বাঙ্গালীর লুঙ্গী সমাচার

ডা. খায়রুল ইসলাম :

ছোটবেলায় বাংলা সিনেমায় দেখেছি – বড়লোক মানেই চৌধুরী সাহেব। চৌধুরী সাহেবরা লুঙ্গী পরেন না; তাঁরা স্লিপিং গাউন পরেন। তারপর এলো টেলিভিশনের যুগ। এখনো টেলিভিশনের বেশীর ভাগ নাটকে দেখি ছেলেরা ফুলপ্যান্ট পরে ঘুমায়।
আমাদের ছেলেবেলা কেটেছে হাফ প্যান্ট পরে।

এরপর যখন ক্যাডেট কলেজে গেছি, তখন আমাদের ভদ্রস্থ করার জন্য স্ট্রাইপ দেয়া স্লিপিং পাজামা পরে ঘুমানোর অভ্যাস করানো হয়েছে। কিন্তু আমি চৌধুরী সাহেবও হতে পারিনি; আর ক্যাডেট কলেজের ট্রেইনিংও ধরে রাখতে পারিনি। আমার বেলা শেষের আরামের পোষাক লুঙ্গী। সম্ভবত মেডিকেল কলেজের হোস্টেলে এই অভ্যাস দৃঢ় হয়েছে। ৬ নম্বর নলগোলা হোস্টেলে লুঙ্গী বিড়ম্বনার নানা গল্প নানা জনের নামে প্রচলিত আছে। সেগুলোর উল্লেখ না করাই ভালো; দেশ বিদেশের নামী দামী অধ্যাপকেরা তাতে বিব্রত হবেন। বর্তমানে কানাডা প্রবাসী আইসিডিডিআরবি-এর এক গবেষক বন্ধু তাঁর অননুকরনীয় প্রকাশভঙ্গীতে অনেক আগে ঠাট্টাচ্ছলে বলেছিল লুঙ্গী আর শাড়ী যতদিন রাতের পোষাক থাকবে বাংলাদেশে পরিবার পরিকল্পনার ভবিষ্যত অন্ধকার। বাংলাদেশে পরিবার পরিকল্পনার সাফল্যগাঁথার সাথে পোষাকের সম্পর্ক নিয়ে একটা পিএইচডি করা যেতে পারে।

অনেক সময় বাসায় মেহমান এলে আমি লুঙ্গী পরা থাকলে আমাকে সাবধান করা হয় – আমি যেন লুঙ্গী পরে মেহমানের সামনে না যাই। মাঝে মধ্যে লুঙ্গীর বদলে ইলাস্টিক দেয়া ফুলপ্যান্ট পরে মেহমানের সামনে যাই। তবে অফিস থেকে এসে কাপড় পালটে লুঙ্গী পরে একটু হাওয়া বাতাসের দোলাচলের খেলায় যে আরাম আর স্বস্তি পাই তা স্লিপিং পাজামা কিংবা অন্য কোন পোষাকে পাইনা। আর ঘুমানোর সময় লুঙ্গী না হলে আমার ঘুমই আসেনা।
প্রায় বছর বিশেক আগে গিয়েছিলাম নাইজারের রাজধানী নিয়ামী শহরে। প্লেনে লাগেজ আসেনি। পরের ফ্লাইট আসবে; আর পরের ফ্লাইট আসবে তিনদিন পর; সেটা আমার ফিরতি ফ্লাইট। কেএলএম অফিস আমাকে সাথে সাথে একশ ডলার নগদ দিয়ে দিল নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনার জন্য। সহকর্মীরা আমাকে তাঁদের শার্ট প্যান্ট ইত্যাদি ধার দিলেন। আমি বাজারে গেলাম আন্ডারওয়ার আর রাতে ঘুমাবার পোষাক কেনার জন্য।

নিয়ামীর বাজার তখন আমাদের যে কোন জেলা শহরের চাইতেও নিস্প্রান নিস্প্রভ। আন্ডারওয়ার পেলাম; কিন্তু রাতে ঘুমাবার উপযোগী কোন পোষাক পেলাম না। হঠাত তাকিয়ে দেখি আফ্রিকান নারীরা লুঙ্গীর মত কাপড় পরে আছে; ভীষণ রঙচঙে। আমি দোকানীর কাছে ঐ রকম কাপড় চাইলাম। কাপড় নিয়ে জনসমক্ষে ট্রায়াল দিয়ে দেখছি লুঙ্গীর মতো করে পরতে পারবো কিনা। আমাকে নারীদের মতো কাপড় পরতে দেখে বাচ্চা কাচ্চাদের একটা ছোট খাটো জটলা তৈরী হয়ে গেল। সবাই বেশ মজা পাচ্ছে। মাপে লাগসই হতেই একটা কাপড় কিনে ফেললাম।

একটা দর্জির দোকান খুঁজে পেলাম। কাপড়টা দিয়ে লুঙ্গী বানাবো। তবে লুঙ্গী সেলাই করতে বিশেষ দক্ষতা লাগে। কাপড়ের দুটো খোলা প্রান্ত এল শেপ করে এনে বেশীর ভাগ অংশকে মেশিনের উপরে রখে কোন আকাবাকা না করে সমান্তরাল দুটো সেলাই করতে হয়। বেশ কঠিন কাজ; অনেক নবীন দর্জি এজন্য লুঙ্গী সেলাই করতে চাননা। একে ফরাসী ভাষা জানিনা, তাঁর উপর দোভাষী। ভাষান্তর হয়ে লুঙ্গী কিভাবে সেলাই করতে হয় তা দর্জিকে কিছুতেই বোঝাতে পারা গেলোনা। কাপড় নিয়ে এলাম; আমি তিন রাত ঐ কাপড়কেই সেলাই ছাড়া লুঙ্গী হিসাবে ব্যবহার করলাম। টেলিভিশন নাটকের নায়কদের মতো ফুলপ্যান্ট পরে ঘুমাতে হলোনা।

অফিসের কাজে মাঝে মধ্যেই বাইরে যেতে হয়। কখনো কোন নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস নিতে ভুল হয়না। এবার এলাম দিন সাতেকের জন্য সুইডেন। আসবার দিন সন্ধ্যা থেকে স্ক্রলে দেখছিলাম বিমান বন্দরের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে; চেক ইনে সময় বেশী লাগবে; তাড়াতাড়ি যেতে হবে। সেভাবেই তৈরী হলাম। দীর্ঘ যাত্রা পথের পর হোটেলে চেক ইন করে এবার আরামের পালা। আমার আরাম মানে লুঙ্গী পরে বিছানায় সটান হওয়া। কিন্তু তন্নতন্ন করে সুটকেসে খুঁজে লুঙ্গী পেলামনা। লুঙ্গী আনাই হয়নি! খুব ভালো করেই বুঝি – স্টকহোম শহরে কোন দোকানে লুঙ্গী খুঁজে পাওয়া যাবেনা। অগত্যা, ফোন করি নারায়নগঞ্জের কৃতি সন্তান ৬ নম্বর নলগোলা হোস্টেলে আমার লুঙ্গীপরা এক সহপাঠীকে। কোন এক কালে, নদীভাঙ্গন প্রবন এক উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে চাকুরী জীবনের প্রারম্ভকালে প্রতিদিন সকালে হাতে এক বদনা পানি নিয়ে মেঘনা নদীর তীরে মৃদুমন্দ সমীরনে লুঙ্গীর ঘেরাটপে প্রাতঃকৃত্য সম্পন্ন করেছে। সে এখন ক্যারোলিস্কা ইন্সটিটিউটের হাসপাতালের শীর্ষস্থানীয় ডাক্তার। ভাবলাম লুঙ্গীর এমন উপকার ভোগীর কাছে স্পেয়ার লুঙ্গী তো থাকবেই। কি কপাল! সেও আর এখন লুঙ্গী পরেনা। কয়েকটা দিন ভালো করে ঘুম হবেনা, জানি। কারন; আমি এখনো লুঙ্গী পরা বাঙ্গালীই রয়ে গেছি।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর