হাওর বার্তা ডেস্কঃ খবরটি অবাক করার মতো। ইউনেসকোর নতুন এক পলিসি পেপার বা নীতিপত্রে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রায় ১ কোটি শিশু-কিশোর-তরুণ শিক্ষালয়ের বাইরে আছে। এর মধ্যে ৬-১১ বছর বয়সী শিশু রয়েছে ৮ লাখ, ১২-১৪ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরী ২০ লাখ এবং ১৫-১৭ বছর বয়সী তরুণ ৭১ লাখ। মাধ্যমিক শিক্ষাপর্ব সমাপ্তির বয়স ১৭ বছর ধরে এই পরিসংখ্যান দিয়েছে ইউনেসকো ইনস্টিটিউট ফর স্ট্যাটিসটিকস (ইউআইএস)। এইচএসসি বা উচ্চমাধ্যমিককে শিক্ষার স্তর ধরলে শিক্ষালয়ের বাইরে থাকা তরুণের সংখ্যা আরও অনেক বেশি হবে।
ইউনেসকোর মতে, বাংলাদেশে ১৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী বিদ্যালয়ের বাইরে থাকা তরুণের সংখ্যা (৭১ লাখ) বিশ্বে তৃতীয় বৃহত্তম। ভারতে ৪ কোটি ৬৮ লাখ, পাকিস্তানে ৯৮ লাখ। ১২-১৪ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরীর সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে পঞ্চম বৃহত্তম (২০ লাখ)। প্রথম চারটি দেশ হলো ভারত (১ কোটি ১১ লাখ), পাকিস্তান (৫৪ লাখ), ইথিওপিয়া (৫৪ লাখ) ও ইন্দোনেশিয়া (২২ লাখ)। তবে ৬-১১ বছর বয়সী শিশুদের সূচকে বাংলাদেশ কিছুটা ভালো অবস্থানে আছে।
আমরা উন্নয়নের যত ফাঁকা বুলিই আওড়াই না কেন, এখনো যে সবার মৌলিক-মানবিক চাহিদা পূরণ করতে পারিনি, ঢাকার ভিভিআইপি সড়কের পাশের বস্তিগুলোর হতশ্রী চেহারা তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।
বাংলাদেশ শিক্ষা পরিসংখ্যান ২০১৬ অনুযায়ী, ২ কোটি ৮৭ লাখ শিশু-কিশোর-তরুণ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। প্রাথমিক পর্যায়ে ভর্তির হার ৯৭ দশমিক ৯৬ শতাংশ এবং মাধ্যমিকে ৭৩ দশমিক ১০ শতাংশ। কিন্তু প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে যারা ভর্তি হয়, তাদের সবাই শেষ ধাপ পর্যন্ত যেতে পারে না, আগেই ঝরে পড়ে। আবার মাধ্যমিক পাঠ যারা শেষ করে, তাদের একটি বড় অংশ উচ্চমাধ্যমিকের দরজা পার হতে পারে না।
সরকারের দাবি, প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে। শিক্ষার জন্য খাদ্য কর্মসূচির অধীনে দারিদ্র্যপ্রবণ এলাকার বিদ্যালয়গুলোকে শিক্ষার্থীদের দুপুরে খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে মেয়েদের উপবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। এসব সত্ত্বেও পরিস্থিতির যে খুব বেশি উন্নতি হয়নি, নিচের পরিসংখ্যানই তার প্রমাণ।
চলতি বছর প্রাথমিক সমাপনী (ইবতেদায়ি মাদ্রাসাসহ) পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৩৪ লাখ। আর এসএসসি, কারিগরি ও কামিল পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১৭ লাখ ৮৬ হাজার। অন্যদিকে এইচএসসিতে তা এসে দাঁড়িয়েছে ১১ লাখ ৮৩ হাজারে। অর্থাৎ প্রাথমিক সমাপনী থেকে এইচএসসির ব্যবধান প্রায় ২২ লাখ।
ইউনেসকো মনে করে, শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া বা বিদ্যালয় ত্যাগের প্রধান কারণ দারিদ্র্য। সংস্থাটির মতে, বিশ্বপরিসরে সব শিক্ষার্থীকে (যারা পাঠ সমাপন করতে পারেনি, তাদের বোঝানো হয়েছে) দুই বছর বেশি বিদ্যালয়ে রাখা গেলে প্রায় ৬ কোটি মানুষ দারিদ্র্যমুক্ত হতে পারে। আর যদি সবাই মাধ্যমিক পর্যন্ত পাঠ শেষ করতে পারে, তাহলে ৪২ কোটি মানুষ দারিদ্র্যমুক্ত হবে। কিন্তু বাংলাদেশে সংবিধানে স্বীকৃত সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা আমরা আজও নিশ্চিত করতে পারিনি।
বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার কত? সরকারের দাবি, ৭১ শতাংশ। অথচ গত বছরের ১৮ জানুয়ারি প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান জাতীয় সংসদে বলেছিলেন, ২০১৫ সালের পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী দেশে শিক্ষার হার ৬১ শতাংশ। মাত্র দেড় বছরে সেই হার ১০ শতাংশ কীভাবে বাড়ল? মন্ত্রী মহোদয়ের বক্তব্যের পর প্রথম আলোতে তখন লিখেছিলাম, ‘৩৯ শতাংশ নিরক্ষরের দেশে’। অর্থাৎ মধ্যম আয়ের দেশ হতে যাওয়া বাংলাদেশের কোনো উন্নয়ন পরিকল্পনায় তাদের জায়গা নেই।
বিবিএসের জরিপ অনুযায়ী, ২০১২ সালে ১৫ বছরের বেশি বয়সী ব্যক্তিদের সাক্ষরতার হার ছিল ৬০ দশমিক ৭ শতাংশ, ২০১১ সালে ছিল ৫৮ দশমিক ৮ শতাংশ, ২০১০ সালে ৫৮ দশমিক ৬ শতাংশ। আর ২০০৯ সালে ছিল ৫৮ দশমিক ৪ শতাংশ। বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী, পাঁচ বছরে সাক্ষরতার হার আমরা বাড়াতে পেরেছি মাত্র ৩ শতাংশ। এভাবে চললে, দেশটি পুরো নিরক্ষরতামুক্ত করতে একুশ শতক পার করতে হবে। এর পাশাপাশি যদি আমরা প্রতিবেশী দেশগুলোর দিকে তাকাই দেখব, ভারতে সাক্ষরতার হার ৭৪ দশমিক ৪ শতাংশ, নেপালে ৬৬ শতাংশ, ভুটানে ৬৪ দশমিক ৯ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় ৯৮ দশমিক ১ শতাংশ, আমাদের পেছনে আছে পাকিস্তান ৫৫ শতাংশ ও আফগানিস্তান ২৪ শতাংশ। মিয়ানমারের সাক্ষরতার হার ৮৯ শতাংশ।
তাহলে কীভাবে আমরা উন্নয়নের রোল মডেল হলাম?
সাক্ষরতা একটি দেশের উন্নয়নের আবশ্যিক শর্ত। পৃথিবীতে এমন একটি দেশও নেই যে শতভাগ সাক্ষর হয়েও গরিব। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ যে নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছিল, তাতে শিক্ষা ও বিজ্ঞান অনুচ্ছেদে বলা হয়: ‘২০১০ সালের মধ্যে প্রাথমিক স্তরে নিট ভর্তি ১০০ শতাংশে উন্নীত করা এবং ২০১৪ সালের মধ্যে দেশকে নিরক্ষরতামুক্ত করা হবে।’ এখন ২০১৭ সালের মাঝামাঝি। অর্থাৎ সময়সীমার আড়াই বছর পরও সরকার তার প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারেনি।
ইউনেসকোর মতে, শিক্ষা হলো দারিদ্র্য বিমোচনের প্রধান শর্ত। কিন্তু আমরা যে শিক্ষাব্যবস্থা চালু রেখেছি, সেই শিক্ষা আদৌ দারিদ্র্য বিমোচন করতে পারছে কি?
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপ ২০১৫ অনুযায়ী, দেশে কর্মক্ষম ২৬ লাখ ৩০ হাজার মানুষ বেকার। এর মধ্যে পুরুষ ১৪ লাখ, নারী ১২ লাখ ৩০ হাজার, যা মোট শ্রমশক্তির ৪ দশমিক ৫ শতাংশ। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে ১৫ লাখ তরুণ-তরুণী এখন বেকার অবস্থায় রয়েছেন। অন্যদিকে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) প্রতিবেদনের মতে, বাংলাদেশের ৪৭ শতাংশ স্নাতকই বেকার। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) বলছে, দেশে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী বেকার যুবকের সংখ্যা ১ কোটি ৩২ লাখ। বাংলাদেশে এখন ১০ কোটি ৫৬ লাখ মানুষ কর্মক্ষম, যা মোট জনগোষ্ঠীর ৬৬ শতাংশ। আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠনের (আইএলও) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৪ সালে বাংলাদেশে বেকারত্ব বৃদ্ধির হার ৪ দশমিক ৩৩ শতাংশ। দেশে বেকারের সংখ্যা ৩ কোটি। সংস্থাটির মতে, বেকারত্ব বাড়ছে এমন ২০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের স্থান ১২তম।
সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্ট রিসার্চ (সিডার) ‘কর্মসংস্থান ও শ্রমবাজার পর্যালোচনা ২০১৭’ শিরোনামে যে সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশ করে, তাতে দেখা যায়, বাংলাদেশে বেকারত্বের হার উচ্চশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যেই সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশে এখন ৪ কোটি ৩৪ লাখ মানুষের বয়স ১৫ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে। তাদের মধ্যে প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ এ মুহূর্তে পড়াশোনা করছে না, কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ নিচ্ছে না এবং কোনো কাজকর্মও করছে না। অর্থাৎ, এই বিপুলসংখ্যক তরুণ-যুবা জীবনযাপনের জন্য সম্পূর্ণভাবে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। বিশেষজ্ঞরা এদের নাম দিয়েছেন ‘নিষ্ক্রিয়’। এই নিষ্ক্রিয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয়ে দুর্ভাগা হলো ‘উচ্চশিক্ষিত’ অংশ।
ওই প্রতিবেদনে আরও জানানো হয়, যাঁর ‘শিক্ষাগত যোগ্যতা’ যত বেশি, তাঁর চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা তত কম। যাঁরা দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন, তাঁদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। আর যাঁরা অনার্স-মাস্টার্স পাস করেছেন, তাঁদের মধ্যে বেকারত্বের হার ১৬ দশমিক ৪ শতাংশ।
এর পাশাপাশি দেশের সীমানার বাইরে তাকালে আমরা কী দেখি? দেশে কাজ না পেয়ে হাজার হাজার তরুণ বিদেশে গিয়ে দুর্বিষহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছে। গত শুক্রবার প্রথম আলোর প্রধান শিরোনাম ছিল, ‘বাংলাদেশিদের অবৈধ পথে ইউরোপ যাত্রা বাড়ছে।’ এতে বলা হয়, ‘ইউরোপে পাড়ি দিতে গিয়ে তুরস্কে প্রায় দুই হাজার বাংলাদেশি আটকে পড়েছেন। চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালিতে গেছেন অন্তত সাড়ে পাঁচ হাজার বাংলাদেশি।’
অন্যদিকে মালয়েশীয় সরকার যে দেড় হাজার অবৈধ অভিবাসীকে কারাগারে পাঠিয়েছে, তার অর্ধেকই বাংলাদেশি। দেশটিতে সরকারি হিসাবে আড়াই লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক আছেন বলা হলেও প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি। তুরস্কে আটকা পড়া কিংবা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বৈধ কাগজপত্র ছাড়া বসবাস করা বাংলাদেশিদের বেশির ভাগই উচ্চশিক্ষিত। দেশে কাজের সুযোগ থাকলে তাঁরা কেউ এভাবে অনিশ্চিত জীবন বেছে নিতেন না। একদিকে আমাদের শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা দেশে কাজ পাচ্ছেন না, অন্যদিকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বিদেশ থেকে উঁচু বেতন দিয়ে দক্ষ কর্মী নিয়ে অাসছে। অর্থাৎ আমরা যোগ্য লোকবল তৈরি করতে পারিনি।
আমাদের শিক্ষার প্রধান দুর্বলতা এখানেই।
এই যে বিপুলসংখ্যক ছেলেমেয়ে শিক্ষালয়ের বাইরে আছে, লেখাপড়ার সুযোগ না পেয়ে তারা মাদকসহ নানা রকম অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে, এই যে লাখ লাখ শিক্ষিত তরুণ-তরুণীর জীবন থেকে শ্রেষ্ঠ সময়টি হারিয়ে যাচ্ছে, তাদের নিয়ে কোনো সরকার আদৌ ভাবছে বলে মনে হয় না। ভাবলে শিক্ষা ও কর্মসংস্থান নিয়ে তাদের সমন্বিত ও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকত। নিছক কাগুজে পরিকল্পনা নয়। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বলছেন, বর্ধিত জনসংখ্যা সমস্যা নয়, সম্পদ। কিন্তু সেই জনসংখ্যাকে সম্পদে পরিণত করার ভাবনা তাঁদের নেই। থাকলে শিক্ষা খাতে বরাদ্দের হার কমিয়ে তাঁরা অনুৎপাদনশীল খাতে বরাদ্দ বাড়াতেন না। মানবসম্পদকে অগ্রাধিকার দিলে রাজনৈতিক দলগুলো শিক্ষা, বেকারত্ব ইত্যাদি নিয়েই সুস্থ বিতর্ক করত। ‘নির্বাচন কার অধীনে হবে’ ইত্যাদি নিয়ে বছরের পর বছর অসুস্থ বিতর্কে মাতত না। তারা সমস্যা না এড়িয়ে সত্যের মুখোমুখি হতো।
আমাদের দেশে যদি শিক্ষালয়ের বাইরে ১ কোটি শিশু-কিশোর-তরুণ থাকে, আর যেসব তরুণ-তরুণী বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নিয়েছেন, তাঁদের সিংহভাগ যদি নিষ্ক্রিয় থাকতে বাধ্য হন এবং আমরা যদি তাঁদের কোনো কাজে লাগাতে না পারি, তাহলে দেশের উন্নয়নটা কী হলো? আমরা কি সামনে এগোচ্ছি, না পেছনে যাচ্ছি?