তোমাদের মাঝে কি কেউ আছে বন্ধু আমার? তবে বন্ধু নৌকা ভিড়াও, ঘুচিয়ে দেব দুঃখ তোমার…’ তরুণ প্রজন্মের তুমুল জনপ্রিয় ব্যান্ডশিল্পী জ্যাম্বস-এর এই গানই সম্ভবত বন্ধু নামক পরম নিরাপদ নির্ভরতা বা আশ্রয়স্থল বোঝার জন্য যথেষ্ট। আসলেই তাই। বন্ধু এক নির্ভরতার নাম। যাকে অবলম্বন করে অপর এক আত্মা শক্তি পায়, এগিয়ে যায়। বন্ধুত্ব তাই মৃতসঞ্জীবনী সুধা। আগামীকাল বিশ্ব বন্ধু দিবস। অনেকেই আনুষ্ঠানিক দিবস পালনে আগ্রহী না। কিন্তু বন্ধুকে যদি কৃতজ্ঞতা জানানোর, ভালোবাসা জানানোর উপলক্ষ পাওয়া যায়– এর চেয়ে আনন্দের আর কি হতে পারে!
বন্ধুত্ব জিনিসটা কী? তার টান এতটাই বা তীব্র কেন? বন্ধুত্বের কাছে সবকিছু তুচ্ছ মনে হয়। কেন এমন টান অনুভব করে মানুষ। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই বন্ধু খোঁজে মানুষ। তিন বছরের শিশুও নিজের খেলার সাথী হিসাবে সমবয়সীকে খুঁজে নেয়। মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজনের বাইরে নিজের মনের আশ্রয়স্থল খুঁজে বেড়ায় মন। খোঁজে আশ্রয়, বন্ধুত্বের আশ্রয়। প্রেমিক- প্রেমিকার সম্পর্কের বাইরের কিছু। কি সেটা?
দার্শনিক অ্যারিস্টটল বলেছেন, ‘একজন ব্যক্তি তার বন্ধুর সাথে একইভাবে সম্পর্কিত যেভাবে সে নিজে নিজের সাথে সম্পর্কিত। যেহেতু, একজন বন্ধু একজন ব্যক্তি এবং তার নিজের একটা চিন্তাধারা আছে, সুতরাং বন্ধু হচ্ছে ওই একই চিন্তাধারায় বিশ্বাসী ব্যক্তি।’ বন্ধুর এই সংজ্ঞায়নটা একটু খটোমটো, বুঝতে কষ্ট হয়। রবীন্দ্রনাথ বরং সহজ করে বুঝিয়েছেন। বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা প্রসঙ্গে কবিগুরু বলেছেন,‘বন্ধুত্ব ও ভালোবাসায় অনেক তফাত্ আছে, কিন্তু ঝট করিয়া সে তফাত্ ধরা যায় না। বন্ধুত্ব আটপৌরে, ভালোবাসা পোশাকী। বন্ধুত্বের আটপৌরে কাপড়ের দুই-এক জায়গায় ছেঁড়া থাকিলেও চলে, ঈষত্ ময়লা হইলেও হানি নাই, হাঁটুর নীচে না পৌঁছিলেও পরিতে বারণ নাই। গায়ে দিয়া আরাম পাইলেই হইল। কিন্তু ভালোবাসার পোশাক একটু ছেঁড়া থাকিবে না, ময়লা হইবে না, পরিপাটি হইবে। বন্ধুত্ব নাড়াচাড়া টানাছেঁড়া তোলাপাড়া সয়, কিন্তু ভালোবাসা তাহা সয় না। আমাদের ভালোবাসার পাত্রহীন প্রমোদে লিপ্ত হইলে আমাদের প্রাণে বাজে, কিন্তু বন্ধুর সম্বন্ধে তাহা খাটে না; এমন-কি, আমরা যখন বিলাসপ্রমোদে মত্ত হইয়াছি তখন আমরা চাই যে, আমাদের বন্ধুও তাহাতে যোগ দিক! প্রেমের পাত্র আমাদের সৌন্দর্যের আদর্শ হইয়া থাক এই আমাদের ইচ্ছা আর, বন্ধু আমাদেরই মত দোষে-গুণে জড়িত মর্ত্যের মানুষ হইয়া থাক এই আমাদের আবশ্যক।’
সদ্যপ্রয়াত ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এ পি জে আব্দুল কালাম তো বন্ধুত্বের এমন সংজ্ঞা দিয়েছেন যারপরে আর কিছু বলার থাকে না। তিনি বলছেন, ‘একটি ভালো বই একশ’জন বন্ধুর সমান। কিন্তু একজন ভালো বন্ধু একটি লাইব্রেরির সমতুল্য’।
