হাওর বার্তা ডেস্কঃ নির্বাচনের প্রস্তুতি হিসেবে আটঘাট বেঁধে মাঠে নামতে যাচ্ছে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। এরই মধ্যে হ্যাটট্রিক জয়ের মিশন নিয়ে ঈদের পরই মাঠে নামছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। তৃণমূলের সমস্যা চিহ্নিত করতে এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছেন দলটির দায়িত্বশীল নেতারা। সমস্যা চিহ্নিত করার পর এরই মধ্যে কয়েকটি জেলার নেতাদের ঢাকায় ডেকে এনে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। পাশাপাশি তৃণমূলের সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য ঈদের পরেই জেলা সফরে যাবেন কেন্দ্রীয় নেতারা। এ সময়ের মধ্যেই সারা দেশের সদস্য সংগ্রহ ও নবায়ন কার্যক্রম তদারকিও করবেন তারা। আর এসব কাজের মধ্য দিয়েই সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকা- জনগণের সামনে তুলে ধরবেন কেন্দ্রীয় নেতারা। বর্তমান এমপি-মন্ত্রীদের পাশাপাশি মনোনয়ন প্রত্যাশীদেরও রাখা হবে এসব কাজে। আর এসব কিছুই নিজে তীক্ষèভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি নিজেও ঈদের পর আবারও জেলা সফরে নামবেন এবং জনসভা করবেন।
এদিকে ঈদের পর বিভিন্ন ইস্যুতে মাঠে নামার পরিকল্পনা করছে বিএনপি। বিশেষ করে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের দাবি আদায় এবং সম্প্রতি প্রকাশিত দলের ভিশন ২০৩০ এর পক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য শান্তিপূর্ণ নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দলটি সারা দেশে সরব থাকবে। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও বিভাগীয় শহরগুলোতে জনসভা করতে পারেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মূলত আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় সম্মেলনের পর থেকেই নির্বাচন নিয়ে ভাবনা শুরু হয়েছে আওয়ামী লীগের মধ্যে। আর কার্যত প্রস্তুতি শুরু হয় ২০ মে বিশেষ বর্ধিত সভার মধ্য দিয়ে। এর মধ্যে বিভাগীর শহরগুলোসহ বেশ কিছু জেলায় বর্ধিত সভা করা হয়েছে। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ কেন্দ্রীয় নেতারা তাতে অংশ নিয়েছেন। পাশাপাশি জেলা শহরগুলোতেও কাজ চলছে। বিরোধপূর্ণ জেলার নেতাদের ঢাকায় ডেকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে বলছেন সাধারণ সম্পাদক। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার সিরাজগঞ্জ জেলার নেতাদের নিয়ে বসেছিলেন ওবায়দুল কাদের। একই সঙ্গে জেলা শহরগুলো নিয়ে কাজ করছেন সাংগঠনিক সম্পাদকরাও। চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, পাবনা জেলায় প্রতিনিধি সভা করেছেন সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। এছাড়া সংসদে বাজেট অধিবেশন চলার কারণে কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেককেই সংসদে, অফিসে নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করতে দেখা গেছে। বুধবার খুলনা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন খুলনা বিভাগের বিভিন্ন জেলার নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, আওয়ামী লীগের লক্ষ্য আগামী নির্বাচনের আগে ১০ শতাংশ ভোট বাড়ানো। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের নেতারা মনে করছেন, ক্ষমতায় থাকতে হলে এবং আগামী দিনে ক্ষমতায় আসতে হলে দলকে শক্তিশালী করার বিকল্প নেই। এ জন্য দলের সর্বস্তরের ঐক্য সুদৃঢ় করা এবং সব পর্যায়ে প্রাণসঞ্চার করতে হবে। এ লক্ষ্য সামনে রেখেই এগোচ্ছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। এ ছাড়া সরকারের সাড়ে ৮ বছরের উন্নয়ন কর্মকা- স্বচক্ষে দেখতে ও জনগণের সামনে তা তুলে ধরতে আবারও জেলা সফরে নামবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এর ভেতর দিয়ে তিনি কর্মী-সমর্থকদের উজ্জীবিত ও সংগঠনের অভ্যন্তরে বিরাজমান স্থবিরতা কাটিয়ে তুলবেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এ সংক্রান্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সফরের সময়সূচি এবং কখন কোন জেলায় সফর করবেন তার দিনক্ষণ নির্ধারণের কাজ শুরু করেছেন বলে জানা গেছে।
আওয়ামী লীগ সভাপতির জেলা সফর ও কেন্দ্রীয় নেতাদের সফরগুলোকে কেন্দ্র করে তৃণমূলে গতি সঞ্চার করতে নানা ধরনের সাংগঠনিক কর্মকা- পরিচালনা করার পরিকল্পনা রয়েছে। এরই মধ্যে রয়েছে ইউনিয়ন থেকে শুরু করে জেলা পর্যন্ত সব স্তরে কর্মিসভা, প্রতিনিধি সভা, উঠান বৈঠক, পথসভাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি। আর এসব কর্মসূচির মধ্য দিয়ে সংগঠনের গতি সঞ্চার করা হবে। পাশাপাশি নেতাকর্মীদের বিরোধ নিষ্পত্তি করার মধ্য দিয়ে সংগঠনকে ঐক্যবদ্ধ ও চাঙ্গা করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, সাংগঠনিক কর্যক্রমের পাশাপাশি এমপি-মন্ত্রীদের মাঠে নামানোর প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা এরই মধ্যে এমপিদের এ বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন, ভোটারদের ও নেতাকর্মীদের মন জয় না করতে পারলে দলীয় মনোনয়ন দেয়া হবে না। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, একাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগ কাজ শুরু করে দিয়েছে। তৃণমূলকে নির্বাচনমুখী করতে ঈদের পরেই কাজ শুরু করা হবে। তৃণমূলকে আরও বেশি সুসংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ করতে কেন্দ্রীয় নেতারা ঈদের পর মাঠে যাবেন। জনসমর্থন ও ভোট বাড়ানোর জন্যও বেশ কিছু কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এনামুল হক শামীম বলেন, ২০তম জাতীয় কাউন্সিলের পর থেকেই আমাদের দলের নেতারা সংগঠনকে সুসংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ করে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত করার কাজ করে যাচ্ছেন। তৃণমূল নেতাদের প্রতিনিয়ত বলা হচ্ছে কীভাবে তাদের কাজ করতে হবে। লক্ষ্মীপুর জেলা ও রামগঞ্জ উপজেলার নেতাদের নিয়ে নিজে বৃহস্পতিবার ধানমন্ডি অফিসে বসে ছিলেন জানিয়ে তিনি আরও বলেন, আমি তাদের বলেছি, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে আমাদের প্রত্যেক নেতাকর্মীকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। গেল আট বছরে সরকারের উন্নয়নগুলো জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে। একই সঙ্গে বিগত বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময়ে দেশের কী অবস্থা ছিল, এখন কী পরিবর্তন হয়েছে সেগুলো জানান দিতে হবে। ঈদের পরে আমরা পুরোপুরিভাবে সাংগঠনিক কাজে নেমে পড়ব। জেলা সফর শুরু করা হবে।
এদিকে বিএনপিদলীয় সূত্র জানায়, ঈদের পর চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যেতে পারেন বিএনপি চেয়ারপারসন। সেখানে থেকে ফেরার পরই নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের রূপরেখা ঘোষণা করা হতে পারে। এ জন্য রূপরেখার খসড়া চূড়ান্ত করার কাজ চলছে। এ রূপরেখা ঘোষণার পর তা নিয়ে জনমত গড়তে মাঠে নামবেন খালেদা জিয়া। প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনি বিভাগীয় সদরগুলোতে জনসভা করতে পারেন। ঢাকা থেকে এ জনসভায় যাওয়া-আসার পথে জনসংযোগও করবেন তিনি। এসব জনসভা ও জনসংযোগে তিনি দলের ভিশন-২০৩০ সম্পর্কে বক্তব্য দেবেন। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য একটি সহায়ক সরকারের প্রয়োজনীয়তাও তুলে ধরবেন তিনি। এছাড়া বর্তমান সরকারের গুম, খুন, দুর্নীতি, সন্ত্রাসসহ নানা নেতিবাচক কর্মকা- সম্পর্কে জনগণকে সচেতন এবং এসবের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার আহ্বান জানাবেন।
সূত্র মতে, খালেদা জিয়ার জনসভার পাশাপাশি বিভিন্ন ইস্যুতে বিএনপিপন্থী পেশাজীবীদেরও মাঠে নামানো হবে। ঈদের পর বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের উদ্যোগে সারা দেশে সেমিনারের আয়োজন করা হবে। এছাড়া জেলায় জেলায় জনসভার মাধ্যমে বিভিন্ন মহাসচিবসহ দলের কেন্দ্রীয় নেতারা সভা-সমাবেশ করবেন। এদিকে ঈদের আগেই সারা দেশে বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি গঠনের কাজ শেষ করার টার্গেট রয়েছে। জেলা কমিটির পাশাপাশি থানা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়েও নতুন কমিটি গঠনের কাজ চলছে। এরই মধ্যে প্রায় অর্ধশত জেলায় নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
ঈদের পর আন্দোলনে নামার আভাস দিয়ে শনিবার এক ইফতার অনুষ্ঠানে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, লুটেরাদের রোখার জন্য আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আমরা মনে করি, রোজার ঈদ শেষ হয়ে গেলে জনগণ আরও ঐক্যবদ্ধ হবে, এই জুলুম-অত্যাচার-অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাদের সঙ্গে মিলে রাস্তায় জনগণের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মাধ্যমে প্রতিবাদ করতে হবে। সেই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারলে এদেশের জনগণ শরিক হবে। ‘সহায়ক সরকারের’ অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায়ে জোট শরিকদের কর্মসূচির প্রস্তুতি নেয়ার আহ্বান জানিয়ে বিএনপি প্রধান বলেন, আমরা এদেশে একটা অবাধ, সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন চাই, যে নির্বাচন সহায়ক সরকারের অধীনে হবে। হাসিনা মার্কা নির্বাচন এদেশে আর চলবে না। এদেশের কোনো মানুষ হাসিনার অধীনে নির্বাচন চায় না।
আন্দোলন প্রসঙ্গে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেছেন, তুমুল গণআন্দোলনের মাধ্যমেই আগামী দিনে বিএনপি নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের দাবি আদায় করে নেবে। সরকারকে উদ্দেশ করে দুদু বলেন, মান-সম্মান থাকতে সহায়ক সরকারের দাবি মেনে নিন। দেশের জনগণ আপনাকে মাথায় করে রাখবে। অন্যথায় যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে তা আপনার জন্য সুখকর হবে না। আপনার বিশেষ দূত এরশাদকে যেভাবে গণআন্দোলনের মাধ্যমে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছিল, একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে আপনাকেও। ঈদের পর মাঠে নামার প্রস্তুতি নেয়ার কথা জানিয়ে ঢাকা মহানগর উত্তরের সাধারণ সম্পাদক আহসান উল্লাহ হাসান বলেন, আগামী দিনের আন্দোলনের প্রস্তুতির অংশ হিসেবেই মহানগরে দলকে সংগঠিত করা হচ্ছে। এ জন্য ঈদের পরপরই মহানগরের পূর্ণাঙ্গ কমিটি এবং পরবর্তীকালে থানাগুলোর কমিটি ঘোষণা করা হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।