জলমহাল নীতিমালা কাগজে-ফাইলে- কোন জলমহালে মৎস্যজীবী সমিতি’র কর্তৃত্ব নেই

জলমহাল নীতিমালা’২০০৯ কাগজে পত্রে মেনে সুনামগঞ্জের জলমহাল ইজারা হলেও কোন জলমহাল-ই মৎস্যজীবী সমিতির লোকজন ভোগ করতে পারছে না। ভোগ করছেন সরকার দলীয় প্রভাবশালীরা। কোন কোন ক্ষেত্রে নেপথ্যে বিএনপি’র প্রভাবশালীরাও রয়েছেন। হাওরের ফসলডুবির পর এবার জেলে-কৃষক সকলেই বুঝতে পারছেন ফসল হারালে বেঁচে থাকার জন্য জলমহাল ছাড়া অন্য কোন অবলম্বন নেই হাওরবাসীর।
জেলায় ছোট-বড় জলমহাল রয়েছে ১০৪৩ টি। এর মধ্যে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) হাওর ইনফাস্ট্রাকচার লাইভলিহুড ইমপ্রোভমেন্ট প্রজেক্ট (হিলিফ)’র আওতায় ২৯৭ জলমহাল, হাওর ফ্লাড লাইভলিহুড ম্যানেজমেন্ট প্রজেক্ট (হিমলিফ)’র আওতায় ৪২ টি জলমহাল, উন্নয়ন স্কীমের আওতায় মন্ত্রণালয় থেকে ইজারা হয়েছে ৬০ টি জলমহাল । আদালতে মামলায় জড়িত রয়েছে ২৮ টি, ভরাট হওয়াসহ নানা কারণে ইজারা হয় না ১৯৮ টি। বাকী ৪১৮ টি জলমহালের মধ্যে ৪৪ টি মন্ত্রণালয় থেকে ইজারা প্রক্রিয়াধীন। ৭৪ টি জেলা প্রশাসন থেকে ইজারা প্রক্রিয়াধীন। ৩৫ টি জলমহালের দরপত্র এ মাসেই গ্রহণ করা হয়েছে। বাকীগুলো হয় ইজারা দেওয়া, না হয় প্রক্রিয়াধীন। ২০ একরের নিচের জলমহাল উপজেলা প্রশাসন এবং ২০ একরের উপরের হলে জেলা প্রশাসন এবং উন্নয়ন স্কীমের জলমহালগুলো মন্ত্রণালয় থেকে ইজারা দেওয়া হয়। গত বছর জলমহালগুলো ইজারা প্রদান করে প্রায় ১৫ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছিল। জেলায় ইজারা প্রদানের কর্তৃপক্ষ জেলা প্রশাসন এবং উপজেলায় উপজেলা প্রশাসন। সকল কমিটির-ই উপদেষ্টা স্থানীয় সংসদ সদস্য।
নীতিমালা
অনুযায়ী জলমহাল ইজারা নিতে আগ্রহী’র নাগরিকত্ব সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র ও মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির রেজিস্টেশনের কাগজ জমা দিতে হয়। অবশ্যই সমবায় অধিদপ্তরের নিবন্ধিত মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি হতে হবে। এক্ষেত্রে জলমহালের নিকটবর্তী মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি অগ্রাধিকার পাবে।
নিয়ম মেনে জলমহালগুলো মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি’র নামে বন্দোবস্ত দেওয়া হলেও এলজিইডি’র হিলিফ এবং হিমলিফ’র আওতায় থাকা জলমহাল ছাড়া অন্যগুলোতে মৎস্যজীবীদের মালিকানা থাকে কেবল কাগজে-কলমে। হিলিফ-হিমলিফে কার্ডধারী মৎস্যজীবীরা লভ্যাংশের টাকা পেলেও প্রভাবশালী মৎস্যজীবীরা বাড়তি কিছু সুবিধা নেবার অভিযোগ রয়েছে।
সুনামগঞ্জ এলজিইডি’র হিমলিফ প্রকল্পের ডিস্ট্রিক্ট প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর মুজিবুর রহমান বলেন,‘হিলিফ বা হিমলিপ প্রকল্পের জলমহালগুলো এলজিইডি ও ভূমি মন্ত্রণালয়ের সমঝোতার মাধ্যমে এলজিইডি প্রাপ্ত হয়। পরে এলজিইডি জলমহাল পাড়ের গ্রামগুলোর মৎস্যজীবীদের (কার্ডধারী মৎস্যজীবী) কমিটি গঠন করে বিল ব্যবস্থাপনার সুযোগ করে দেয়। মৎস্য আহরণের পর লভ্যাংশের টাকা বিল ব্যবহারকারী মৎস্যজীবী সমিতির হিসাবে ব্যাংকে জমা হয়। শেষে জমাকৃত টাকা সদস্যদের মধ্যে সমভাবে বণ্টন করে দেয় এলজিইডি। আমরা চেষ্টা করি সকলে যাতে সমান লভ্যাংশ পায়, এই ব্যবস্থা করতে।’
অন্যদিকে ভূমি মন্ত্রণালয়, জেলা ও উপজেলা প্রশাসন থেকে ইজারা নেওয়া মৎস্যজীবী সমিতিগুলো কেবল কাগজে- ফাইলেই মালিকানা থাকে।
উন্নয়ন স্কীমের আওতায় ৩৬ লাখ টাকায় ইজারা নেওয়া সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরের বড় জলমহাল গাধিয়ালা কাগজেপত্রে ইজারা নিয়েছে সমদল মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি নামের মৎস্যজীবীদের সংগঠন। কিন্তু এটি শাসন করেন জগন্নাথপুর পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন ভুইয়া, উপজেলা কৃষক লীগের সভাপতি আফছর উদ্দিনসহ সরকারী দলের প্রভাবশালী একটি ব্যবসায়ীক গ্রুপ।
জগন্নাথপুর পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন অবশ্য বলেছেন,‘জলমহালের মালিকানা সমদল মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির’ই। তাদের আর্থিক সংকট থাকায় আমাদের কাছ থেকে পুঁজি নিয়ে তারা জলমহাল লালন করে। বিনিময়ে লভ্যাংশের কিছু অংশ আমাদের দেয় সমিতি।’
এভাবে ধর্মপাশার সুনই নদী’র ইজারাদার সুনই মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি। ২০ লাখ টাকায় এটি ইজারা নেওয়া হয়েছে। কিন্ত এটি ভোগ করছেন স্থানীয় সরকার দলীয় সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতনের ভাই ধর্মপাশা উপজেলা যুবলীগের সভাপতি মোজাম্মেল হোসেন রুখনসহ প্রভাবশালীরা।
অবশ্য মোজাম্মেল হোসেন রুখন এ প্রসঙ্গে বলেছেন,‘সুনই মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি’র নামে সুনই নদী ভোগও করছে তারাই (সুনই মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি)। আমরা কিছুই না।’
শুধু এই দুটি জলমহাল নয়। জেলার সকল জলমহালই সরকার দলীয় এবং কোন কোন ক্ষেত্রে বিএনপি’র প্রভাবশালীরাও শরিকানায় আছেন।
হাওর-বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলনের আহ্বায়ক মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান বলেন,‘জলমহালের মালিকানা জলমহাল পাড়ের জেলেদের দিতে হলে তাদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে রাজস্বের টাকা নিতে হবে। এক্ষেত্রে জেলেদের ব্যাংক ঋণও দেওয়া যেতে পারে। তাহলেই জেলেরা অন্য কারো মুখাপেক্ষী হবে না এবং জলমহালের মালিকানাও তাদেরই থাকবে।’
কৃষি ব্যাংকের সুনামগঞ্জ অঞ্চলের জিএম অজয় কুমার সাহা বলেন,‘জলমহাল শাসন করার জন্য জেলেদের ব্যাংক ঋণ দেবার বিষয়ে জাতীয় সিদ্ধান্ত হতে পারে। এটি সংসদে বিল পাস করে বাংলাদেশ ব্যাংক কার্যকর করার নির্দেশ দিতে পারে। অথবা বাংলাদেশ ব্যাংক সিদ্ধান্ত নিয়ে সংশ্লিষ্ট অন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দিতে পারে।’
মানবাধিকার কর্মী অ্যাড. সুলতানা কামাল সম্প্রতি তাহিরপুরে গণ-মাধ্যম কর্মীদের বলেছেন,‘জাল যার জলা তার, এই নীতি অবশ্যই বাস্তবায়ন করতে হবে। হাওর পাড়ের মানুষকে বাঁচাতে এছাড়া অন্য কোন বিকল্প নেই।’

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর