রসগোল্লার উৎপত্তি নিয়ে বিতর্ক

রসগোল্লার উৎপত্তি কোথায়? বাংলায় না ওড়িশায়? এই নিয়ে এখন নতুন এক ‘পেটেন্ট বিতর্ক’ শুরু হতে যাচ্ছে ভারতে।

পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কলকাতার ময়রা নবীনচন্দ্র দাশ ১৮৬৮ সালে প্রথম রসগোল্লা উদ্ভাবন করেন বলে অনেক ইতিহাসবিদই স্বীকৃতি দিয়েছেন, তবে এখন ভারতের ওড়িশা সরকার রসগোল্লার জন্য ‘ভৌগোলিক সূচকে’র দাবি পেশ করতে চলেছে – যা পেটেন্টের সমতুল্য।

ওড়িশার পুরীতে জগন্নাথদেবের মন্দিরে শত শত বছর ধরে রসগোল্লা ভোগের রীতি প্রচলিত, এই যুক্তিতেই তারা রসগোল্লার ওপর দাবি পেশ করতে যাচ্ছেন – যদিও কলকাতার রসগোল্লা-স্রষ্টারা তা মানতে নারাজ।

রসগোল্লার হাঁড়ি নিয়ে ওড়িশা আর পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে তিক্ত বিবাদের কারণ, ওড়িশার গবেষকরা বলছেন রসগোল্লার সৃষ্টি সেই রাজ্যেই – এবং জগন্নাথদেবের মন্দিরেও রসগোল্লার ভোগ বহু কাল ধরে প্রচলিত।

এমন কী, রসগোল্লা না কি বাংলাতেও গেছে ওড়িয়াদের হাত ধরেই, বিবিসিকে বলছিলেন ওড়িশার বিখ্যাত সাময়িকী পৌরুষের সম্পাদক ও সাংস্কৃতিক বিশেষজ্ঞ অসিত মোহান্তি।

তিনি বলছিলেন, ‘উনিশ শতকের মাঝামাঝি বহু বাঙালি পরিবারে ওড়িয়ারা পাচকের কাজ করতেন, তাদের ঠাকুর বলা হত। এরাই রসগোল্লার রেসিপি ওড়িশা থেকে বাংলায় নিয়ে গেছেন – বহু গবেষণাতেও তার সমর্থন মিলেছে। বলা যেতে পারে, রসগোল্লার উৎপত্তি ওড়িশাতেই, তবে তা জনপ্রিয়তা পেয়েছে বাংলায়।’

এই যুক্তি অবশ্য একেবারেই মানতে নারাজ ধীরেন্দ্রনাথ দাস – যিনি কলকাতায় রসগোল্লায় আবিষ্কারক হিসেবে স্বীকৃত নবীনচন্দ্র দাসের চতুর্থ প্রজন্মের উত্তরসূরি।

বিরাশি বছর বয়সী মি. দাস বলছিলেন, ‘রসগোল্লা হল বাংলার সৃষ্টি, বাংলার কৃষ্টি! জন্ম ইস্তক শুনে আসছি ‘বাগবাজারের নবীন দাস, রসগোল্লার কলম্বাস’। তা হলেই বুঝুন! আর এই যে স্পঞ্জের মতো রসগোল্লা, ভেতরে জালিকাটা – এ জিনিস আগে কোথায় হয়েছে? আগে যা হত তা তো সব শক্ত দানাদারের মতো!’

কিন্তু রসগোল্লা-বিতর্ক শুধু এই বাগযুদ্ধেই থেমে নেই। ওড়িশা সরকার এখন রসগোল্লার জন্য জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন বা ‘জি আই ট্যাগ’ দাবি করতে চলেছে, এ খবর পেয়ে পশ্চিমবঙ্গও এখন পাল্টা আপিল ঠোকার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

এই ট্যাগ মঞ্জুর হলে কার্যত রসগোল্লার ওপর পেটেন্ট পেয়ে যাবে ওড়িশা, তাই দাস পরিবারের সহায়তায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কুটীরশিল্প মন্ত্রণালয়ও তাদের তথ্য সংকলন শুরু করে দিয়েছে।

তবে অসিত মোহান্তি বলছিলেন – দুধ কেটে যে ছানা তৈরি হয়, তা অন্য হিন্দু মন্দিরে ব্রাত্য হলেও ছানার তৈরি রসগোল্লার ভোগ কিন্তু জগন্নাথদেব মন্দিরের বহুকালের পরম্পরা, আর সেটাই ওড়িশার পক্ষে বড় যুক্তি।

মি মোহান্তির কথায়, ‘রথযাত্রার শেষে নীলাদ্রিবিজয়ে জগন্নাথ ও লক্ষ্মীদেবীকে রসগোল্লা নিবেদনের রীতি বহু বহু কালের। একটি মহাপাত্র পরিবার এই নিবেদনের দায়িত্বে আছে বহুকাল ধরে – সেটা একশো, দুশো এমন কী তিনশো বছরেরও প্রথা হতে পারে।’

নবীনচন্দ্র দাসের পরিবার অবশ্য বলছে, রসগোল্লার যে ছানা তার বিশেষত্ব নিয়ে ওড়িয়াদের কোনও ধারণাই নেই! ধীরেন্দ্রনাথ দাসের কথায়, ‘ওড়িশার দাবিটাই পুরো মিথ্যে। এই ছানা নবীন দাসের অনেক বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফসল!’

তিনি বলছিলেন, ‘দূর দূর থেকে লোক দেখতে আসত নবীনবাবু ছানায় কিছু মেশাচ্ছেন কি না – যা রসগোল্লাকে ধরে রাখছে, ছানাকে ভাঙতে দিচ্ছে না। কিন্তু তিনি সবার সামনে রসগোল্লা বানিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন ছানায় কিছু না-মিশিয়েও এই অদ্ভুত সৃষ্টি সম্ভব!’

সেই আদি ও অকৃত্রিম রসগোল্লা – যাতে কোনও সুজি বা ময়দার ভেজাল নেই – পেটেন্ট নিয়ে বিতর্ক হলে হাসতে হাসতে তা বাংলাকে জিতিয়ে দেবে বলেই কলকাতার দাবি।

অন্য দিকে পৌরাণিক রীতিকে ভরসা করে রসগোল্লা-যুদ্ধে জেতার জন্য কোমর বাঁধছে ওড়িশাও। -বিবিসি

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর