প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডকে জাতির ওপর আঘাত হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হামলা প্রকৃতপক্ষে শুধু একটি পরিবারের ওপরই হামলা ছিল না। একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়। তারা চেয়েছিল, বাঙালি জাতি যাতে আর কখনো মাথা উচু করে দাঁড়াতে না পারে। এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ঘাতক চক্র ৩রা নভেম্বর জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকেও হত্যা করে।
গতকাল শনিবার বিকালে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে সবুজ চত্বরে স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ৪০তম শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে ৪০ দিনব্যাপী কর্মসূচির প্রথম দিন কৃষক লীগ ঐ কর্মসূচির আয়োজন করে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে সেনাবাহিনীর একদল কর্মকর্তা ও সৈনিকের হাতে সপরিবারে জীবন দিতে হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব, তিন ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল, শেখ জামালের স্ত্রী রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ নাসের, বঙ্গবন্ধুর বোনের স্বামী আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার ছেলে আরিফ, মেয়ে বেবী ও শিশুপৌত্র সুকান্ত বাবু; বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মণি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি, নিকটাত্মীয় শহীদ সেরনিয়াবাত ও রিন্টু, পুলিশের বিশেষ শাখার সাব ইন্সপেক্টর সিদ্দিকুর রহমান ও বঙ্গবন্ধুর সামরিক সচিব কর্নেল জামিলও নিহত হন সেই রাতে। দেশের বাইরে থাকায় বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা প্রাণে বেঁচে যান।
ভয়াবহ সেই ১৫ আগস্টের কথা মনে করতে গিয়ে গলা ধরে আসে শেখ হাসিনার। আবেগাপ্লুত কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পচাত্তরের ৩১ জুলাই জার্মানিতে গিয়ে পৌঁছাই। তখন ভাবতে পারিনি যে, এত বড় একটা আঘাত আসবে। মাত্র ১৫ দিনের ব্যবধান। তারপর একদিনেই সব হারালাম। সকলকে রেখে গেলাম। আর একদিনে আমি ও আমার বোন শেখ রেহানা নিঃস্ব হয়ে গেলাম। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যার পর আমাকে দেশে ফিরতে দেয়া হয়নি। ওই সময় খুনি মোশতাক, জিয়া ক্ষমতা দখল করলো। দেশে আসতে বাঁধা দেয়া হলো। কিন্তু দেশের জনগণের চাওয়া ও তাদের ভাগ্য পরিবর্তন করতেই সব বাধা উপেক্ষা করে দেশে ফিরে এসে আওয়ামী লীগের হাল ধরি।
ক্ষমতায় আসার পর তার সরকারের নেয়া বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। এই উন্নয়ন কাজেও বিএনপি-জামায়াত চক্র বাধা দেয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, তাদের বাধা সত্বেও দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এখন বাংলাদেশকে আর কেউ অবহেলার চোখে দেখে না। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল। শেখ হাসিনা বলেন, ঘোষণা দিয়েছিলাম ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশ হবে। ২০১৫ সালেই দেশ নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। তবে আমরা নিম্ন-মধ্য হয়ে থাকতে চাই না। দেশ হবে উন্নত। ২০৪১ সালের মধ্যে তা নিশ্চিত করা হবে। তিনি বলেন, পঁচাত্তরের ১৫ আগষ্টের হত্যাকাণ্ড না হলে অনেক আগেই বাংলাদেশ উন্নত দেশে পরিণত হতো।
শেখ হাসিনা বলেন, বারবার আমার ওপর আঘাত এসেছে, মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছি। কিন্তু পিছু পা হয়নি। কারণ আমরা জানি সত্যের জয় অবশ্যই হবে। এই বাংলাদেশের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন আমার বাবা বঙ্গবন্ধু। জেল-জুলুম, অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করেছেন। সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে যখন উন্নয়নের পথে যাত্রা শুরু করেন তখনই তাকে ঘাতকের নির্মম বুলেটে জীবন দিতে হয়েছে। তবে কোন দল, স্বাধীনতার শত্রু কিংবা চক্রান্তকারী যতই চক্রান্ত করুক না কেন; জাতির পিতাই তো বলেই গেছেন যে, বাঙালি জাতিকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না। এটা আমরা জানি বলেই শত বাধা অতিক্রম করে দেশকে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছি।
দেশের কৃষি ও কৃষকের ভাগ্য পরিবর্তনে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বিভিন্ন উন্নয়নের কথাও তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ কৃষিনির্ভর দেশ। এই কৃষকের ভাগ্য পরিবর্তন করাই ছিল জাতির পিতার লক্ষ্য। তিনি বারবার কৃষকদের কথা বলতেন। কৃষকদের সার্বিক উন্নয়নের জন্য আমরা সরকার গঠনের পর সবরকম প্রচেষ্টা চালিয়েছি। প্রধানমন্ত্রী তার সরকারের সময় কৃষি উপকরণের সহজলভ্যতা, কুষকদের জন্য ভর্তৃকি দেয়া, কৃষি শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি, পল্লী সঞ্চয় বৃদ্ধি, গ্রামে অর্থ প্রবাহ বাড়ানো, খাদ্য উত্পাদন বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন অগ্রগতির কথা তুলে ধরে বলেন, কৃষকদের উন্নত জীবন দেয়ার লক্ষ্যে প্রতিটি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি। আর বাংলাদেশ এগিয়ে যাওয়া ক্ষেত্রে কৃষিখাতের অবদানের কথা উল্লেখ করে কৃষকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় কৃষক লীগকে আরো সংগঠিত করে কৃষকদের জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রাখারও আহ্বান জানান তিনি। স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচির প্রশংসা করে শেখ হাসিনা বলেন, রক্তদান একটি মহান কাজ। দান করা রক্ত বাঁচাতে পারে অন্যের জীবন। আর এ কারণে বেশি বেশি রক্তদান করতে হবে। শেখ হাসিনা বলেন, আমিও একসময় নিয়মিত রক্ত দিয়েছি। এখন বয়স বেড়ে যাওয়ায় রক্ত দেয়া যাচ্ছে না।
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, শেখ হাসিনা দেশে এসে দলের নেতৃত্ব হাতে নিয়ে শোককে শক্তিতে পরিণত করে বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার করেছেন। একাত্তরের ঘাতকদের বিচার এগিয়ে চলছে। তার নেতৃত্বে দেশকে আমরা একটি উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করবো।
কৃষক লীগের সভাপতি মোতাহার হোসেন মোল্লার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের কৃষি বিষয়ক সম্পাদক ও সাবেক খাদ্যমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস এমপি প্রমুখ।