হাওর বার্তা ডেস্কঃ নির্বাচন কমিশনের (ইলেকশন কমিশন বা ইসি) সংলাপে অংশ নিতে হোমওয়ার্ক (পূর্বপ্রস্তুতি) শুরু করেছে বিএনপি। ইসির আমন্ত্রণপত্র হাতে পাওয়ার পর সংলাপের এজেন্ডা চূড়ান্ত করা হবে। তবে এই সংলাপে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ (সবার জন্য সমান সুযোগ) তৈরির দিকেই গুরুত্ব দেবে দলটি। এ ব্যাপারে কার্যকর উদ্যোগ নিতে ইসিকে আহ্বান জানানো হবে। এমন উদ্যোগ নিতে বিদ্যমান আইনে যদি ইসির ক্ষমতা না থাকে, সেক্ষেত্রে প্রয়োজনে আইন সংস্কার বা উচ্চ আদালতের নির্দেশনা নেয়ার অনুরোধ জানানো হতে পারে। পাশাপাশি নির্বাচনে সেনা মোতায়েনসহ গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) কয়েকটি ধারা পরিবর্তনসহ ইসি শক্তিশালীকরণে বেশকিছু সুপারিশ করা হবে। এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে আরও কী কী প্রস্তাব থাকবে- তার একটি প্রাথমিক খসড়া প্রায় চূড়ান্ত করা হয়েছে। বিএনপির নীতিনির্ধারণী সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
বিএনপির একজন শীর্ষ নীতিনির্ধারক জানান, আগামী মাসের শুরু বা মাঝামাঝিতে সংলাপের আমন্ত্রণ জানানো হলে দলের পক্ষ থেকে সময় চাওয়া হতে পারে। কারণ ওই সময় খালেদা জিয়ার দেশে থাকার সম্ভাবনা ক্ষীণ। আগস্টের শেষদিকে চেয়ারপারসনের দেশে ফেরার কথা রয়েছে। ওই সময় বা সেপ্টেম্বরের শুরুতে সংলাপের আমন্ত্রণ জানানো হলে সময় চাইবেন না তারা। তবে আমন্ত্রণপত্র হাতে পাওয়ার পরই এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে।
এদিকে লন্ডন সফরের আগে দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে ইসির সঙ্গে সংলাপের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। এছাড়া সোমবার রাতে গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের দলের সিনিয়র নেতারা এ নিয়ে একটি বৈঠক করেন। সূত্র জানায়, সংলাপের আমন্ত্রণপত্র হাতে পাওয়ার আগে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল ইসির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারে। সুবিধাজনক সময়, বিশেষ করে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দেশে আসার পর তাদের সংলাপে ডাকার অনুরোধ জানানো হবে।
সংলাপে অংশ নেয়া প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এ মুহূর্তে ইসির সঙ্গে সংলাপের চেয়ে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সৃষ্ট সংকটের সমাধান হওয়া জরুরি। কারণ ইসি যতই শক্তিশালী হোক, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার না থাকলে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়ার সম্ভাবনা কম। আমাদের অতীত ইতিহাস তাই বলে। তাই সবার সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে নির্বাচনকালীন একটি নিরপেক্ষ সরকার গঠনে ক্ষমতাসীনরা উদ্যোগ নেবে বলে আশা করি।
তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক যে কোনো প্রক্রিয়ার সঙ্গে আমরা আছি এবং থাকব। ইসি বাস্তবতা উপলব্ধি করে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা নেবে বলে আমরা আশা করি। গণতান্ত্রিক দল হিসেবে বিএনপি সেই নির্বাচনে যে কোনো সহযোগিতা করতে প্রস্তুত আছে। ইসির আমন্ত্রণপত্র পাওয়ার পর সংলাপে যাওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে জানান ফখরুল।
এদিকে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপের খসড়া তৈরি করছে দলটি। বিএনপির সিনিয়র কয়েক নেতা, ইসির সাবেক এক সচিব প্রাথমিক খসড়া প্রায় চূড়ান্ত করছেন। সংলাপের আমন্ত্রণ হাতে পাওয়ার খসড়া নিয়ে বৈঠক করবেন সিনিয়র নেতারা। এরপর দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে টেলিফোনে খসড়ার ওপর প্রয়োজনীয় পরামর্শ নেয়ার পর তা চূড়ান্ত করা হবে।
প্রাথমিক খসড়া থেকে জানা গেছে, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) ‘ল ইনফোর্সিং এজেন্সির’ সংজ্ঞায় অন্যান্য বাহিনীর সঙ্গে ‘ডিফেন্স সার্ভিস অব বাংলাদেশ’ পুনঃস্থাপন করার সুপারিশ করা হবে। ২০০৯ সালে আরপিওর সংশোধনীতে তা বাদ দেয়া হয়। নির্বাচনের সাত দিন আগ থেকে সেনা মোতায়েন এবং তাদের পাশাপাশি নির্বাচন কমিশন কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেরিয়াল (বিচারিক) ক্ষমতা দেয়ার সুপারিশ করা হবে।
আগামী জাতীয় নির্বাচনে যাতে ইভিএম ব্যবহার না করা হয়, সেজন্য শক্ত যুক্তি তুলে ধরবে বিএনপি। এ লক্ষ্যে প্রতিবেশী ভারতসহ বিভিন্ন দেশে ইভিএম ব্যবহারে নেতিবাচক বিষয়গুলো তুলে ধরা হবে। ভোটার তালিকা হালনাগাদের পাশাপাশি প্রবাসীদেরও এ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা এবং ভোট কেন্দ্রে ছবিসহ ভোটার তালিকা সরবরাহ করার প্রস্তাব থাকবে তাদের সুপারিশে। কমিশনকে দ্রুত একটি কমিটি গঠন করে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে যাদের রাজনৈতিক আনুগত্য রয়েছে, তাদের চিহ্নিত করে প্রত্যাহার করা এবং ভবিষ্যতে তাদের নির্বাচনী কার্যক্রম থেকে বিরত রাখার দাবি রয়েছে বিএনপির খসড়ায়।
দলটির প্রাথমিক সুপারিশমালায় আরও রয়েছে, নতুন কর্মকর্তা নিয়োগে পাঁচ বছর একই জেলায় ছিলেন, এমন কর্মকর্তাদের ওই জেলায় নিয়োগ দেয়া যাবে না। একইভাবে নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সময় প্রত্যেক উপজেলা এবং থানায় কর্মরত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের প্রত্যাহার করে নতুন কর্মকর্তা নিয়োগের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নির্বাচনকালীন (নির্বাচন তফিসল ঘোষণার তারিখ থেকে নির্বাচিত নতুন সরকার দায়িত্ব না নেয়া পর্যন্ত) নির্বাচন সংশ্লিষ্ট মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বদলি ও পদায়ন সম্পূর্ণভাবে যাতে নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারভুক্ত থাকে তা নিশ্চিত করা। রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী এজেন্ট ও পোলিং এজেন্টদের প্রশিক্ষণ এবং ভোট প্রদান সংক্রান্ত প্রচারের কার্যকর ব্যবস্থা করার অনুরোধ জানানো হবে।
এছাড়া নির্বাচনের সময় স্বরাষ্ট্র, অর্থ, তথ্য, জনপ্রশাসন, স্থানীয় সরকার, শিক্ষা, পররাষ্ট্র এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় যাতে ইসির চাহিদা অনুযায়ী কার্যকরী ব্যবস্থা নেয়- তা নিশ্চিত করার কথা রয়েছে খসড়ায়। রাজনৈতিক দলের নেতা কিংবা দলের প্রতি আনুগত্য আছে, এমন কোনো সংস্থার প্রতিনিধিকে পর্যবেক্ষক হিসেবে নিয়োগ না দেয়া, তফসিল ঘোষণার ত্রিশ দিন আগে পর্যবেক্ষকের তালিকা প্রণয়ন এবং সাত দিন আগে তাদের নাম ও পরিচয় তুলে ধরার প্রস্তাব দেয়া হবে।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, ইসির আমন্ত্রণ পাওয়ার পর যাওয়া বা সময় চাওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে। তবে ইসির সংলাপে দলের পক্ষ থেকে কী কী সুপারিশ করা হবে তা নিয়ে কাজ চলছে। একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি কিভাবে সম্ভব সেদিকেই গুরুত্ব দেয়া হবে।
তিনি বলেন, নির্বাচনের আগে এবং নির্বাচনের দিন যাতে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ বজায় থাকে, সেজন্য বিভিন্ন প্রস্তাব দেয়া হবে। পাশাপাশি ইসিকে শক্তিশালী করার জন্য যেসব আইন সংস্কার দরকার সে ব্যাপারেও সুপারিশ করা হবে।
এদিকে লন্ডন সফরে যাওয়ার একদিন আগে গুলশানের নিজ বাসায় স্থায়ী কমিটির সঙ্গে বৈঠক করেন খালেদা জিয়া। ওই বৈঠকে এক নেতা ইসির সংলাপের বিষয়টি উত্থাপন করেন। তিনি বলেন, চেয়ারপারসন দেশে না থাকলে ইসির আমন্ত্রণ পেলে দল কী সিদ্ধান্ত নেবে। তারা সংলাপে যাবে কিনা। এ সময় এক নেতা জানান, চেয়ারপারসন দেশে না থাকলে আমাদের সময় নেয়া উচিত। আরেকজন বলেন, ইসি যদি সময় না দেন। জবাবে ওই নেতা জানান, সেক্ষেত্রে চেয়ারপারসনের সঙ্গে আলাপ করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
স্থায়ী কমিটির সিনিয়র এক সদস্য বলেন, সংলাপের বিষয়ে ইসি বিএনপিকে কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে, তার ওপর সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। ইসি যদি নিয়ম রক্ষার জন্য বিএনপির সঙ্গে সংলাপ করতে চায়, তাহলে বিএনপিরও সেভাবেই অংশ নেয়া উচিত। সংলাপ বর্জন না করে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে আমাদের যুক্ত থাকা উচিত। সেক্ষেত্রে আমরা দ্বিতীয় বা তৃতীয় সারির নেতাদের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল পাঠাতে পারি। তারা দলের মতামত সেখানে তুলে ধরবে। তার এমন বক্তব্য সমর্থন করেন বৈঠকে উপস্থিত প্রায় সব সদস্যই। তবে সংলাপের ব্যাপারে ইসি বিএনপিকে গুরুত্ব দিলে সেক্ষেত্রে উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল সেখানে যাবে বলে ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়।