ঢাকা ০৯:২৯ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কিশোরগঞ্জের হাওরে কৃষকের কান্না

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০২:২৪:৪৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৪ এপ্রিল ২০১৭
  • ৬২০ বার

দিন দশেকের মধ্যেই জেলার হাওরে বোরো ধান কাটার ধুম পড়ার কথা। ভালো ফলনে উচ্ছ্বসিত হাওরের কৃষকের মাঝেও চলছিলো সেই বোরো উৎসবের প্রস্তুতি। কিন্তু গত কয়েকদিনের টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে তছনছ হয়ে গেছে কৃষকের স্বপ্ন।

নদীর কূল উপচে আর ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হচ্ছে একের পর এক হাওর। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি বড় হাওরসহ অন্তত ত্রিশটি হাওর ভাসছে সর্বনাশা আগাম বানের পানিতে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অন্তত বিশ হাজার হেক্টর জমির ধান। এছাড়া নদীর পানি অব্যাহতভাবে বাড়তে থাকায় হুমকির মুখে রয়েছে বেশিরভাগ ফসল রক্ষা বাঁধ।

এ পরিস্থিতিতে চরম বিপর্যয়ের মুখে এখানকার কৃষক। ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রামের হাওরে হাওরে এখন বিপন্ন কৃষকের আহাজারি।মিঠামইনের কাটখাল, বৈরাটি, কেওয়ারজোড় ও ঢাকী, ইটনার জয়সিদ্ধি ও এলংজুরি এবং হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ উপজেলার কাকাইলছেও এই ৭টি ইউনিয়নের অন্তত ২২টি গ্রামের কৃষকের জমি রয়েছে এই হাওরের মধ্যে। একইভাবে ইটনা উপজেলার ইটনা সদরের বেড়ারবন্দ, রায়টুটীর হাজলারকান্দা, আড়ালিয়া, ধারা ও গন্ধবপুর, বড়িবাড়ীর কনিয়ার হাওর ও পাটাইয়া বিল, চৌগাঙ্গার কয়রার হাওর এবং ধনপুরের হাপানিয়া হাওর, ষাটংগা ও নালুয়ার হাওর তলিয়ে গেছে।অষ্টগ্রাম উপজেলার বড় হাওরসহ শিয়াল ভাঙ্গা, কৈরাইল, আদমপুর, নুরপুর, সমারচর, আব্দুল্লাহপুর, কাকুরিয়া, চন্ডিপুর, ইছাপুর, কলিমপুর, চরদেওঘর, আনোয়ারপুর, পানিতোলপা, চরপ্রতাপ, খারুয়াইল, লাউড়ার চর, হায়দরাবাদ হাওরের কাঁচাপাকা ধানীজমি তলিয়ে গেছে। বৈঠাখালী ও বিলমাকসার সংযোগ গাঙ্গিনার বাঁধ ভেঙে হাওরের জমি তলিয়ে গেছে।

কৃষকেরা জানান, গত কয়েকদিনের টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে মেঘনা, কালনী, কুশিয়ারা, ধনু, দাইরা, ঘোড়াউত্রা, ধলেশ্বরী, করাতিয়া কলকলিয়া, বৈঠাখালী, কলমারবাক নদীতে অস্বাভাবিকভাবে পানি বাড়ছে। এসব নদীর পানি বাড়ায় সংলগ্ন হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধগুলো হুমকির মুখে পড়ে। গত তিনদিন ধরে পানির চাপে নদীর দু’কূল উপচে বিভিন্ন হাওরে পানি ঢুকে প্লাবিত হচ্ছে। এছাড়া ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙেও কয়েকটি হাওর প্লাবিত হয়েছে। এতে এসব হাওরের ধানী জমি তলিয়ে যাওয়ায় কৃষক সর্বশান্ত হয়ে পড়েছেন।

এর মধ্যে শনিবার ভোরে তলিয়ে গেছে প্রায় ১২ হাজার একর জমির বিজয় বাঁধের হাওর। ৩২ কিলোমিটার সার্কুলার এই বাঁধের মিঠামইনের কৈশর থেকে চারিগ্রামের দিকে প্রায় এক কিলোমিটার এলাকা দিয়ে নদীর পাড় উপচে পানি হাওরে ডুকে। গত দু’দিনে হাওরের বেশিরভাগ জমি চলে গেছে পানির নিচে।

এছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ ইটনার ঝিয়লের হাওর, কারার বন্দ হাওর, বস্তিপুর হাওর বাঁধ, গয়রার হাওর বাঁধ, তেড়ালিয়া হাওর বাঁধ এবং বোয়ালদা হাওর বাঁধের বাঁধ ছুঁইয়ে পানি ঢুকছে এবং ঝিয়লের বাঁধের লড়িখাই অংশে পানি আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঝিয়লের হাওর, কারার বন্দ হাওর এবং বস্তিপুর হাওর বাঁধ একটির সঙ্গে আরেকটি যুক্ত হওয়ায় এর যেকোনো একটি বাঁধ ভেঙে গেলে ৩টি হাওরই তলিয়ে যাবে বলে কৃষকেরা জানিয়েছেন।

পাশ্ববর্তী বিলমাকসার বাঁধটি রক্ষার জন্য হালালপুর ও কাকুরিয়া গ্রামের ৫ শতাধিক নারী পুরুষ মাথায় মাটির বোঝা বয়ে বাঁধ রক্ষা করার জন্য প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। নদীর পানি বাড়তে থাকায় ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রামের এখন প্রায় সবক’টি ফসল রক্ষা বাঁধই ঝূঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। দিন-রাত মাটি কেটে বাঁধে ফেলে একমাত্র ফসল রক্ষার শেষ চেষ্টা করছেন কৃষকেরা।

বিজয় বাঁধ এলাকার কৃষক হাবিবুর রহমান জানান, এই হাওরে তার ১৯ একর জমি রয়েছে। এবার ধান পাকার আগেই জমি তলিয়ে গেছে। ফলে এক ছটাক ধানও ঘরে তুলতে পারবেন না।

কৃষক সোলাইমান ঠাকুর জানান, ধারদেনা করে অনেক কষ্টে দুই একর জমিতে বোরো আবাদ করেছিলেন। কিন্তু পানিতে পুরো হাওরই তলিয়ে গেছে।

কৃষক হামিদ মিয়া জানান, ধান সবে রঙ ধরেছে। এর মাঝেই তলিয়ে গেছে। এগুলো কেটে আনলে গরুকেও খাওয়ানো যাবে না।

ইটনা উপজেলা সদরের বড়হাটি গ্রামের মুক্তার মিয়া জানান, তিনি ৬০ একর জমিতে বোরো চাষ করেছেন। ফলনও ভালো হয়েছে। জমির আ’লে দাড়িয়ে চোখ জুড়িয়ে যেতো। কিন্তু সর্বনাশা বানের পানি তার সব আনন্দকে বিষাদে পরিণত করে দিয়েছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম উপজেলার তিনটি হাওরে মোট ৬৮ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে তিন উপজেলায় পনেরো হাজার হেক্টরের মতো জমি পানিতে তলিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

এ ব্যাপারে স্থানীয় (কিশোরগঞ্জ-৪) সংসদ সদস্য রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক জানান, ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে ফসলহানির ঘটনা ঘটছে না। যেসব হাওর তলিয়ে গেছে সেসবের বেশিরভাগই নদীর পাড় ডুবে পানি ঢুকেছে। নদীর নাব্যতা হারানোই এর অন্যতম কারণ।

তিনি এলাকায় অবস্থান করে ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপারে খোঁজখবর নিচ্ছেন বলেও জানান।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

কিশোরগঞ্জের হাওরে কৃষকের কান্না

আপডেট টাইম : ০২:২৪:৪৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৪ এপ্রিল ২০১৭

দিন দশেকের মধ্যেই জেলার হাওরে বোরো ধান কাটার ধুম পড়ার কথা। ভালো ফলনে উচ্ছ্বসিত হাওরের কৃষকের মাঝেও চলছিলো সেই বোরো উৎসবের প্রস্তুতি। কিন্তু গত কয়েকদিনের টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে তছনছ হয়ে গেছে কৃষকের স্বপ্ন।

নদীর কূল উপচে আর ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হচ্ছে একের পর এক হাওর। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি বড় হাওরসহ অন্তত ত্রিশটি হাওর ভাসছে সর্বনাশা আগাম বানের পানিতে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অন্তত বিশ হাজার হেক্টর জমির ধান। এছাড়া নদীর পানি অব্যাহতভাবে বাড়তে থাকায় হুমকির মুখে রয়েছে বেশিরভাগ ফসল রক্ষা বাঁধ।

এ পরিস্থিতিতে চরম বিপর্যয়ের মুখে এখানকার কৃষক। ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রামের হাওরে হাওরে এখন বিপন্ন কৃষকের আহাজারি।মিঠামইনের কাটখাল, বৈরাটি, কেওয়ারজোড় ও ঢাকী, ইটনার জয়সিদ্ধি ও এলংজুরি এবং হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ উপজেলার কাকাইলছেও এই ৭টি ইউনিয়নের অন্তত ২২টি গ্রামের কৃষকের জমি রয়েছে এই হাওরের মধ্যে। একইভাবে ইটনা উপজেলার ইটনা সদরের বেড়ারবন্দ, রায়টুটীর হাজলারকান্দা, আড়ালিয়া, ধারা ও গন্ধবপুর, বড়িবাড়ীর কনিয়ার হাওর ও পাটাইয়া বিল, চৌগাঙ্গার কয়রার হাওর এবং ধনপুরের হাপানিয়া হাওর, ষাটংগা ও নালুয়ার হাওর তলিয়ে গেছে।অষ্টগ্রাম উপজেলার বড় হাওরসহ শিয়াল ভাঙ্গা, কৈরাইল, আদমপুর, নুরপুর, সমারচর, আব্দুল্লাহপুর, কাকুরিয়া, চন্ডিপুর, ইছাপুর, কলিমপুর, চরদেওঘর, আনোয়ারপুর, পানিতোলপা, চরপ্রতাপ, খারুয়াইল, লাউড়ার চর, হায়দরাবাদ হাওরের কাঁচাপাকা ধানীজমি তলিয়ে গেছে। বৈঠাখালী ও বিলমাকসার সংযোগ গাঙ্গিনার বাঁধ ভেঙে হাওরের জমি তলিয়ে গেছে।

কৃষকেরা জানান, গত কয়েকদিনের টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে মেঘনা, কালনী, কুশিয়ারা, ধনু, দাইরা, ঘোড়াউত্রা, ধলেশ্বরী, করাতিয়া কলকলিয়া, বৈঠাখালী, কলমারবাক নদীতে অস্বাভাবিকভাবে পানি বাড়ছে। এসব নদীর পানি বাড়ায় সংলগ্ন হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধগুলো হুমকির মুখে পড়ে। গত তিনদিন ধরে পানির চাপে নদীর দু’কূল উপচে বিভিন্ন হাওরে পানি ঢুকে প্লাবিত হচ্ছে। এছাড়া ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙেও কয়েকটি হাওর প্লাবিত হয়েছে। এতে এসব হাওরের ধানী জমি তলিয়ে যাওয়ায় কৃষক সর্বশান্ত হয়ে পড়েছেন।

এর মধ্যে শনিবার ভোরে তলিয়ে গেছে প্রায় ১২ হাজার একর জমির বিজয় বাঁধের হাওর। ৩২ কিলোমিটার সার্কুলার এই বাঁধের মিঠামইনের কৈশর থেকে চারিগ্রামের দিকে প্রায় এক কিলোমিটার এলাকা দিয়ে নদীর পাড় উপচে পানি হাওরে ডুকে। গত দু’দিনে হাওরের বেশিরভাগ জমি চলে গেছে পানির নিচে।

এছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ ইটনার ঝিয়লের হাওর, কারার বন্দ হাওর, বস্তিপুর হাওর বাঁধ, গয়রার হাওর বাঁধ, তেড়ালিয়া হাওর বাঁধ এবং বোয়ালদা হাওর বাঁধের বাঁধ ছুঁইয়ে পানি ঢুকছে এবং ঝিয়লের বাঁধের লড়িখাই অংশে পানি আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঝিয়লের হাওর, কারার বন্দ হাওর এবং বস্তিপুর হাওর বাঁধ একটির সঙ্গে আরেকটি যুক্ত হওয়ায় এর যেকোনো একটি বাঁধ ভেঙে গেলে ৩টি হাওরই তলিয়ে যাবে বলে কৃষকেরা জানিয়েছেন।

পাশ্ববর্তী বিলমাকসার বাঁধটি রক্ষার জন্য হালালপুর ও কাকুরিয়া গ্রামের ৫ শতাধিক নারী পুরুষ মাথায় মাটির বোঝা বয়ে বাঁধ রক্ষা করার জন্য প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। নদীর পানি বাড়তে থাকায় ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রামের এখন প্রায় সবক’টি ফসল রক্ষা বাঁধই ঝূঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। দিন-রাত মাটি কেটে বাঁধে ফেলে একমাত্র ফসল রক্ষার শেষ চেষ্টা করছেন কৃষকেরা।

বিজয় বাঁধ এলাকার কৃষক হাবিবুর রহমান জানান, এই হাওরে তার ১৯ একর জমি রয়েছে। এবার ধান পাকার আগেই জমি তলিয়ে গেছে। ফলে এক ছটাক ধানও ঘরে তুলতে পারবেন না।

কৃষক সোলাইমান ঠাকুর জানান, ধারদেনা করে অনেক কষ্টে দুই একর জমিতে বোরো আবাদ করেছিলেন। কিন্তু পানিতে পুরো হাওরই তলিয়ে গেছে।

কৃষক হামিদ মিয়া জানান, ধান সবে রঙ ধরেছে। এর মাঝেই তলিয়ে গেছে। এগুলো কেটে আনলে গরুকেও খাওয়ানো যাবে না।

ইটনা উপজেলা সদরের বড়হাটি গ্রামের মুক্তার মিয়া জানান, তিনি ৬০ একর জমিতে বোরো চাষ করেছেন। ফলনও ভালো হয়েছে। জমির আ’লে দাড়িয়ে চোখ জুড়িয়ে যেতো। কিন্তু সর্বনাশা বানের পানি তার সব আনন্দকে বিষাদে পরিণত করে দিয়েছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম উপজেলার তিনটি হাওরে মোট ৬৮ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে তিন উপজেলায় পনেরো হাজার হেক্টরের মতো জমি পানিতে তলিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

এ ব্যাপারে স্থানীয় (কিশোরগঞ্জ-৪) সংসদ সদস্য রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক জানান, ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে ফসলহানির ঘটনা ঘটছে না। যেসব হাওর তলিয়ে গেছে সেসবের বেশিরভাগই নদীর পাড় ডুবে পানি ঢুকেছে। নদীর নাব্যতা হারানোই এর অন্যতম কারণ।

তিনি এলাকায় অবস্থান করে ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপারে খোঁজখবর নিচ্ছেন বলেও জানান।