আগামী ৮ জুন ব্রিটেনের সাধারণ নির্বাচনের প্রচারণা কিছুটা স্থবির করে দিয়েছে ম্যানচেস্টারে আত্মঘাতী হামলা। এই হামলা নির্বাচনের অনেক হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিতে পারে। যদিও ব্রিটেনের জরুরি অবস্থা তুলে নিয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে। আত্মঘাতী হামলায় ২২ জনের মৃত্যুর শোক আর নতুন হামলার আতঙ্ক নিয়েই রাজনৈতিক দলগুলো তাদের প্রচারণা শুরু করেছে। ব্রিটিশ বাংলাদেশি কমিউনিটিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মিলে প্রায় ১২ জন এমপি প্রার্থী থাকলেও বাংলাদেশি কমিউনিটির সবার দৃষ্টি থাকবে তিন বাঙালি এমপির দিকে। বেথনালগ্রীন ও বো নির্বাচনী আসনের প্রথম বাঙালি এমপি রুশনারা আলী, হ্যাম্পস্টেড ও কিলবার্ণ এলাকা থেকে নির্বাচিত এমপি বঙ্গবন্ধুর নাতনি টিউলিপ সিদ্দিক ও এ্যাকটন সেন্ট্রাল ও ইলিং আসনের এমপি ডক্টর রুপা হক কি পারবেন তাদের আসন ধরে রাখতে? লেবার দলের টিকিটে নির্বাচিত এই তিন এমপির ভোটের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, রুশনারা আলী রয়েছেন সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে। কারণ এই আসনটি লেবার পার্টির সবচেয়ে নিরাপদ আসনের মধ্যে একটি। তবে রুশনারা এবারের নির্বাচনে কতটা নিরাপদ সেই বিশ্লেষণ করতে হলে ২০১০ সালের নির্বাচন থেকে শুরু করতে হবে।
রুশনারা আলী ২০১০ সালে প্রথমবারের মতো যখন ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন তার প্রাপ্ত ভোট ছিল ২১,৭৮৪, যা মোট ভোটের ৪৩ শতাংশ। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দী লিবারেল ডেমোক্র্যাট দলের প্রার্থী আজমল মাশরুর পেয়েছিলেন ১০,২১০ ভোট, রেসপেক্ট পার্টির আবজল মিয়া পেয়েছিলেন ৮৫৩২ ভোট, কনজারভেটিভ দলের প্রার্থী জাকির খান পেয়েছিলেন ৭০৭১ ভোট। ২০১০ সালের নির্বাচনে রুশনারা আলীর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের তিনজনই ছিলেন বাঙালি। ২০১৫ সালের নির্বাচনে রুশনারার ভোট বেড়ে দাঁড়ালো ৩২ হাজার ৩৭৮, যা মোট ভোটের ৬১ শতাংশ। যেহেতু ওই নির্বাচনে রুশনারার প্রতিপক্ষ হিসেবে কোনো বাঙালি ছিলেন না, তাই ভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শের হলেও অধিকাংশ বাঙালি ভোটার রুশনারাকে ভোট দিয়েছে। কিন্তু ৮ জুনের স্ন্যাপ নির্বাচনে রুশনারার ২০১০ সালের প্রতিদ্বন্দ্বী আজমল মাশরুর আবারো রুশনারাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বেথনালগ্রীন ও বো আসনের জন্য লড়বেন। বিগত নির্বাচনে আজমল মাশরুর লিবারেল ডেমোক্র্যাট দলের প্রার্থী হলেও এবার তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করবেন। আজমল মাশরুর দাবি করেছেন, বিগত বছরগুলোতে রুশনারার সঙ্গে কমিউনিটির দূরত্ব বেড়েছে, রুশনারাকে কমিউনিটির কোনো প্রয়োজনে পাওয়া যায় না, তিনি তিন বছর সার্জারি (নির্বাচনী এলাকায় জনগণের সমস্যা সরাসরি শুনতে এমপির সঙ্গে সাক্ষাৎ পাওয়ার প্রক্রিয়া) করেননি। তাই আজমল মাশরুর কমিউনিটির আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে ওয়েস্টমিনস্টারে বেথনালগ্রীন ও বো আসনের প্রতিনিধি হতে চান। আজমল মাশরুরের কাছে জানতে চাইলাম, ‘আপনি পেশায় একজন ইমাম, বেথনালগ্রীন ও বো এলাকাতেও আপনি থাকেন না। ২০১০ সালের পর এই এলাকার মানুষের জন্য আপনি কি করেছেন যে স্থানীয় জনগণ রুশনারাকে ভোট না দিয়ে আপনাকে দেবে? কোন ক্যারিশমার কারণে লেবারের এত শক্তিশালী ঘাঁটিতে একজন স্বতন্ত্র প্রার্থীকে নির্বাচিত করবে বেথনালগ্রীন ও বো আসনের জনগণ?’ আজমল মাশরুর হেসে জবাব দিলেন, ‘দেখুন, আমি ২০১০-এর নির্বাচনে ১০ হাজারেরও বেশি ভোট পেয়েছি। আর তখন অপর দুই বাঙালির ভোট হিসাব করলে প্রায় ২৫ হাজার ভোট হয়। তাছাড়া এন্টি রুশনারা ভোট তো আছেই।’ জানতে চাইলাম, ‘তাহলে কি আপনি নিশ্চয়তা দিচ্ছেন, অপর দুই বাঙালির সেই ভোটগুলো রুশনারার বাক্সে না গিয়ে আপনার বাক্সে পড়বে?’ জবাবে আজমল মাশরুর বললেন, ‘তিনি আশাবাদী।’ রুশনারা আলী অবশ্য গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘আজমল মাশরুর নিজেই একজন বিভ্রান্ত প্রার্থী। তিনি যখন তখন রাজনৈতিক দল পরিবর্তন করেন, তিনি প্রার্থী হিসেবে যোগ্য হতে পারেন, তবে বেথনালগ্রীন ও বো আসনের জন্য নয়।’
