হাওর বার্তা ডেস্কঃ ঋতুবৈচিত্র্যের বাংলা বারো মাসকে ছয়টি ভাগে বিভাজন করে ছয়টি ঋতুতে ভাগ করা হলেও বসন্ত ও বর্ষা ঋতু বিশেষ করে বর্ষা বাংলা ভাষার কবিদের মন ও আবেগকে যেভাবে আলোড়িত করে; আর অন্য কোনো ঋতু তা পারে বলে মনে হয় না। যদিও বাংলা ভাষার কবিরা সব ঋতুকে নিয়ে কবিতা লিখে থাকেন, তবু বর্ষার আবেদন সবার কাছে অন্যরকমের, অন্য মেজাজের। বাংলা সাহিত্যের লেখকদের লেখনীতে বাংলার ষড়ঋতু মূর্ত হয়ে থাকবে চিরকালই। বাংলা ভাষাভাষী কবিদের বর্ষা কিভাবে আন্দোলিত করেছে তা নিয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করব।
এ যুগের কবিরা কবিতা নির্মাণে ভাষা ও সাহিত্যতত্ত্বের যেসব উপাদান প্রয়োজন যেমন শব্দ, ছন্দ, লয়, গীত, অলংকার, প্রতীকী ব্যঞ্জনা, অনুপ্রাসের সম্মিলনের মাধ্যমে কবিতা নির্মাণের প্রয়োজনীয় উপাদান কবিতায় সন্নিবেশিত করেই কবিতা নির্মাণের চেষ্টা করেন। তারা মনে করেন শুধু অনুভূতি প্রকাশ হলেই কবিতা হবে না। এর মধ্যে থাকতে হবে মাত্রাবৃত্ত, অক্ষরবৃত্ত, স্বরবৃত্ত ও ছন্দবৃত্ত, বাক্য ও অলংকরণের উপাদানও। তাই আধুনিক বাংলা কবিতায় কবিরা প্রতিটি বিষয়ই মূর্ত করে তোলেন কবিতার চরণে চরণে, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। বিশেষ করে বর্ষা বন্দনাতো থাকবে অবধারিতভাবেই। বিষয়বস্তু হিসেবে বর্ষা কমবেশি সব কবির কবিতায় উপস্থাপিত হয়ে আসছে। শুধু উপস্থাপিত হয়ে আসছেইবা বলছি কেন, যেন একেবারে জীবন্ত বিষয়বস্তু হিসেবেই স্থান করে নিয়েছে। তাই আমি আজকের আলোচিত নিবন্ধে বিভিন্ন সময়ের কবিতায় বর্ষা ঋতুটি কিভাবে মূর্ত হয়েছে, তা নিয়েই সংক্ষিপ্ত আলোচনা করব।
বর্ষা তার ঝরঝর নির্ঝরণীতে আমাদের মনকে যুগপৎ আনন্দ-বেদনা ও বিরহকাতরতায় সিক্ত করে তুলে। মানুষের মনের কথাই শুধু বলি কেন, বর্ষা প্রাণরসে জাগিয়ে তুলে আমাদের প্রকৃতিকে। সবুজে সবুজে ভরিয়ে দেয় আমাদের পরিবেশ প্রতিবেশও। গ্রীষ্মের দাবদাহে মানুষের মন যখন অস্থির হয়ে ওঠে, মানুষ ব্যাকুল বর্ষা বন্দনায় মত্ত হয়। যেন ‘কখন আসবে বর্ষা কখন জুড়াবে প্রাণ’ কাব্যিক ব্যঞ্জনার মতো। তাই বর্ষা এলে তার প্রতিটি ক্ষণ অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে কবিদের লেখা ও লেখনীতে। এজন্যই কবি এমন করে বলতে পারেন, ‘এমন দিনে তারে বলা যায়/এমন ঘনঘোর বরিষায়। কবিদের বেলাই শুধু নয়, বর্ষার আবেদন আমাদের জীবনেও নানামুখী। যে আবেদন আমাদের মধ্যযুগের বাংলা কবিতা ও সমসাময়িক কবিদের কবিতায় অনুরণিত। চন্ডীদাস, বিদ্যাপতি গবিন্দ দাস কিংবা কালিদাসের কবিতায় বর্ষা সমার্থক হয়ে ওঠে। তারা তাই বর্ষাকে কবিতার, কবিতাকে বর্ষার পরিপূরক করে তুলেছেন, তাদের কবিতার বিভিন্ন কাব্যিক ব্যঞ্জনা অনুপ্রাস ও দ্যোতনায়।
বর্ষা এলেই মানুষ ভালোবাসার অজানিত এক আহ্বানের উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। তাই অনেকেই বর্ষাকে ভালোবাসার ঋতু হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকেন। কেউ কেউ আবার বলেন, বর্ষা নয়, বসন্তই হলো প্রেমের ঋতু। তবে এ বিতর্কে শামিল না হয়ে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, বর্ষাকেই সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাববাদী মানুষ প্রেমের ঋতু হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। কেননা এ ঋতুতেই প্রকৃতিতে লাস্যময়তার সঙ্গে সঙ্গে মানব মনেও প্রেমের জোয়ার আনে। সেই জোয়ারে ভাসতে ভাসতেই কবিরা তাদের বিভিন্ন কবিতায় প্রকাশ করে থাকেন প্রেমের বিবিধ ব্যাকুলতা। তাই বর্ষা কখনো অবিমিশ্র প্রেমের অনুঘটক, কখনো কামনা-বাসনা আকুলতার সরব ভাষা হয়ে দাঁড়ায়। সেজন্যই বর্ষা গান ও গদ্য সাহিত্যে গরজিত মেঘ হলেও কবিতায় বর্ষা ধরা দেয় পূর্ণাঙ্গ ব্যাপ্তিতে, বিভিন্ন ব্যঞ্জনা ও গুঢ়ার্থে। এভাবেই কালিদাসের মেঘদূত কবিতায় রামগিরি পর্বতের ওপারে নির্বাসিত শূন্য ও একাকিত্ব জীবনে মেঘ যখন উঁচুগিরির ওপর দিয়ে ডানা মেলে ওড়ে যেত; তখন বিরহি যক্ষের মনে জাগত প্রিয়া বিরহের যাতনা। তাই তিনি বিশদ ব্যাকুলতা বর্ণনা করে মেঘকে দূত করে পাঠাতেন প্রিয়ার কাছে। এভাবেই মধ্যযুগের কবিতায় বর্ষা এসেছে রাধাকৃষ্ণের প্রেমের ইন্দ হিসেবে। মধ্যযুগের কবিরা বর্ষাকে অভিসার ও বিরহ পর্বে প্রেমবহ্নিতে ঘৃতের ছিটার হিসেবে কল্পনা করেছেন। একই ধারায় চন্ডীদাস তার প্রেম বিরহকাতরতার কথা প্রকাশ করেন তার কবিতায়—
এঘোর রজনি মেঘের ঘটা/কেমনে আইল বাটে
আঙিনার মাঝে বধূয়া ভিজিছে/দেখিয়া পরাণ ফাটে।
আর বিদ্যাপতির রচনায়ও বর্ষার বিরহকাতরতা কম নয়–
এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর/ এ ভরা ভাদর মাহ বাদর
শূন্য মন্দির মোর।
ওপরের দুটি কবিতার নির্মাণ গঠন ও অর্থগত দিক বিবেচনায় বলা যায়, বর্ষার বিচিত্র ও সার্থক ব্যবহার হয়েছে মধ্যযুগে বাংলা কবিতায়। শুধু প্রেম বিরহেই কেন কবিদের কবিতায় বর্ষা এসেছে প্রকৃতির রূপ-সৌর্য বর্ণনায়, কখনো শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিময় নষ্টালজিয়ায়। আমরা যদি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতার দিকে দৃষ্টি ফেরাই, তাহলে দেখতে পাই তিনি বর্ষাকে কল্পনা করেছেন প্রকৃতির অরূপ শক্তি হিসেবে। তার কবিতায় বর্ষার প্রকৃতি ও মানব প্রকৃতি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। যার সঙ্গে একাত্ব ঘোষণা করেছেন দেবতাগণও। মধুসূদন দত্তের ‘বর্ষাকাল’ কবিতায় বর্ষার রূপকল্প বর্ণনা হয়েছে এভাবেই।
গভীর গর্জন করে সদা জলধর/উথলিল নদ-নদী ধরণীর উপর
রমণী রমন লয়ে/সুখে কেলি করে /দানবাদী দেব যক্ষ সুখিত অন্দরে।
এখন আমি দৃষ্টি ফেরাতে চাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার দিকে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার কবিতায় বর্ষাকে উপস্থাপন করেছেন বিভিন্ন আঙ্গিকে। তিনিই যেন কবিতার মাধ্যমে বর্ষাকে পূর্ণতা দিলেন। তার কবিতায় বর্ষার বিচিত্র রূপ প্রকাশ পায় বর্ষাবন্দনা রূপে। বর্ষার ঘনকালো মেঘ আকাশকে ঢেকে দিয়ে গুরু গর্জনে যখন নেমে আসেন বৃষ্টির অবিরাম ধারা; সে বৃষ্টির ধারা তাকে হাত ধরে নিয়ে যায় শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিময় দিনগুলোতে। তাই তার কবিতার শরীরে চোখ বুলালে জেগে ওঠে প্রেমের উদ্রেক। রবীন্দ্রনাথের বহু জনপ্রিয় কবিতার মধ্যে অন্যতম ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর’, যা বর্ষার দিনে কবি মনকে সিক্ত করে অতীত রোমন্থনে। তাই বুঝি বৃষ্টি এলেই দুরন্ত শৈশব তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে, আর কবি আক্রান্ত হন নষ্টালজিয়ায়; তখনই তার কবিতায় ঝরে পড়ে স্মৃতিকাতরতার বৃষ্টি—
কবে বৃষ্টি পড়েছিল, বান এলো যে কোথা
শিব ঠাকুরের বিয়ে হলো কবেকার সে কথা।
সে দিনও কি এমনিতরো মেঘের ঘনঘটা
থেকে থেকে বাজ বিজুলি দিছিল কি হানা।
বর্ষা এলেই কবিকে তাড়িত করে অন্য এক আবেগ। বৃষ্টির নির্ঝরণীতে অধিক যেন ব্যাকুল হয়ে ওঠে আবেগতাড়িত কবি মন। জীবন, জীবনের বন্ধন, জগৎ সংসারের পিছুটান তখন কবির কাছে গৌন হয়ে ওঠে। অঝোরধারার বৃষ্টি কবির কাছে প্রেমিকার কান্না বলে হয়। তাই কবি বর্ষার নির্ঝরণীতে ধূয়ে-মূছে দিতে চান যাবতীয় দুঃখ, যাতনা, বিষাদময় ক্লেদাক্ততা। এজন্যই হয়তো কবি তার বর্ষা মঙ্গল কবিতায় ফুটিয়ে তুলতে পারেন এত কাব্যব্যঞ্জনা। বর্ষার ঘনঘটায় কবি রবীন্দ্রনাথ যুগপৎ আনন্দ-বেদনায় উদ্বেলিত হয়ে ওঠেন। যখন প্যারেডের তালে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছে, এতে তিনি যেমন পুলকিত হয়েছেন, তেমনি আবার মেঘের ঘনঘটা দেখে শঙ্কিতও হয়েছেন। এ কারণেই রবীন্দ্র কাব্য ভাবনায় বারবার ফিরে এসেছে বর্ষা বিভিন্ন আঙ্গিক ও সৌকর্যে। তাই হয়তো অনেকেই রবীন্দ্রনাথকে বর্ষার কবি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
এইতো গেল বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের কথা। বাংলা ভাষাভাষী কবিরা প্রত্যেকেই বর্ষাকে বেশি করে আত্মস্থ করার প্রয়াস চালিয়েছেন। তেমনি আরো বেশি প্রয়াস চালিয়েছে আমাদের বিদ্রোহী কবি একই সঙ্গে প্রেমের কবি কাজী নজরুল ইসলামকে। তার কবিতায়ও বর্ষা ধরা দিয়েছে বিভিন্ন প্রতীকী ব্যঞ্জনায়। বর্ষার মেঘ তার বিরহ-বেদনাকে আরো বেশি উসকে দিয়েছে। যা কবির বাদল রাতের কবিতায় মূর্ত হয়ে ওঠে—
বাদল রাতের পাখি
ওড়ে চল যেথা আজো ঝরে জল, নাহিক ফুলের ফাঁকি।
তিনি তার কবিতার মাধ্যমে বাদল রাতের পাখিকে বন্ধু ভেবে আর বিরহের সঙ্গে নিজের বিরহ একাকার করতে চেয়েছেন। তিনি বর্ষাকে ভেবেছেন তার দুঃখ-যাতনার সারথি হিসেবে। সে কারণেই হয়তো বর্ষার বিদায় কবিতায় কবি মনের যত আকুতি ঝরে পড়ে।
‘যেথা যাও তব মুখর পায়ের বরষা নূপুর খুলি
চলিতে চলিতে চমকে ওঠনা কবরী ওঠে না দুলি
যেথা রবে তুমি ধ্যানমগ্ন তাপসিদী অচপল
তোমায় আশায় কাঁদিবে ধরায়, তেমনি ফটিক জল’।
একইভাবে পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের বর্ষার কবিতা বন্দনা বিয়ের কথা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। তাছাড়া আমাদের স্বাধীনতার কবি শামসুর রাহমানের বৃষ্টি বন্দনায় অনাবৃষ্টি কবিতায় লিখেছেন-
টেবিলে রয়েছি ঝুঁকে, আমিও চাষির মতো বড়
ব্যাঘ্র হয়ে চেয়ে আছি খাতার পাতায়,
যদি জড়ো হয় মেঘ, যদি ঝরে ফুল বৃষ্টি
অলস পেনসিল হাতে বকমার্কা। পাতাজুড়ে আকাশের নীল।
তেমনিভাবে আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হক, কবি ওমর আলী, নির্মলেন্দু গুণ, আসাদ চৌধুরীসহ বাংলাদেশের সমকালীন কবিদের কবিতায় বর্ষাবন্দনা ফুঠে ওঠেছে অনবদ্যভাবে। এমন কোনো কবিকে খুঁজে পাওয়া যাবে না বর্ষার ঘনকালো মেঘ তার মনকে আচ্ছন্ন করেনি।
কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা তার বৃষ্টি পড়ে কবিতার মাধ্যমে বর্ষার বৃষ্টিকে নানা আঙ্গিকে প্রকাশ করেছেন—
বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টি পড়ে/মনে মনে বৃষ্টি পড়ে
বৃষ্টি পড়ে বৃষ্টি পড়ে/বনে বনে বৃষ্টি পড়ে
মনের ঘরে চরের বনে/নিখিল নিঝুম গাও গেরামে
বৃষ্টি পড়ে বৃষ্টি পড়ে/বৃষ্টি পড়ে বৃষ্টি পড়ে
কবি হাসান হাফিজ তার ‘বর্ষাভেজা পদাবলীতে’ বর্ষাকে আনন্দ-বেদনা উভয়রূপেই কল্পনা করেছেন তিনি তার কবিতায় শ্রাবণের বর্ণনা করেছেন এভাবে—
শ্রাবণে বিরহ শুধু নয়, আগুনও রয়েছে
সেই তাপে শুদ্ধ হবে অসবর্ণ মিল পিপাসা।
ঘন বর্ষার শ্রাবণের মেঘ যখন দলবেঁধে আকাশে ওড়ে বেড়ায় সে মেঘের সাথেও কবি, অকবি সকল ভাবপ্রবণ মানুষের মনও কল্পনার জগতে ওড়ে বেড়ায়। তখন মানুষের মনের সুখ, দুখ, আনন্দ-বেদনাগুলো যেন মূর্ত হয়ে ওঠে মেঘের শরীরে। দক্ষিণের আকাশে জমাট বাঁধা কালো মেঘ যখন বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে, তখন মনে হয় বৃষ্টি বুঝি তার কান্না হয়ে ঝরে পড়ছে। তাই সে তার জীবনের সব কষ্ট ও মনস্তাপকে বৃষ্টির সঙ্গে একাকার করে ফেলে। সেই মুহূর্তে বর্ষার বৃষ্টিকে বড় বেশি সমব্যথি মনে হয় একজন বিরহকাতর মানুষের কাছে, সে কবি হোক বা না-ই হোক।