ঢাকা ০৮:১১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০২ জানুয়ারী ২০২৫, ১৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নতুন প্রজন্মের ভাবনা বেকারদের বোবা কান্না

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৩:৫৫:২২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ মে ২০১৭
  • ৪২৮ বার

আমার পরিচিত এক বড় ভাই আছেন যিনি প্রায় তিন বছর যাবত্ একটি সরকারি চাকরির জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। ইতোমধ্যে চাকরির আবেদন ফর্ম পূরণ এবং পরীক্ষা দিতে যাওয়া-আসা বাবদ অনেক টাকা খরচ করে ফেলেছেন। গত ১৮ মে বৃহস্পতিবার রাত্রে নিজের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য অগ্রণী ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্যে ঢাকায় পাড়ি জমান তিনি। সকাল হতে না হতেই জানতে পারলেন অগ্রণী ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের কথা। ফলাফল: বিকেলের পরীক্ষা স্থগিত এবং পরীক্ষা না দিয়েই ঢাকা থেকে কুড়িগ্রামে তার নিজ বাসায় ফিরে আসা। উল্লেখ্য, তিনি তার আলসারে আক্রান্ত মায়ের চিকিত্সার জন্য রাখা টাকা নিয়ে পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলেন। হয়ত-বা এখন টাকার অভাবে তার মায়ের চিকিত্সা হবে না। এরকম শুধু তার একার জীবনের ঘটনা নয়, লাখ লাখ বেকার যুবক প্রতিনিয়ত এধরনের দুঃখজনক ঘটনার মুখোমুখি হতে হচ্ছে।

সাড়ে সাত কোটি জনসংখ্যা নিয়ে যে স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছিল তা আজ ১৬ কোটিতে এসে দাঁড়িয়েছে। আমরা আজকে নিজের টাকায় পদ্মা সেতু নির্মাণ করছি। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে খাদ্য রপ্তানিও করছি বিদেশে, পারমাণবিক বিদ্যুত্ কেন্দ্র নির্মাণ করছি। পুরো বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো কাজগুলো আমাদের দেশে আজ সম্পাদিত হচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে দেশের মাথাপিছু বার্ষিক আয় ১৬০২ মার্কিন ডলারে অর্থাত্ এক লাখ ২৫ হাজার ৯৯৯ টাকায় উন্নীত হয়েছে এবং মোট দেশজ উত্পাদন জিডিপি-এর প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ২৪ শতাংশ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এসব তথ্য থেকে বোঝা যায় বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়কে খুব দ্রুত বেগে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু একটা বিষয়ে আমার প্রশ্ন থেকে যায়, বাংলাদেশ কি বেকারদের জন্য পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারছে? যতই দিন যাচ্ছে বেকারত্বের হার ততই বেড়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির এক গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশের শ্রমবাজারে প্রতিবছরে প্রায় ২২ লাখ লোক প্রবেশ করে। কিন্তু কর্মসংস্থান হয় মাত্র সাত লাখ লোকের। বাকিগুলো যোগ হয় বেকার নামক এক অবহেলিত জনগোষ্ঠীর তালিকায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর জরিপ (২০১৫) মতে— বাংলাদেশে মোট বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৩০ হাজার যা মোট শ্রমশক্তির ৪ দশমিক ৫ ভাগ। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংক বিবিএস-এর এ জরিপের সাথে একমত হতে পারেনি। তাদের মতে, বাংলাদেশে বেকারত্বের হার ১৪ দশমিক ২ শতাংশ। এই বেকারদের মধ্যে উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যাই বেশি । ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট-এর এক বিশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশে স্নাতক ডিগ্রিধারী ১০০ জনের মধ্যে ৪৭ জনই বেকার। জানি না উচ্চশিক্ষিত এই ৪৭ জন কবে চাকরি পাবে কিংবা আদৌ পাবে কিনা। কারণ বাংলাদেশে চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় আজ মেধার মূল্যায়ন হয় না। পরীক্ষার আগেই এখন টাকার বিনিময়ে প্রশ্নপত্র পাওয়া যায়।

বর্তমানে বাংলাদেশে প্রশ্নপত্র ফাঁসের এক মহোত্সব চলছে। প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা, জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসি এবং অনার্স-এর ভর্তি পরীক্ষাতে প্রশ্নপত্র ফাঁস যেন একটা অপরিহার্য নিয়মে পরিণত হয়েছে। আর এই প্রশ্নপত্র ফাঁসের ছোবল থেকে বাংলাদেশের নিয়োগ পরীক্ষাগুলোও আর রেহাই পাচ্ছে না। আমার মতে, বাংলাদেশে একমাত্র পিএসসি-ই স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় নিয়োগ সম্পন্ন করে। বাকি সব প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় প্রচুর দুর্নীতি হয়ে থাকে। গত ১৯ মে অগ্রণী ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। অবশ্য সকালে হয়ে যাওয়া পরীক্ষাটি গত ২৩ মে বাতিল করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং ও ইন্স্যুরেন্স বিভাগ। এর আগে গত ২১ এপ্রিল জনতা ব্যাংকের নির্বাহী কর্মকর্তা পদে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। এভাবে যদি প্রশ্নপত্র ফাঁসই হবে তবে শুধু শুধু টাকা খরচ করে পরীক্ষা নেওয়ার কি দরকার? দেশের সরকারি চাকরির পোস্টগুলো টাকা দিয়ে বিক্রি করে দিলেই তো হয়?

প্রশ্নপত্র ফাঁসের ফলাফল যে কতটা ভয়াবহ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রশ্নপত্র ফাঁসের কারণে দেশের মেধাবীরা চাকরি পায় না। দেশের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো দুর্নীতিবাজ, প্রশ্নপত্র ফাঁসের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত লোকের দ্বারা পূরণ হয়ে যায়। আবার অনেক সময় দেখা যায়, একটা সরকারি চাকরি নিতে জনপ্রতি ৫-২০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়। চাকরিতে ঘুষ দিয়ে ঢোকা ব্যক্তিটি চাকরি নেওয়ার সময় যে ৫-২০ লাখ টাকা ঘুষ দিয়েছিল তা আয় বা ইনকাম করার জন্য বিভিন্ন প্রকার অনিয়ম ও দুর্নীতির সাথে জড়িত হয়। আর এসব কারণেই হয়ত-বা দেশে দুর্নীতির মাত্রা আরো বেড়ে যায়।

বাংলাদেশে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ৫৫ ভাগ বিভিন্ন প্রকার কোটা ও বাকি ৪৫ ভাগ মেধা থেকে নিয়োগ দেওয়া হয়। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে মেধার চেয়ে কোটা থেকে এত বেশি সংখ্যক চাকরি প্রার্থী নিয়োগ দেওয়া হয় কি না তা আমার জানা নেই। তাছাড়া কোটায় যে পোস্টগুলো থাকে বেশিরভাগ সময়ই সেগুলো পূরণ হয় না। ফলে সেগুলো ফাঁকাই থেকে যায়। উপযুক্ত প্রার্থী থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র কোটা না থাকার জন্য অনেকেই চাকরি পায় না। ফলস্বরূপ বেকারত্ব আরো বেড়ে যায়। তাই কোটা পদ্ধতির সংস্কার করাটা এখন সময়ের দাবি।

বাংলাদেশের বেকার যুবকদের উপর এক ধরনের অবিচার লক্ষ করি আমি। আমাদের দেশে চার বছরের অনার্স কোর্স সেশনজটের কারণে শেষ হতে প্রায় পাঁচ/ছয় বছর লাগে। এই ক’বছরে বাবা-মা সন্তানের লেখাপড়ার জন্য প্রচুর টাকা ব্যয় করে থাকেন। অনার্স শেষ করে বের হওয়ার পর চাকরির আবেদন করতে অনেক টাকা চলে যায়। আবার প্রায় সব চাকরির পরীক্ষা ঢাকা শহরে হওয়ায় যাতায়াত বাবদ অনেক টাকা ব্যয় হয়। এই টাকা আমাদের মতো বেকার ছেলেগুলো কোথায় পাবে? বেকারদের নেই কোনো ইনকাম সোর্স। তাই যদি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষার আবেদন ফি’র পরিমাণ কমায় এবং পরীক্ষাগুলো বিভাগীয় পর্যায়ে নেয় তবে অবহেলিত এই বেকারদের অনেক বড় একটা উপকার হতো।

আমরা দেশের বোঝা হয়ে থাকতে চাই না। আমরাও দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে চাই, বিশ্বের কাছে দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করতে চাই। আমরাও চাই বৃদ্ধ বাবা-মায়ের মুখে একটু হাসি ফোটাতে, বৃদ্ধ বয়সে তাদের পাশে থেকে তাদেরকে সাপোর্ট করতে, নিজের পছন্দের মানুষটিকে বিয়ে করে ঘরে তুলতে। কিন্তু বেকার নামক এই তকমাটা যদি না ঘোচে তবে কী করে আমরা এসব ইচ্ছে পূরণ করব? তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আমার আকুল আবেদন— আপনি স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে চাকরির পরীক্ষাসহ সব পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিন। প্রশ্নপত্র ফাঁসের সাথে যারা জড়িত তারা আমাদের প্রিয় এ দেশটিকে ধ্বংস করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে। তারা এ দেশের পুরো সিস্টেমকে দুর্নীতিগ্রস্ত করতে চায়। তাই এদেরকে খু্ঁজে বের করে শাস্তির আওতায় আনুন। বেকারদের জন্য পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করুন। বেকারদের নিঃশব্দ কান্নার দিকে তাকিয়ে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করুন। আর যদি এসব না করা হয় তবে বাংলার আকাশ বাতাস বেকারদের বিষাক্ত ভারী নিঃশ্বাসে ভরে যাবে। তখন হয়ত-বা এই বিষাক্ত বাতাসে আপনাদের নিঃশ্বাস নিতেও অনেক কষ্ট হবে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

নতুন প্রজন্মের ভাবনা বেকারদের বোবা কান্না

আপডেট টাইম : ০৩:৫৫:২২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ মে ২০১৭

আমার পরিচিত এক বড় ভাই আছেন যিনি প্রায় তিন বছর যাবত্ একটি সরকারি চাকরির জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। ইতোমধ্যে চাকরির আবেদন ফর্ম পূরণ এবং পরীক্ষা দিতে যাওয়া-আসা বাবদ অনেক টাকা খরচ করে ফেলেছেন। গত ১৮ মে বৃহস্পতিবার রাত্রে নিজের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য অগ্রণী ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্যে ঢাকায় পাড়ি জমান তিনি। সকাল হতে না হতেই জানতে পারলেন অগ্রণী ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের কথা। ফলাফল: বিকেলের পরীক্ষা স্থগিত এবং পরীক্ষা না দিয়েই ঢাকা থেকে কুড়িগ্রামে তার নিজ বাসায় ফিরে আসা। উল্লেখ্য, তিনি তার আলসারে আক্রান্ত মায়ের চিকিত্সার জন্য রাখা টাকা নিয়ে পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলেন। হয়ত-বা এখন টাকার অভাবে তার মায়ের চিকিত্সা হবে না। এরকম শুধু তার একার জীবনের ঘটনা নয়, লাখ লাখ বেকার যুবক প্রতিনিয়ত এধরনের দুঃখজনক ঘটনার মুখোমুখি হতে হচ্ছে।

সাড়ে সাত কোটি জনসংখ্যা নিয়ে যে স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছিল তা আজ ১৬ কোটিতে এসে দাঁড়িয়েছে। আমরা আজকে নিজের টাকায় পদ্মা সেতু নির্মাণ করছি। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে খাদ্য রপ্তানিও করছি বিদেশে, পারমাণবিক বিদ্যুত্ কেন্দ্র নির্মাণ করছি। পুরো বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো কাজগুলো আমাদের দেশে আজ সম্পাদিত হচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে দেশের মাথাপিছু বার্ষিক আয় ১৬০২ মার্কিন ডলারে অর্থাত্ এক লাখ ২৫ হাজার ৯৯৯ টাকায় উন্নীত হয়েছে এবং মোট দেশজ উত্পাদন জিডিপি-এর প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ২৪ শতাংশ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এসব তথ্য থেকে বোঝা যায় বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়কে খুব দ্রুত বেগে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু একটা বিষয়ে আমার প্রশ্ন থেকে যায়, বাংলাদেশ কি বেকারদের জন্য পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারছে? যতই দিন যাচ্ছে বেকারত্বের হার ততই বেড়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির এক গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশের শ্রমবাজারে প্রতিবছরে প্রায় ২২ লাখ লোক প্রবেশ করে। কিন্তু কর্মসংস্থান হয় মাত্র সাত লাখ লোকের। বাকিগুলো যোগ হয় বেকার নামক এক অবহেলিত জনগোষ্ঠীর তালিকায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর জরিপ (২০১৫) মতে— বাংলাদেশে মোট বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৩০ হাজার যা মোট শ্রমশক্তির ৪ দশমিক ৫ ভাগ। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংক বিবিএস-এর এ জরিপের সাথে একমত হতে পারেনি। তাদের মতে, বাংলাদেশে বেকারত্বের হার ১৪ দশমিক ২ শতাংশ। এই বেকারদের মধ্যে উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যাই বেশি । ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট-এর এক বিশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশে স্নাতক ডিগ্রিধারী ১০০ জনের মধ্যে ৪৭ জনই বেকার। জানি না উচ্চশিক্ষিত এই ৪৭ জন কবে চাকরি পাবে কিংবা আদৌ পাবে কিনা। কারণ বাংলাদেশে চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় আজ মেধার মূল্যায়ন হয় না। পরীক্ষার আগেই এখন টাকার বিনিময়ে প্রশ্নপত্র পাওয়া যায়।

বর্তমানে বাংলাদেশে প্রশ্নপত্র ফাঁসের এক মহোত্সব চলছে। প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা, জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসি এবং অনার্স-এর ভর্তি পরীক্ষাতে প্রশ্নপত্র ফাঁস যেন একটা অপরিহার্য নিয়মে পরিণত হয়েছে। আর এই প্রশ্নপত্র ফাঁসের ছোবল থেকে বাংলাদেশের নিয়োগ পরীক্ষাগুলোও আর রেহাই পাচ্ছে না। আমার মতে, বাংলাদেশে একমাত্র পিএসসি-ই স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় নিয়োগ সম্পন্ন করে। বাকি সব প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় প্রচুর দুর্নীতি হয়ে থাকে। গত ১৯ মে অগ্রণী ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। অবশ্য সকালে হয়ে যাওয়া পরীক্ষাটি গত ২৩ মে বাতিল করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং ও ইন্স্যুরেন্স বিভাগ। এর আগে গত ২১ এপ্রিল জনতা ব্যাংকের নির্বাহী কর্মকর্তা পদে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। এভাবে যদি প্রশ্নপত্র ফাঁসই হবে তবে শুধু শুধু টাকা খরচ করে পরীক্ষা নেওয়ার কি দরকার? দেশের সরকারি চাকরির পোস্টগুলো টাকা দিয়ে বিক্রি করে দিলেই তো হয়?

প্রশ্নপত্র ফাঁসের ফলাফল যে কতটা ভয়াবহ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রশ্নপত্র ফাঁসের কারণে দেশের মেধাবীরা চাকরি পায় না। দেশের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো দুর্নীতিবাজ, প্রশ্নপত্র ফাঁসের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত লোকের দ্বারা পূরণ হয়ে যায়। আবার অনেক সময় দেখা যায়, একটা সরকারি চাকরি নিতে জনপ্রতি ৫-২০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়। চাকরিতে ঘুষ দিয়ে ঢোকা ব্যক্তিটি চাকরি নেওয়ার সময় যে ৫-২০ লাখ টাকা ঘুষ দিয়েছিল তা আয় বা ইনকাম করার জন্য বিভিন্ন প্রকার অনিয়ম ও দুর্নীতির সাথে জড়িত হয়। আর এসব কারণেই হয়ত-বা দেশে দুর্নীতির মাত্রা আরো বেড়ে যায়।

বাংলাদেশে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ৫৫ ভাগ বিভিন্ন প্রকার কোটা ও বাকি ৪৫ ভাগ মেধা থেকে নিয়োগ দেওয়া হয়। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে মেধার চেয়ে কোটা থেকে এত বেশি সংখ্যক চাকরি প্রার্থী নিয়োগ দেওয়া হয় কি না তা আমার জানা নেই। তাছাড়া কোটায় যে পোস্টগুলো থাকে বেশিরভাগ সময়ই সেগুলো পূরণ হয় না। ফলে সেগুলো ফাঁকাই থেকে যায়। উপযুক্ত প্রার্থী থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র কোটা না থাকার জন্য অনেকেই চাকরি পায় না। ফলস্বরূপ বেকারত্ব আরো বেড়ে যায়। তাই কোটা পদ্ধতির সংস্কার করাটা এখন সময়ের দাবি।

বাংলাদেশের বেকার যুবকদের উপর এক ধরনের অবিচার লক্ষ করি আমি। আমাদের দেশে চার বছরের অনার্স কোর্স সেশনজটের কারণে শেষ হতে প্রায় পাঁচ/ছয় বছর লাগে। এই ক’বছরে বাবা-মা সন্তানের লেখাপড়ার জন্য প্রচুর টাকা ব্যয় করে থাকেন। অনার্স শেষ করে বের হওয়ার পর চাকরির আবেদন করতে অনেক টাকা চলে যায়। আবার প্রায় সব চাকরির পরীক্ষা ঢাকা শহরে হওয়ায় যাতায়াত বাবদ অনেক টাকা ব্যয় হয়। এই টাকা আমাদের মতো বেকার ছেলেগুলো কোথায় পাবে? বেকারদের নেই কোনো ইনকাম সোর্স। তাই যদি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষার আবেদন ফি’র পরিমাণ কমায় এবং পরীক্ষাগুলো বিভাগীয় পর্যায়ে নেয় তবে অবহেলিত এই বেকারদের অনেক বড় একটা উপকার হতো।

আমরা দেশের বোঝা হয়ে থাকতে চাই না। আমরাও দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে চাই, বিশ্বের কাছে দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করতে চাই। আমরাও চাই বৃদ্ধ বাবা-মায়ের মুখে একটু হাসি ফোটাতে, বৃদ্ধ বয়সে তাদের পাশে থেকে তাদেরকে সাপোর্ট করতে, নিজের পছন্দের মানুষটিকে বিয়ে করে ঘরে তুলতে। কিন্তু বেকার নামক এই তকমাটা যদি না ঘোচে তবে কী করে আমরা এসব ইচ্ছে পূরণ করব? তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আমার আকুল আবেদন— আপনি স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে চাকরির পরীক্ষাসহ সব পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিন। প্রশ্নপত্র ফাঁসের সাথে যারা জড়িত তারা আমাদের প্রিয় এ দেশটিকে ধ্বংস করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে। তারা এ দেশের পুরো সিস্টেমকে দুর্নীতিগ্রস্ত করতে চায়। তাই এদেরকে খু্ঁজে বের করে শাস্তির আওতায় আনুন। বেকারদের জন্য পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করুন। বেকারদের নিঃশব্দ কান্নার দিকে তাকিয়ে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করুন। আর যদি এসব না করা হয় তবে বাংলার আকাশ বাতাস বেকারদের বিষাক্ত ভারী নিঃশ্বাসে ভরে যাবে। তখন হয়ত-বা এই বিষাক্ত বাতাসে আপনাদের নিঃশ্বাস নিতেও অনেক কষ্ট হবে।