বন্ধু হচ্ছে জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। যে মানুষ যত মানুষের বন্ধুত্ব অর্জন করতে পারে, যে বন্ধুত্বের মর্যাদা রাখতে পারে, তার মত সুখী মানুষ নেই। বন্ধুকে নিয়ে কবি, সাহিত্যিক, সঙ্গীতশিল্পীদের রচনার ইয়ত্তা নেই। কবীর সুমনের ‘বন্ধু, কী খবর বল্?’ গান শুনে এমন মানুষ পাওয়া যাবে না যার প্রাণের বন্ধুর দেখা পাওয়ার ইচ্ছা না জন্মায়। কিংবা কৃষ্ণকলি ইসলামের বিখ্যাত গান ‘বন্ধু আমার মন ভাল নেই, তোমার কি মন ভালো/ বন্ধু তুমি একটু হাসো, একটু কথা বলো’-তে বন্ধুর সান্নিধ্য পাওয়ার যে আকুতি তা প্রত্যেক মানুষকেই উদ্বেল করে তোলে সন্দেহ নেই।
আবার বন্ধুত্ব ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে যায়। পছন্দ, অপছন্দ রুচির তফাত্ ঘটার কারণে। এটা ঠিক যে, বন্ধু নির্বাচনটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে বয়ঃসন্ধিকালে। এ সময় মানুষ খুব আবেগপ্রবণ থাকে। বন্ধু নির্বাচন ভুল হলে তারা খারাপ পথে অগ্রসর হয়। অনেকের মানসিক বিকাশ সুস্থ ও সহজভাবে ঘটে না। অনেকের জীবনে ভালো বন্ধু জোটে না। অনেকের আবার অভিশপ্ত জীবন দূরে সরে যায় একজন ভালো বন্ধুর সংস্পর্শে এসে। গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুত্ব আগের বন্ধুত্বের চেয়ে বেশি স্থায়ী। কিন্তু স্কুলের বন্ধুদের জন্যই যেন মন কাঁদে বেশি। যদি সেই বন্ধুর সঙ্গে অনেকদিন দেখা না হয় তবে তো কথাই নেই। তবে পরিণত বয়সে এসে বন্ধু নির্বাচনটাও হয় অভিজ্ঞতা থেকেই। সেখানে দু’পক্ষই অভিজ্ঞতা, পছন্দ-অপছন্দ, নির্ভরতা বিচার করেই বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তোলে।
বন্ধুত্বের গল্প বলি শুনুন
এক রিকশাওয়ালার গল্প। অনেক রাতে বাসায় ফিরছি। ফাঁকা রাস্তায় তার সঙ্গে গল্প জমে ওঠে। ছোট ছোট প্রশ্ন। বাড়ি কোথায়? বিয়ে করেছেন কি না? বাচ্চা-কাচ্চা কয়জন? রিকশা চালিয়ে সংসার চলে? সাধারণ সব প্রশ্ন। উত্তরগুলো মন দিয়ে শুনছিও না। ১২ বছর ধরে ঢাকায় রিকশা চালাচ্ছেন নাটোরের গুরুদাসপুরের রাঙ্গা। প্রশ্ন করি, ‘বাড়ি যান না?’ উত্তরে বলেন, ‘না।’ ‘কেন?’ উত্তরে বলেন, ‘১২ বছর বাড়ি যাই না।’ বলি, ‘কেন? মামলা খেয়ে পালিয়ে এসেছেন?’ উত্তর দিলেন, ‘না।’ এরপর যা বললেন, তার জন্য তৈরি ছিলাম না। বললেন, ‘এক বন্ধু ছিল। তাকে কবর দিয়ে বাড়ি ছাড়ছি। এরপরে আর বাড়ি যাই নাই।’
রাঙ্গা দিনে রিকশা চালাতেন গুরুদাসপুরে। আর রাতে বন্ধু খোকনের সঙ্গে মিলে তরমুজের ক্ষেত পাহারা দিতেন। দু্জনেরই ছিল সিনেমা দেখার শখ। কিন্তু টাকা বাঁচানোর জন্য একই সিনেমা দুজনে দেখতেন না। একজন একটা সিনেমা দেখে এসে অন্যজনকে গল্পটা বলতেন। এরপরের সিনেমা দেখতে যেতেন অন্যজন। এমনি এক রাতে সিনেমা দেখে ফিরছিলেন খোকন। সাপের কামড়ে মারা যান তিনি। সেই যে বন্ধুকে কবর দিয়ে ঢাকা এসেছেন তিনি। আর বাড়ি যাননি। বন্ধুর মৃত্যুর পর সেই দুঃসহ স্মৃতি তাড়িয়ে ফিরছে মানুষটাকে। বন্ধু দিবসের সূত্রপাতও বন্ধুত্বের এমনই এক ঘটনা থেকেই।
কী করে এলো বন্ধু দিবস
পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশেই শুধু নয়, বাংলাদেশসহ এশিয়ার অনেক দেশেই প্রতিবছর আগস্ট মাসের প্রথম রবিবারকে উদযাপন করা হয় বন্ধু দিবস হিসাবে। বন্ধু বা বন্ধুত্বের মতো সম্পর্কের সঙ্গে মানুষের পরিচয় যুগ যুগান্তরের হলেও বন্ধু দিবসের মতো কেতাবি উদযাপন কিন্তু খুব বেশি দিনের নয়। কাগজে কলমে প্রায় ৮০ বছর আর আনুষ্ঠানিকতার দিক থেকে মাত্র দুই আড়াই দশক হলো বন্ধু দিবস উদযাপন নিয়ে হুলুস্থুল শুরু হয়েছে। বন্ধু দিবসের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করতে গিয়ে অধিকাংশ মানুষ যে ঘটনাটির কথা উল্লেখ করেন সেটি হলো, ১৯৩৫ সালে আমেরিকান সরকার এক ব্যক্তির মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ালে পরদিন সেই ঘটনার প্রতিবাদে তার বন্ধু আত্মহত্যা করেন। দিনটি ছিল আগস্ট মাসের প্রথম রবিবার। আর সেই থেকেই জীবনের নানা ক্ষেত্রে বন্ধুদের অবদান আর আত্মত্যাগকে সম্মান জানাতে আমেরিকান কংগ্রেস ১৯৩৫ সালের আগস্ট মাসের প্রথম রবিবারকে বন্ধু দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। তখন বেশকিছু দেশ বন্ধুত্ব দিবসের সংস্কৃতিকে গ্রহণ করে নেয়। এভাবেই বন্ধু দিবস পালনের পরিসর বাড়তে থাকে। বর্তমানে সারা বিশ্বেই আগ্রহ নিয়ে বন্ধু দিবস পালিত হচ্ছে। ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘ বিখ্যাত কার্টুন চরিত্র ‘উইনি দ্যা পুহ’কে বন্ধুত্বের বিশ্বদূত হিসেবে নির্বাচিত করে। বন্ধু দিবসের এই বিশ্বদূত ছাড়াও এই দিবসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে হলুদ গোলাপ আর ফ্রেন্ডশিপ ব্যান্ডের মতো বিষয়গুলোও। মজার বিষয় হলো, এই ফ্রেন্ডশিপ ব্যান্ডের ধারণাটিও এসেছে আমেরিকা থেকেই। আমেরিকার আদিবাসীদের মধ্যে অনেক আগে থেকেই বন্ধুত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ ব্যান্ড দেয়ার এই রীতি চালু আছে। তারা তাদের বন্ধুদের জন্য ব্যান্ড তৈরি করে। আর যাকে ব্যান্ড দেয়া হয়, সেও কখনোই ব্যান্ডটি খোলে না। আবার বন্ধুত্বের প্রতীক যে হলুদ গোলাপ সেই হলুদ রং হলো আনন্দের প্রতীক। আর হলুদ গোলাপ মানে শুধু আনন্দই নয়, প্রতিশ্রুতিও। কাজেই বন্ধুত্বের মাঝে যেন আনন্দের পাশাপাশি থাকে প্রতিশ্রুতিও সেই কথাটিই মনে করিয়ে দেয় এই বন্ধু দিবস।
বন্ধু দিবস পালনের রীতি প্রায় সব দেশে একই রকম। বাংলাদেশে সাধারণত তরুণরাই বন্ধু দিবস পালন করে। একটু বয়স্করা এখনও বন্ধু দিবস পালনে তেমন একটা আগ্রহী নন। আগস্টের প্রথম রবিবার শুরু হতেই বন্ধুরা একে অপরকে ফোন, ফেসবুক, টুইটার, স্কাইপ-এ কিংবা বাসায় গিয়ে ‘ফ্রেন্ডশিপ ডে’ শুভেচ্ছা জানায়। দিনটি আসার আগেই কার্ডের দোকান, গিফট শপ, খাবার দোকান ও বিভিন্ন টিভি চ্যানেলগুলোতে সাজ সাজ রব পড়ে যায়। মোবাইল ফোন অপারেটররা বাজারে আনে নতুন নতুন প্যাকেজ।
নিঃসন্দেহে ‘ভালোবাসা’ বন্ধুকে দেয়ার জন্য সেরা উপহার। আর এই ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে কিছু উপহার দিতে চাইলে কেমন হতে পারে? প্রিয় বন্ধুটির জন্য হলুদ গোলাপ দেয়াই ভালো, কেননা এটাই বন্ধু দিবসের ‘সিম্বল’। তবে বন্ধুর পছন্দ বুঝেও দিতে পারেন।