দেশের আমের রাজধানী হিসাবে পরিচিত চাঁপাইনবাবগঞ্জ। আর দ্বিতীয় রাজধানী হিসেবে পরিচিতি করে নিয়েছে নওগাঁর বরেন্দ্র অঞ্চল নামে সুপরিচিত উপজেলা সাপাহার ও পোরশা। ইতিমধ্যেই এই দুইটি উপজেলার আম দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রফতানি করা হচ্ছে। সাপাহার ও পোরশা উপজেলায় এবারে আমের বাম্পার ফলনের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছেন এলাকার আম চাষীরা। তবে আম সংরক্ষণের তেমন কোনো আধুনিক ব্যবস্থা না থাকায় দরপতনের আশঙ্কায় শঙ্কিত চাষীরা ।
জেলার মধ্যে এই দুইটি উপজেলার মাটি আম চাষের জন্য বিশেষ উপযোগী হওয়ায় বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে আম চাষের নীরব বিপ্লব ঘটেছে। এখানে সাধারণত হাইব্রিড জাতের আম্রপলি, চষা, মল্লিকা, বারী ৩, ৪ ও দেশী জাতের মধ্যে ফজলী, সুরমা ফজলী, নাক ফজলী, ল্যাংড়া, গোপালভোগ, ক্ষীরসাপাতি, মোহনভোগ সহ বিভিন্ন জাতের সুমিষ্ট আম চাষ হয়ে থাকে।
আমের মৌসুমে প্রতিদিন শত শত টন আম এই উপজেলা থেকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় রফতানি হয়ে থাকে। এমনকি গত মৌসুমে পোরশা উপজেলার ঘাটনগর এলাকা থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও বারী-৪ জাতের আম রফতানি করা হয়েছিল। এবার মৌসুম শুরু হওয়ার আগ থেকে দুই উপজেলার আমের আড়তগুলোতে আম সংরক্ষণ করার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিতে দেখা গেছে। শত শত শ্রমিক এখন আমের আড়তে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
সাপাহার উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এএফএম গোলাম ফারুক হোসেন জানান, চলতি বছর প্রতি হেক্টর জমিতে ১০টন হিসেবে প্রায় ১লাখ ৫ হাজার টন আমের উৎপাদন হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। যার পরিমাণ বিগত বছরগুলোর চাইতে অনেক বেশি। যা স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে দেশের বিভিন্ন স্থানের চাহিদা মিটিয়েও বিদেশে রফতানি করা সম্ভব হবে।
তিনি আরো জানান, তবে অন্যান্য বছরের মত এবারও ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দরপতনের ফলে আম চাষীরা লোকসানের মুখে পড়বে কি না তা এখনো বলা যাচ্ছে না।
পোরশা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান বলেন, এবার মৌসুমের শুরু থেকেই প্রতিটি গাছে ব্যাপক মুকুল ও গুটি এসেছে। এরপর থেকে আম বাগান মালিকরা ভালো ফলন পাওয়ার আশায় পরিচর্যা করছেন। নিয়মিত আমগুলোকে টিকিয়ে রাখতে দিনে দুই থেকে তিনবার গাছে পানি স্প্রে করাসহ ছত্রাকনাশক ঔষধ প্রয়োগ করছেন।
পোরশা উপজেলার আমচাষী হাবিবুর রহমান বলেন, আম যেনো গাছ থেকে ঝড়ে না যায় সেজন্য আমের মুকুল আসার পর থেকেই কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শক্রমে নিয়মিত পানি স্প্রে ও বালাইনাশক ঔষধ প্রয়োগ করে আসছি। আবহাওয়া অনুকুলে থাকলে এবার আমের বাম্পার ফলনের আশা করছি।
একই উপজেলার সরাইগাছী এলাকার বাগান মালিক রাশেদ বলেন, গত কয়েক দিন পূর্বে তীব্র খরার কারণে আমের বোঁটা শুকিয়ে গিয়ে আম ঝড়ে পড়া শুরু করলেও হঠাৎ করে আকাশের বৃষ্টি হওয়ার পর থেকে আর তেমন কোনো সমস্যা নাই। তাই এবার আমের উৎপাদন খুব ভালো হবে বলে আমি আশাবাদী।
সাপাহারের বাগান মালিক তছির উদ্দীন সোনার জানান, প্রতি বছর বেশ ভালো দামে আম বাগান বিক্রি করে এই এলাকার আম চাষিরা। গত বছরের তুলনায় এবার এখন পর্যন্ত আমের অবস্থা খুবই ভালো আছে। আশা করছি এবার কৃষকরা আম থেকে বেশ লাভবান হবে।
সাপাহার উপজেলার আম ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, প্রতি বছরের ন্যায় এবারও আমের ভালো ব্যবসা করতে পারবো বলে আশা করছি। বর্তমানে আমার আমের আড়তে প্রতিদিন প্রায় ২৫জন শ্রমিক কাজ করে থাকেন। আমার আড়তে আমের আমদানিও হয়ে থাকে প্রচুর। শেষ পর্যন্ত আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে আমের বাম্পার ফলনে আম চাষিদের মুখে হাঁসি ফুটবে বলে আমি আশা করছি।
পোরশা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইফতেখার উদ্দীন শামীম ও সাপাহার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ মুনিরুজ্জামান বলেন, বরেন্দ্র ভূমির সীমান্তবর্তী এই এলাকায় যথাযথ প্রচারণার অভাব, সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবস্থা না থাকায় এলাকার চাষীরা এবং দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। তাই দ্রুত এই সমস্যা নিরসন করে স্থানীয় জনগন ও আম চাষীদের ভাগ্যোন্নয়নে এই উপজেলাগুলোতে আম সংরক্ষণ করার জন্য একটি আধুনিক মানসম্মত হিমাগার এবং আম দ্বারা বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য উৎপাদনের ফ্যাক্টরি স্থাপনে ব্যক্তিগত অথবা সরকারিভাবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য বিনিয়োগ বোর্ডের নির্বাহী চেয়ারম্যান ও রাজশাহী বিভাগীয় পরিচালকসহ বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন পাঠিয়েছি।
নওগাঁ জেলা কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সত্যব্রত সাহা জানান, জেলার বরেন্দ্র অঞ্চলের অংশ সাপাহার ও পোরশা উপজেলায় চলতি বছর ১০হাজার ৫শ’ হেক্টর জমিতে আমের চাষ করা হয়েছে। এসব উপজেলায় ৫বছর ধরে হাইব্রিডসহ বিভিন্ন জাতের আম বাণিজ্যিক ভাবে চাষ করছেন এলাকার আম চাষিরা। এতে করে তারা বেশ লাভবান হচ্ছেন। আম চাষে অধিক লাভ করা সম্ভব বলে এই বরেন্দ্র অঞ্চলের লোকজন দিন দিন আম চাষের দিকে ঝুঁকছেন।