মাছে ভাতে বাঙালি। মাছ, গোশত না থাকুক, কিন্তু চাল থাকলেই যথেষ্ট। একটি লঙ্কা আর একটি পেঁয়াজ হলেই পেটের ক্ষুদা নিবারণ করে মাঠে নেমে পড়ে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার কারিগর লক্ষ লক্ষ কৃষক। গত দু’বছর ধরে এই কৃষকেরা তাদের ভাষায় ল²ী দানা’র আবাদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছে। প্রভাব পড়েছে গত আমন মৌসুমে ধানের সাথে সাথে মোটা ধান আবাদ থেকেও পিছিয়ে পড়েছে। যা হবার তাই হয়েছে। বাজারে ধান ও চালের দাম স্মরণাতিতকালের মতো বৃদ্ধি পেয়েছে। চলতি বোরো মওসুমে কৃষিনির্ভর দিনাজপুর অঞ্চলে প্রায় আট লক্ষ হেক্টর জমিতে ধানের আবাদ কম হয়েছে। এর উপর চৈত্র মাসের খরতাপের মাস চৈত্রের দাবদাহের জায়গায় অনাকাক্সিক্ষত বৃষ্টিপাত। পানিনির্ভর ইরি-বোরো ক্ষেতে পানি জমে গোড়া পচা রোগ দেখা দিয়েছে। অর্থনৈতিক চরম সঙ্কটে থাকা কৃষকেরা বিষ আর সার ছিটিয়ে ইরি-বোরো ক্ষেত রক্ষার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
অপরদিকে অকাল বর্ষণ আর পাহাড়ি ঢল হাওর অঞ্চলের ধানকে গিলে ফেলেছে। উত্তরাঞ্চলের চিত্রও সুখকর নয়। তিস্তা সংলগ্ন হাজার হাজার হেক্টর জমি পানিতে ডুবে গেছে। ফলে একদিকে কৃষকদের অনিহা, অপরদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ধানের ফলনকে বিপর্যস্ত করেছে। এর মধ্যেই সরকারিভাবে ধান চাল ক্রয়ের ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
গত বছরের তুলনায় দাম বাড়ানো হয়েছে বস্তা প্রতি প্রায় ৫০০ টাকা। অর্থাৎ বেড়ে যাওয়া চালের দাম আর কমছে না। ফলে কৃষকের কল্যাণে ধান চালের দাম বৃদ্ধির সরকারি সিদ্ধান্ত কৃষকের জন্য বাঁচা-মরার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। কেন না, সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ধান ক্রয় নিশ্চিত করা না হলে মধ্যস্বত্তভোগীরাই লাভবান হবে। আর দলের সুযোগ সন্ধানীরা যদি কৃষকের কার্ড দিয়ে গোডাউনে ধান বিক্রি করে থাকে তাহলে আরো সর্বনাশ হবে। উপায় না পেয়ে বাজারে কম দামে ধান বিক্রি করে বরাবরের মতো ভাগ্য বঞ্চিত হয়ে পথে বসা ছাড়া কোনো পথ থাকবে না।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, দিনাজপুর জেলার ১৩টি উপজেলায় এবার এক লক্ষ ৭০ হাজার হেক্টর জমিতে ইরি-বোরো চাষ করা হয়েছে। যদিও এক লক্ষ ৭৩ হাজার ৬৫০ হেক্টর জমিতে ইরি-বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী চাল উৎপাদন নির্ধারণ করা হয় ছয় লক্ষ ৮৫ হাজার মেট্রিক টন। গত বছর জেলায় এক লক্ষ ৭৮ হাজার ৮৯৭ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ হয়েছিল। অর্জিত বোরো চাষে ফলন হয়েছিল ছয় লক্ষ ৮৪ হাজার ২১৮ মেট্রিক টন চাল। গতবারের তুলনায় প্রায় আট হাজার হেক্টর জমিতে আবাদ কম হয়েছে।
সেচের ফসল হিসাবে পরিচিত ইরি-বোরো ধান চাষে কৃষকদের সেচের জন্য অতিরিক্ত টাকা খরচ করতে হয়নি। ইতোমধ্যে সবুজ ক্ষেত ভরা গাছে ধানের শীষ ফুটতে শুরু করেছে। আগাম রোপনকৃত ধান গাছে দানাও ফুটেছে। কৃষকেরা আশা করছেন, আগাম ২০ থেকে ২৫ দিনের মধ্যে ধান কাটা শুরু হবে। খরতাপের মাস চৈত্র মাসে দাবদাহের জায়গায় বৃষ্টির কারণে ইরি-বোরো ধানের ক্ষেতে পানি জমে যায়। আর এ কারণে দেখা দেয় গোড়া পচন রোগ ও পোকার আক্রমন। সদর উপজেলার দক্ষিণাঞ্চলের কিছু এলাকায় এই রোগ বেশি দেখা দেয়। গাছের গোড়া পচে যাওয়ায় গাছ মরে গেছে। ফলে ধান পাবেন না কৃষকেরা।
দিনাজপুর সদর উপজেলার কিষাণ মাধবপুর গ্রামের কৃষক মিজানুর রহমানের সাথে তিনি জানালেন, গোড়া পচন রোগ ও পোকা মাকড় দমনের জন্য আমরা উপর্যুপরি বিষ ও সার প্রয়োগ করছি। যে ক্ষেতের ধান মরে গেছে তা আর পাবো না। পাশের ক্ষেতগুলোকে বাঁচানোর চেষ্টা করছি। তার অভিযোগ অতি বৃষ্টির কারণে গোড়া পচা রোগ হয়েছে। কিন্তু এর প্রতিকার হিসাবে কি দেব তা আমরা জানি না। কৃষি বিভাগের লোকজনও পরামর্শ দিতে আসেনি। তার ক্ষোভ আমরা আর কত ক্ষতির মুখে পড়ব। আমাদের আবাদের দরকার নাই, জমি অনুযায়ী আমাদের বছরের খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিক সরকার।
অল্প জমিতে বেশি ধান ফলনের মাধ্যম কৃষক বাঁচানো সম্ভব। একথা মাথায় নিয়ে কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিনিয়ত উন্নত জাতের ধান বীজ কৃষকদের কাছে সরবরাহ করছে। দিনাজপুর কৃষি অধিদপ্তরের গবেষণা কর্মকর্তা আতিকুর রহমান জানান, এবারে জেলায় ভালো ফলনের জন্য হাইব্রিড জাতের অধিক ফলনশীল ধানের ভ্যারাইটি এসিআই, আফতার, জিরা, জাগরণ, এরাইস, টিয়া ও নীলসাগর ধানের চারা রোপন করতে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। এই ভ্যারাইটির ধান প্রতি হেক্টরে ৪ দশমিক ৭৫ মেট্রিক টন থেকে ৫ মেট্রিক টন পর্যন্ত ফলন উৎপাদন করা সম্ভব হবে। দেশি উফশি জাতীয় ধানের মধ্যে ব্রি-২৮, ২৯, ৫৮, ৪৫, ৫৫, বিআর-১৬ ও কোটরা পারি ধানের ফলন বেশি ও বালাইমুক্ত হওয়ায় কৃষকদের এই ধানের বীজ রোপনে উদ্বুদ্ধ করা হয়। এসব দেশি উফশি জাতীয় ধান প্রতি হেক্টরে ৩ দশমিক ৮৬ মেট্রিক টন থেকে ৪ মেট্রিক টন পর্যন্ত ফলন অর্জিত হয়। এবারে হাইব্রিড ও উফশি উন্নত জাতের এসব বোরো ধানের চারা রোপন বেশি হয়েছে।
দিনাজপুর বিআরডিবি সার বিভাগের উপ-পরিচালক দিদার হোসেন জানান, জেলায় বোরো চাষে কৃষকদের পর্যাপ্ত সার সরবরাহের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। চলতি বছর বোরো চাষের ১৩ হাজার ৮১০ মেট্রিক টন ইউরিয়া, এক হাজার ৭৫৯ মেট্রিক টন টিএসপি, এক হাজার ৪৩ মেট্রিক টন ড্যাব ও দুই হাজার ১৯ মেট্রিক টন এমওপি রাসায়নিক সার চাহিদা রয়েছে। চাহিদার বিপরীতে দ্বিগুন পরিমাণ সার বিআরডিবির গুদামে মজুদ রয়েছে। জেলার ১২৬ জন রাসায়নিক সার ডিলার ও ৩৭৮ জন সাব-ডিলারের মাধ্যমে ন্যায্যমূল্যে সার বিক্রির সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কৃষকেরা সহজে সার ক্রয় করে বোরো চাষে ব্যবহার করছেন।
কিন্তু মদ্যা কথা, ধানের ফলন বাড়লে কি হবে, যদি না দাম পায় কৃষকেরা। তাদের মতে, গত কয়েকবছর ধরে হাইব্রিড আবাদ করে কৃষকেরা বিঘায় ৪০ মণ ধান উৎপাদন করেছে। কিন্তু হয়েছে কি। এক বস্তা ধান বিক্রি করতে হয়েছে ৭০০ টাকায়। আর দেশি চিকন ধান আবাদ করে বিঘায় ১৫ মন ধান উৎপাদন হলেও এক বস্তা ধান বিক্রি হয়েছে তিন হাজার টাকায়। আর এ কারণে গত বছর আমন মৌসুমে মোটা ধানের আবাদ অর্ধেকে নেমে আসে। অবশ্য কৃষি বিভাগ এ তথ্য মানতে নারাজ। তারা কাগজে কলমে গতানুগতিকভাবে বাম্পার আবাদ ও বাম্পার ফলনের চিত্র উচ্চ পর্যায়ে দিয়ে আসছে। কিন্তু বাজারে যে মোটা ধান চালের সঙ্কট হয়েছে তা স্পষ্ট হয়ে গেছে এবারের উর্ধ্বমুখী চালের বাজারের মাধ্যমে।
এদিকে সরকার ঘোষিত এবারের ধান চালের মূল্য নিয়ে কৃষকেরা খুশি হওয়ার কথা। তাদের মতে, আমাদের কাছে সরকার ধান নিলে তো আমরা দাম পাব। না হলে টাকার জন্য আমাদেরকে ব্যবসায়ীদের কাছেই কম দামে ধান বিক্রি করতে হবে। তাই কৃষকদের কাছ থেকে ধান ক্রয়ের জন্য বাজারভিত্তিক গ্রোথ সেন্টার অথবা ইউনিয়ন পরিষদগুলোকে কাজে লাগানো উচিত। এ ক্ষেত্রে খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের গোডাউনের পরিবর্তে গ্রোথ সেন্টার অথবা ইউপি কার্যালয়ে থেকে কৃষকদের কাছ থেকে ধান করা হলে কৃষকরা উপকৃত হবে। নচেৎ সরকারি ক্রয় মূল্য বাড়ালে বাজারে দাম বাড়বে, কিন্তু কৃষকরা দাম পাবে না
সংবাদ শিরোনাম
সরকারি ক্রয়মূল্য কাজে আসছে না ধান চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন উত্তরাঞ্চলের কৃষক
- Reporter Name
- আপডেট টাইম : ১২:৩৮:০৪ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২০ এপ্রিল ২০১৭
- ২৬১ বার
Tag :
জনপ্রিয় সংবাদ