সুন্দরবনে মধু আহরণ শুরু ওষুধ তৈরিতে মধুর জুড়ি নেই

বিভিন্ন মৌসুমের মধ্যে সুন্দরবনের গুরুত্বপূর্র্ণ মৌসুম মধু আহরণ মৌসুম। সুন্দরবনে আনুষ্ঠানিকভাবে মধু আহরণ শুরু হয়েছে। সুন্দরবনের মধু ও মোম দেশের একটি অন্যতম অর্থকরী সম্পদ। বিভিন্ন প্রকার ওষুধ তৈরি ও ঔষধি খাবার হিসেবে মধুর জুড়ি মেলা ভার।
বিশ্ববিখ্যাত ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনে প্রাকৃতিভাবে সৃষ্টিকর্তা যে মধুর চাক দিয়েছেন তার গুনাগুন অনস্বীকার্য। তবে অনেক ক্ষেত্রে সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ মৌয়লরা সরকারি নিয়ম-নীতির কোনো তোয়াক্কা করছে না। মৌয়লরা মধু সংগ্রহের নিয়ম-নীতি উপেক্ষা করার কারণে মধু উৎপাদন হ্রাসসহ বিভিন্ন প্রজাতির মৌমাছির বংশ ধ্বংস হচ্ছে। সুন্দরবনে প্রতি বছর ১ এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত এ তিন মাস মৌয়ালদের মধু ও মোম সংগ্রহের অনুমতি দেয়া হয়। মৌসুমের শুরুতেই গতকাল রবিবার থেকে মৌয়ালরা পারমিট নিয়ে শত শত নৌকা যোগে দলবেঁধে মধু সংগ্রহের উদ্দেশ্যে সুন্দরবনে যাত্রা করেছে। মৌয়ালরা যাতে নিয়মনীতি মেনে মধু ও মোম সংগ্রহ করে সে লক্ষ্যে স¤প্রতি সন্দুরবন পশ্চিম বন বিভাগের উদ্যোগে বিভিন্ন সচেতনতামূলক কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়। টেকসই পদ্ধতিতে সুন্দরবন সম্পদ আহরণের মাধ্যমে শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ মৌয়াল সমবায় সমিতির মোট ৫০ জন মৌয়াল সদস্যকে সম্পৃক্ত করে ৩ দিনব্যাপী সুন্দরবন জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে এবং টেকসই পদ্ধতিতে সুন্দরবন সম্পদ সংগ্রহের মাধ্যমে জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রশিক্ষণ কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা সভায় সমবায় মধু সংগ্রহ করার বিভিন্ন পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করা হয়। বিভিন্ন দলীয় কাজের মাধ্যমে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ও গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা কি তা আলোচনা করা হয়। আলোচনা সভায় উপস্থিত মৌয়ালগণ সুন্দরবনের পরিবেশ ও প্রতিবেশ টিকিয়ে রেখে প্রয়োজনীয় সম্পদ আহরণ করায় সকলকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।
সূত্র মতে, স¤প্রতি বন বিভাগের সুন্দরবন সার্কেলের বন সংরক্ষক মো: জহির উদ্দিন আহম্মেদের নেতৃত্বে বুড়িগোয়ালিনীতে সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। তিনি যোগদানের পর এ খাতে রাজস্ব আদায় বাড়বে এবং সুন্দরবন সুরক্ষা থাকবে এমন আশাবাদ পরিবেশবাদীদের। মৌয়ালরা বন বিভাগের সতর্ক পাহারার কারণে অপেক্ষাকৃত নিরাপদে মধু সংগ্রহ করতে পারবে। তাছাড়া মৌয়ালরা আগের তুলনায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বেশি মধু সংগ্রহ করতে পারবে। সেমিনারে ডিএফ ও সকল মৌয়ালদের যাবতীয় দিক নির্দেশনা দেন। সিএফ জহির উদ্দিন ইনকিলাবকে বলেন, আমি আশা করি চলতি মৌসুমে মৌয়ালরা যথারীতি নিয়ম-কানুন মেনে এ সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার করবে। মৌমাছির প্রজনন যাতে বাধাগ্রস্ত না হয় এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে যেভাবে মধু আহরণ করলে পরিবেশ ও প্রতিবেশের কোনো ক্ষয়ক্ষতি না হয় সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সকলকে সম্যক জ্ঞান দান করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, মৌয়ালরা যাতে মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে অগ্নিকাÐের বা অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতি করতে না পারে সে বিষয়ে বিশেষ সচেতন করা হয়। আশা করছি চলতি মৌসুমে গত বছরের তুলনায় বেশি মধু সংগ্রহ করা যাবে। তাছাড়া এবার মৌয়ালদের কর্মকাÐের প্রতি বিশেষ নজরদারি করা হচ্ছে।
সূত্র মতে, ১০০০ টাকা মধু ও ৭৫০ টাকা মোমের প্রতি কুইন্টালে রাজস্ব নির্ধারণ করা হয়েছে। এ খাত থেকে গত বছর সাড়ে ১২ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় করা হয়েছে। এ বছর ১৫ লাখ টাকা রাজস্ব আদায়ে হবে বলে আশা করছে বনবিভাগ। এবার ৬ হাজার মণ মধু ও ১৫শ’ মণ মোম সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রতি বছর ১২ থেকে ১৫ হাজার মৌয়াল মধু সংগ্রহের জন্য সুন্দরবনে যায়। মৌয়ালরা জানায়, মধু সংগ্রহের জন্য তারা খড়কুটো একত্রিত করে “উকো বা বড়পা” প্রস্তুত করে তাতে আগুন ধরিয়ে জঙ্গলে ধোঁয়া ছেড়ে দিল মৌমাছি বের হয়ে মৌচাকের দিকে ধাবিত হয়। তখন তারা তাদের পিছু নিয়ে মৌচাকের সন্ধান পায়। মধু সংগ্রহের পূর্বে মৌয়ালরা আগুনের ধোঁয়া দিলে ঝাঁকে ঝাঁকে মৌমাছি চাক ছেড়ে উড়ে যায়। সুন্দরবনে লোকেরা তাকে ‘বৈলেন দেয়া’ বলে। মৌমাছি সরে গেলে চাক থেকে তারা মধু ও মোম সংগ্রহ করে। বন বিভাগের নিয়মানুযায়ী ধোঁয়ার কুÐলী দিয়ে মৌমাছি তাড়িয়ে মধু সংগ্রহের নিয়ম থাকলেও মৌয়ালরা এ নিয়মের কোনো তোয়াক্কা করে না। কম পরিশ্রমে অধিক লাভবান হওয়ার আশায় বন বিভাগের আইন উপেক্ষা করে মৌয়ালরা মৌচাকে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে হাজারো মৌমাছি পুড়ে যায়। যার কারনে মৌমাছির বংশবিস্তার বাধাগ্রস্ত ও মধু উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। পাশাপাশি মৌয়ালদের ধরানো আগুনে যে কোনো সময় বৃহৎ বনের অস্তিত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ হতে পারে। আর এ কারণেই মাঝে-মধ্যে সুন্দরবনে অগ্নিকাÐের ঘটনা ঘটে। অন্যদিকে মৌয়ালরা পদে পদে বিপদ তথা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতি বছর ৪ থেকে ৫ হাজার মণ মধু সংগ্রহ করে। নিয়ম-নীতি উপেক্ষা তথা পরিকল্পিতভাবে মধু সংগৃহীতে না হওয়ায় মধু সংগ্রহের পরিমাণ হ্রাস পেয়ে অর্ধেকে নেমে এসেছে। গত এক দশকে মধু আহরণ গড়ে আড়াই হাজার মণ। কিন্তু নব্বই দশকে মধু আহরণ হয়েছিল গড়ে ৪ হাজার ৪শ’ ৪৫ মণ। ওই সময় মোম আহরণ হয়েছিল ১ হাজার ১শ’ ৩৫ মণ। তবে এ বছর বিভিন্ন গাছে ফুল ফোটার পরিমাণ অনেক বেশি। সে কারণে মৌচাক বৃদ্ধিসহ এ বছর মধু সংগ্রহের পরিমাণও বাড়তে পারে।
অপরদিকে পূর্ব বনবিভাগের ডিএফও ইনকিলাবকে বলেন, আমার ডিভিশনে অপেক্ষাকৃত মধু কম । আনুষ্ঠানিকভাবে গত শনিবার থেকে মধু সংগ্রহ শুরু হলেও আরও কয়েক দিন লাগবে বাস্তবে শুরু হতে। তবে পারমিট সংগ্রহের সময় আমরা মৌয়ালদের প্রয়োজনীয় মোটিভেশন দিয়ে দিব। তাছাড়া এবার মধু আহরণকালে বিশেষ তদারকি করা হবে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর