ্য দিয়ে গুম-খুন নিয়ে বিএনপির অভিযোগ আওয়ামী লীগের নাকচ করার জবাব দেয়া হবে। মূলত আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচনার জবাব দিতেই তালিকাটি হালনাগাদ করা হচ্ছে। তালিকা চূড়ান্ত হওয়ার পর সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে বসে বিশ্লেষণের পর আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেবেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তালিকাটি প্রকাশ করা হতে পারে বলে দলের নীতিনির্ধারণী সূত্রে জানা গেছে।

জানতে চাইলে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর যেসব নেতাকর্মী ও সমর্থক খুন ও গুম হয়েছেন তাদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী শুধু গুমের সংখ্যাই শতাধিক। গুম-খুন মিলে এ সংখ্যা প্রায় সাড়ে ছয়শ’। বিএনপি ছাড়া অন্য রাজনৈতিক দল এবং সাধারণ মানুষ মিলে সারা দেশে প্রায় এক হাজার লোক খুন ও গুমের স্বীকার হয়েছেন।

তিনি বলেন, চূড়ান্ত তালিকা বলতে কিছু নেই। কারণ প্রতিনিয়তই নেতাকর্মী ও সাধারণ সমর্থকরা গুম-খুনের শিকার হচ্ছেন।

এক প্রশ্নের জবাবে রিজভী বলেন, অনানুষ্ঠানিকভাবে মাঝে মাঝে আমরা গণমাধ্যমেও খুন ও গুমের সংখ্যা জানাচ্ছি। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে গুম-খুনের তালিকা প্রকাশ করা হবে কিনা তা চেয়ারপারসন ও সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

গুম হওয়া নেতাকর্মী ও সমর্থকদের অনেকের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তারা জানান, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর পরিচয়ে আটকের পর থেকে তারা নিখোঁজ। দিন দিন অপেক্ষার প্রহর গুনে অনেকেই গুরুতর অসুস্থ। কেউ বা আবার স্বজনদের শোকে মৃত্যুবরণও করেছেন। উত্তরা ছাত্রদলের নেতা নিখোঁজ নিজামউদ্দিন মুন্নার পিতা পুত্র শোকে সম্প্রতি ইন্তেকাল করেন। গুম হওয়া এসব পরিবার ও বিএনপি নেতাদের অভিযোগ বিরোধী দল ও মতের লোকদের রাজনৈতিকভাবে ঘায়েল করতে না পেরে সরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে এসব গুম-খুনের ঘটনা ঘটিয়েছে। নিখোঁজ পরিবারের সদস্যদের এখন একটাই চাওয়া- জীবিত না পেলেও তারা ফিরে পেতে চান অন্তত স্বজনদের লাশ।

খসড়া তালিকা অনুযায়ী, গুমের সংখ্যা ঢাকা মহানগরীতে সবচেয়ে বেশি। এখানে গুম হয়েছেন ৪০ জন। এদের বেশির ভাগই ছাত্রদলের নেতাকর্মী ও সমর্থক। এদের মধ্যে আছেন সাবেক কমিশনার চৌধুরী আলম, ৩৮নং ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাজেদুল ইসলাম সুমন, জাহিদুল করিম তানভীর, কাশেম, ছাত্রদলের মফিউল ইসলাম রাসেল, মাহবুব হাসান সুজন (সূত্রাপুর), লিটন (গুলিস্তান), সেলিম রেজা পিন্টু (সূত্রাপুর), সম্রাট মোল্লা (সূত্রাপুর), খালেদ হাসান (সূত্রাপুর), কাজী ফরহাদ হোসেন (সবুজবাগ), পারভেজ হোসেন (কোতোয়ালি), চঞ্চল হোসেন (কোতোয়ালি), মাহফুজুর রহমান সোহেল (কোতোয়ালি), জহিরুল ইসলাম (কোতোয়ালি), তরিকুল ইসলাম জন্টু, তরিকুল ইসলাম তারা, আসাদুজ্জামান রানা (জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়), মাজহারুল ইসলাম রাসেল (জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়), আল আমিন (জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়), আশিক (ঢাবি), জিয়াউর রহমান শাহীন (ঢাবি), সোহেল ওরফে চাচা সোহেল (বংশাল), রানা (৫৭নং ওয়ার্ড), পারভেজ হোসেন ও জসিম (বংশাল), কাসেম (কাফরুল), মো. নিজাম উদ্দিন মুন্না (উত্তরা), নূর হোসেন হিরু ও মনির হোসেন (উত্তরা), জাকির হোসেন, জিহাদুর রহমান ও মো. রাহাত (তেজগাঁও), শামীম ও মাসুদ রানা (সূত্রাপুর), স্বেচ্ছাসেবক দলের এএম আদনান চৌধুরী (তেজগাঁও), কাউছার, মজিদ, যুবদলের নূরে আলম (পল্লবী) ও লিটন (শাহবাগ) প্রমুখ।

প্রাপ্ত তথ্য ও বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, দলটির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য এম ইলিয়াস আলী ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল রাতে বনানীর বাসার কাছ থেকে তার ড্রাইভার আনছার আলীসহ নিখোঁজ হন। তাদের এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি।

জানতে চাইলে ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর লুনা বলেন, আর কোনো স্ত্রীকে যেন আমার মতো অপেক্ষার প্রহর গুনতে না হয়। প্রতিমুহূর্তে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। তিনি বলেন, এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়েছিলাম, আমাকে আশ্বস্তও করেছিলেন কিন্তু আজও আশান্বিত হওয়ার মতো কোনো খবর পাচ্ছি না। কান্নাজড়িত কণ্ঠে লুনা বলেন, আমার শাশুড়ি বলেছেন, তিনি মৃত্যুর আগে তার ছেলেকে দেখতে চান। জানি না তার আশা পূরণ হবে কিনা।

ঢাকা মহানগর ৩৮নং ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাজেদুল ইসলাম সুমন ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকা থেকে নিখোঁজ হন। এখন পর্যন্ত তার সন্ধান পাওয়া যায়নি। সুমনের বোন ফেরদৌসী আরা বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তাকে তুলে নেয়া হয়।

গুমের তালিকায় স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে জেলাওয়ারি তালিকা করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, চট্টগ্রামে বিএনপি নেতা এএসএম শহিদুল ইসলাম, নজরুল ইসলাম চেয়ারম্যান, জসীম উদ্দিন ও মোশারফ হোসেন গুম হন। সিলেট জেলায় বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য এম ইলিয়াস আলী ও তার ড্রাইভার আনছার আলী নিখোঁজ হন। যদিও তারা ঢাকা থেকেই গুম হয়েছেন। ছাত্রদল নেতা ইফতেকার আহমেদ দিনার ও জুনেদ আলী নিখোঁজ হন। বরিশাল যুবদলের মিরাজ খান, খুলনায় বিএনপির মো. ইসলাম, ঝিনাইদহে নাছির উদ্দীন ও নজরুল ইসলাম, সাতক্ষীরায় কাজী হাসান ও হাফেজ কাজী হেলাল, বাগেরহাটে ছাত্রদল নেতা সাব্বির হাসান, কুমিল্লায় বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য সাইফুল ইসলাম হিরু ও হুমায়ুন কবির পারভেজ, লক্ষ্মীপুরে বিএনপির ইকবাল মাহমুদ জুয়েল, বেলাল হোসেন, ওমর ফারুক, যুবদলের আলমগীর হোসেন, আবদুল কাদের ও রাজু, ঠাকুরগাঁওয়ে বিএনপির জিল্লুর হোসেন, নাটোরে ইব্রাহিম খলিল, গাইবান্ধায় বিএনপির মতিয়ার পারভেজ ও মুছা আহমেদ, নীলফামারীর বিএনপি নেতা আশরাফ আলী, আবদুর রহমান, রাহেদুল ইসলাম, আ. খালেক, আ. মালেক, মাহিদুল ইসলাম, ছকিনউদ্দীন মেম্বার, বাবুল হোসেন ও স্বেচ্ছাসেবক দলের আজিজুল ইসলাম, নরসিংদীতে জেলা ছাত্রদলের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান নাহিদ প্রমুখ।

সাবেক এমপি সাইফুল ইসলাম হিরু ও লাকসাম পৌর বিএনপির সভাপতি হুমায়ুন কবির পারভেজ ২০১৩ সালের ২৭ নভেম্বর কুমিল্লা বিশ্বরোডের কাছ থেকে নিখোঁজ হন। জানতে চাইলে হুমায়ুন কবির পারভেজের ভাই গোলাম ফারুক যুগান্তরকে বলেন, আমার ভাইকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেয়া হয়েছে। সবার কাছে গিয়েছি, প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপও কামনা করেছি। এ ঘটনায় বাবা রঙ্গু মিয়া বাদী হয়ে মামলাও করেছেন, যা এখন সিআইডিতে আছে। ভাইয়ের শোকে বাবাও দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। পারিবারের সবাই ভাইয়ের অপেক্ষায় আছে।

২০১০ সালের ৮ অক্টোবর গাজীপুর এলাকা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিচয়ে তুলে নেয়া হয় চট্টগ্রামের বোয়ালখালী থানার করেলডাঙ্গা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বিএনপি নেতা নজরুল ইসলামকে। এ ব্যাপারে তার ভাই বর্তমান চেয়ারম্যান হামিদুল হক মান্নান বাদী হয়ে জয়দেবপুর থানায় একটি মামলা করেন।

জানতে চাইলে মান্নান বলেন, তার ভাইকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে সাদা পোশাকে গাজীপুর থেকে তুলে নিয়ে যায়। ওই ঘটনায় আমি জয়দেবপুর থানায় মামলা করি। ভাইয়ের সন্ধানে সংশ্লিষ্ট সব জায়গায় গিয়েছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত ভাইকে পাইনি।

গুমের অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতী মাহমুদ খান বলেন, এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন। র‌্যাব সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে যথাযথ আইন মেনে আসামি গ্রেফতার করে। যে কোনো আসামিকে আটকের পর তথ্য প্রমাণসহ নির্দিষ্ট সময়ে সংশ্লিষ্ট থানায় সোপর্দ করা হয়। এক্ষেত্রে র‌্যাব সদস্যরা সব সময়ই আইনের প্রতি সর্বোচ্চ শ্রদ্ধাশীল থাকেন।

তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অনেক সময় অনেককে তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠে। তবে এটি ঠিক নয়। এ ধরনের কয়েকটি ঘটনায় আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া ভুয়া সেসব সদস্যদের গ্রেফতারও করেছি। আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য একটি চক্র এসব ঘটনা ঘটিয়ে থাকে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। প্রত্যেকটি নিখোঁজের ঘটনায় তার পরিবার জিডি করে থাকে। কিন্তু কী কারণে তিনি নিখোঁজ হয়েছেন, বা কোথাও গেছেন কিনা- সে ব্যাপারে তথ্য থাকে না। পরবর্তীতে তদন্ত করতে গিয়ে এমনও দেখা গেছে, নিখোঁজদের অনেকে জঙ্গি তৎপরতায় জড়িয়েছে। অনেকে আবার দেনার দায়ে নিজেই আত্মগোপনের নামে নিখোঁজ হয়েছে।