হাওরজুড়ে এখন শোকে কান্না পানির নিচে কৃষকের স্বপ্ন

কিশোরগঞ্জের হাওরজুড়ে এখন কেবলই হাহাকার। ফসল হারানোর শোকে ঘরে ঘরে কান্না। চৈত্রের টানাবর্ষণ আর পাহাড়ি ঢলে
সর্বস্বান্ত লাখো কৃষক। প্রত্যন্ত হাওরের তিন উপজেলা ইটনা, অষ্টগ্রাম ও মিঠামইনের বেশিরভাগ ফসলের মাঠই এখন পানির নিচে। কৃষকের ঘাম ঝরানো ফসলের মাঠে বিস্তীর্ণ জলরাশি। কোথাও বুক পরিমাণ আবার কোথাওবা তার চেয়ে বেশি। হাওরজুড়ে থাকা সবুজ ফসলের মাঠ সপ্তাহের ব্যবধানে উধাও হয়ে গেছে। চোখের সামনে জমির কাঁচা ধান তলিয়ে যাওয়ার দুঃসহ দৃশ্য দেখে বুক চাপড়াচ্ছেন কৃষক। অনেকেই একমাত্র ফসল হারিয়ে বাকরুদ্ধ। ধান পাকার আগেই এমন ফসলহানির শিকার নিকট অতীতে আর হননি হাওরবাসী। জেলা কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত জেলায় ২৩ হাজার ২৭০ হেক্টর জমির ফসলহানি হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ইটনা, অষ্টগ্রাম ও মিঠামইন এই তিন উপজেলায় মোট আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ৬৮ হাজার ১৭৭ হেক্টর। এর মধ্যে অষ্টগ্রাম উপজেলায় সর্বোচ্চ ১১ হাজার ৯৬৫ হেক্টর, ইটনায় ৫ হাজার ৮০ হেক্টর ও মিঠামইনে ৪ হাজার ৮৪০ হেক্টর জমি তলিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে স্থানীয় কৃষকেরা কৃষি বিভাগের এই হিসাব মানছেন না। তারা বলছেন, ক্ষতির পরিমাণ আরো অনেক বেশি। ইটনা, অষ্টগ্রাম ও মিঠামইন এই তিনটি উপজেলায় আবাদি জমির বেশিরভাগই তলিয়ে গেছে। সে হিসাবে অন্তত এখন ৪০ হাজার হেক্টর জমির ফসলহানি হয়েছে। এসব জমিতে উৎপাদিত হতো অন্তত ৮০ লাখ মণ ধান, যার প্রাথমিক মূল্য পাঁচশ কোটি টাকারও বেশি। এছাড়া তলিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে এখন পর্যন্ত অক্ষত হাওরগুলোও। কৃষকেরা নিজ উদ্যোগে এসব হাওরের বাঁধে মাটি ফেলে ফসল রক্ষার শেষ চেষ্টা করে চলেছেন। শুক্রবার আবহাওয়া তুলনামূলক ভালো থাকলেও পানি কমেনি। এ পরিস্থিতিতে কৃষক ফসলহানির আশঙ্কা থেকে আধাপাকা ধান কাটা শুরু করে দিয়েছেন। তবে শ্রমিক সংকটের কারণে এসব ধান কাটতে গিয়েও বিপাকে রয়েছেন কৃষক। বোরো মৌসুমে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মৌসুমী ধান কাটা শ্রমিক এলেও এবার হাওর তলিয়ে যাওয়ার খবরে তারা আসেননি। ফলে স্থানীয় ধান কাটা শ্রমিক নিয়ে চলছে কাড়াকাড়ি। মাথাপিছু ৬-৭শ’ টাকা দিয়েও মিলছে না শ্রমিক। ইটনার মুদিরগাঁও গ্রামের কয়েকজন কৃষক জানিয়েছেন, দুদিন আগেও তাদের উত্তরেরবন্দ অক্ষত ছিল। কিন্তু বুধবার ভোরে জয়সিদ্ধির দুধবান্না ও নান্দারকান্দা দিয়ে হাওরটিতে পানি ঢুকে। দেখতে দেখতে হাওরটি তলিয়ে যায়। হাওরটিতে মুদিরগাঁও গ্রামের কৃষকদের এক হাজার একর জমি ছিল। একইভাবে পাশের মৃগা ইউনিয়নের ১০টি ফসলরক্ষা বাঁধের মধ্যে ৯টি বাঁধ ভেঙে গেছে। একমাত্র বস্তিপুড়ার বাঁধটি কোনোরকমে টিকে আছে। মৃগা