তবে আজমল মাশরুর টাওয়ার হ্যামলেটসের সাবেক মেয়র লুৎফুর রহমানের বিরোধী পক্ষ, মেয়র প্রার্থী রাবিনার আদর্শপুষ্ট একটি অংশের সমর্থন পেয়েছেন। এ ছাড়াও সাবেক রেসপেক্ট ও রুশনারাবিরোধী লেবার পার্টির কিছু ভোটও আজমল মাশরুরের বাক্সে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অন্যদিকে একজন ইমাম, ব্রডকাস্টার ও চ্যারিটি ফান্ড রেইজার হিসেবে আজমল মাশরুরের বাংলাদেশি কমিউনিটি ও মুসলিম কমিউনিটির ভোটারদের কাছে বেশ পরিচিতি রয়েছে। তাই ভোটের ময়দানে রুশনারা আলী যে আজমল মাশরুরের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এই চ্যালেঞ্জ রুশনারার বিজয় ঠেকাতে পারবে বলে মনে হয় না। কারণ ঐতিহ্যগতভাবে এই আসনটিতে লেবার পার্টিই জয়লাভ করে আসছে।
হ্যাম্পস্টেড ও কিলবার্ন আসন থেকে টিউলিপ সিদ্দীক গত নির্বাচনে ১১শ’ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছিলেন। নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে টিউলিপ বলেছিলেন, তিনি যে ১১শ ভোট বেশি পেয়েছিলেন, সেই ১১শ ভোটই ছিল বাঙালিদের। তাই এবারের নির্বাচনে যত বেশি বাঙলি ভোটে অংশ নেবে, টিউলিপের বিজয়ের সম্ভাবনা তত বাড়বে। ২০১৫ সালে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর টিউলিপ ব্রিটিশ রাজনীতিতে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন। পার্লামেন্টের প্রথম নির্বাচিত এমপিদের মেইডেন স্পিচের মধ্যে টিউলিপের বক্তব্য শীর্ষ তালিকায় স্থান পায়। এ ছাড়াও মুসলিমবিদ্বেষী বক্তব্য দেয়ার কারণে মার্কিন নির্বাচনের আগে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ব্রিটেনে আসার ব্যপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করা অনলাইন পিটিশনের কারণে ব্রিটেনের মূল ধারার গণমাধ্যমে নিয়মিত দেখা গেছে টিউলিপকে। ব্রেক্সিট ইস্যুতে তার নির্বাচনী এলাকার জনগণ যেহেতু ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষে থাকার রায় দিয়েছে, তাই তিনি জনগণের মতামতের গুরুত্ব দিয়ে পার্লামেন্টের ছায়ামন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন। সে কারণে এবারের নির্বাচনে টিউলিপের জয়ের ব্যবধান বাড়ার সম্ভাবনাই বেশি।
অ্যাকটন সেন্ট্রাল ও ইলিং আসন থেকে নির্বাচিত অপর বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এমপি ডক্টর রুপা হক বিগত নির্বাচনে কনজারভেটিভ প্রার্থী এজি ব্রে থেকে মাত্র ২৭৪ ভোট বেশি পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন। এই আসনটি লন্ডনের অন্যতম মার্জিনাল সিট। কনজারভেটিভ দল পুরো ব্রিটেনে যে কয়টি আসন ফিরে পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে রুপা হকের আসনটি তার মধ্যে অন্যতম। তবে শেষ মুহূর্তে রুপা হক তার নড়বড়ে অবস্থান আরেকটু পোক্ত করেছেন গ্রিন পার্টির সঙ্গে জোট বেঁধে। গ্রিন পার্টির টম সারমান বিগত নির্বাচনে ১৮৪১ ভোট পেয়েছিলেন। কনজারভেটিভের সঙ্গে গ্রিন পার্টির সাপে নেউলে সম্পর্কের কারণে এই আসনে কনজারভেটিভকে ঠেকাতে গ্রিন পার্টি লেবার পার্টিকে সমর্থন দিচ্ছে। সেই সুবাদে রুপা হক, তার ২২ হাজার লেবার ভোট ব্যাংকের সঙ্গে গ্রিন পার্টির আরো বাড়তি ২ হাজার ভোট যোগ করতে পারলে, নির্বাচনী দৌড়ে আরেকটু এগিয়ে থাকবেন। তবে ব্রিটিশ বাংলাদেশি এমপিরা নির্বাচনে জয়লাভের পর থেকেই বাংলাদেশিদের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখেই চলছেন বলে অভিযোগ রয়েছে কমিউনিটির পক্ষ থেকে। প্রার্থীরা অবশ্য কৌশলগত অবস্থান ও নিজ দলের বাধ্যবাধকতার কারণে এড়িয়ে চলছেন বাংলাদেশি গণমাধ্যমও। কমিউনিটির প্রত্যাশা তিন বাঙালি এমি পুনরায় নির্বাচিত হলে বাংলাদেশি কমিউনিটির সঙ্গে তাদের এই দূরত্ব কমবে।
সাংবাদিক ও পিআর কনসালটেন্ট। একাত্তর টেলিভিশনের যুক্তরাজ্য প্রতিনিধি