ইউনিয়নের তলিয়ে যাওয়া ৯টি বাঁধের মধ্যে প্রায় ৫ হাজার হেক্টর জমি রয়েছে বলে ক্ষতিগ্রস্তরা জানিয়েছেন। কৃষকেরা জানিয়েছেন, দুই হাজার একরের বামনদিগার হাওর, চার হাজার একরের বুড়ির লাইনের বাঁধের হাওর, চার হাজার একরের জোয়ারের হাওর, বারকোনা হাওর, ছিমতখালীর হাওর, হুরুঙ্গার হাওর ও সিংগার হাওর, সাতশ’ একরের নড়িবিলের বাঁধ, পাঁচশ একরের নলমোড়ার বাঁধ এবং চারশ’ একরের রেজু মিয়ার বাঁধ তলিয়ে এখন পানি থৈ থৈ করছে। ফসল হারিয়ে লাইমপাশা, ভাটি রাজিবপুর, উজান রাজিবপুর, রামকৃষ্ণপুর, পাটাবুকা, জগন্নাথপুর, কালীপুর, কাটিয়ারকান্দা, শ্রীরামপুর, বড়বাড়ি চানপুর, ঝুরকান্দি, শান্তিপুর, গজারিয়াকান্দা, আন্ধাইর ও প্রজারকান্দা গ্রামের কৃষক এখন অকুলপাথারে। এছাড়া ধনপুর ইউনিয়নের চাচুয়া, হাপানিয়া ও গয়রার হাওর তলিয়ে প্রায় দুই হাজার একর জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইটনা উপজেলা সদরের হালালেরবন্দ তলিয়ে যাওয়া ছাড়াও ধনু নদীতে পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। লাইমপাশা গ্রামের রফিকুল ইসলাম জানান, তিনি এবার ২০ একর জমিতে বোরো আবাদ করেছিলেন। কিন্তু তার কষ্টের ফসল এখন পানির নিচে। উজান রাজিবপুর গ্রামের হাজী আবদুল হেকিম জানান, তিনি ৬০ একর জমি করেছিলেন। কিন্তু অসময়ের পানিতে সব তলিয়ে গেছে। এক ছটাক ধানও ঘরে আনার কোনো উপায় বলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন তিনি। জয়সিদ্ধি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. মনির উদ্দিন জানান, পাঁচদিন আগে বিজয়বাঁধ হাওর তলিয়ে যাওয়ায় তার ইউনিয়নের শতকরা ৯০ ভাগ কৃষক একেবারে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ে। এখন মুদিরগাঁও উত্তরেরবন্দ তলিয়ে যাওয়ায় ঘরে ফসল তোলার মতো আর কোনো কৃষক বাকি রইলো না। ফসল হারানোর শোকে ইউনিয়নের জয়সিদ্ধি, করণশী, আলগাপাড়া, ভয়রা, বীরকুল, মুদিরগাঁওসহ গ্রামে গ্রামে এখন কান্নার রোল পড়েছে। চারদিকে শুধু মানুষের হাহাকার আর আহাজারি। সান্ত্বনা দেয়ার মতো মানুষও কেউ অবশিষ্ট নেই। এদিকে নতুন করে মিঠামইনের ঘাগড়া ইউনিয়নের চিরুন, বড়বিল, আপর, বিসোরকোনা, খলাপাড়া, মান্দাউরা, ভরাজিনদার, জুইয়ার, চরবৌলাই, হামালি, কাইকাদার, কোসের আড্ডা, নৌকুশা, ভরা মালিউন্দ, চমকপুর, কুমারদিঘা হাওরে পানি ঢুকে প্রায় তিন হাজার একর বোরো জমি তলিয়ে গেছে। ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম উপজেলা নিয়ে গঠিত কিশোরগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, হাওরের মানুষ একটিমাত্র বোরো ফসলের ওপর নির্ভরশীল। টানা বর্ষণ আর পাহাড়ি ঢলে সেই ফসল তলিয়ে যাওয়ায় কৃষক এখন দিশেহারা। এ পরিস্থিতিতে কৃষককে বাঁচাতে হলে এ এলাকাকে দুর্গত হিসেবে ঘোষণার বিকল্প নেই।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর