‘পাখিদের ভয় দেখাবেন না, ওরাও বাঁচতে চায়’, ‘প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় পাখি, সৌন্দর্যের প্রতীক পাখি’- পাখি সংরক্ষণের এমন নানা সাইনবোর্ডের দেখা মিলবে নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার হাসানপুর গ্রামে।
গ্রামে ঢুকলেই কানে ভেসে আসবে নানা প্রজাতির পাখির মধুর কলকাকলি। গ্রামের মানুষ পাখি মারেন না, কাউকে মারতেও দেন না। আর তাইতো পাখিগুলো অভয়াশ্রম হিসেবে বেছে নিয়েছে এই গ্রামকে।
ধীরে ধীরে এই গ্রাম পরিচিতি লাভ করেছে পাখি গ্রাম হিসেবে। শুধু তাই নয়; পাখিদের উড়ে চলা আর খুনসুটি দেখতে প্রতিদিনই আসছেন দর্শণার্থীরাও।
তবে এ গ্রামই শেষ কথা নয়; রাজশাহী বিভাগীয় বন্যপ্রানী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ জেলার বিভিন্ন স্থানে চিহ্নিত করেছে এমন আরও ১৭ টি পাখির অভয়াশ্রম।
প্রায় ৯০টি পরিবার নিয়ে গড়ে উঠা এই গ্রাম গাছগাছালিতে ভরা। গ্রামের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে একটি পুকুর। পুকুরপাড়সহ প্রায় চার বিঘা জমিতে প্রকৃতিকভাবে বেড়ে উঠা গাছে বিচরণ করছে নানা প্রজাতির পাখি। বিশেষ করে বিভিন্ন প্রজাতির বক, পানকৌড়ি, বালিহাঁস, শামুক খৈল, রাতচরা, ডাহুক, ঘুঘু,শালিক, বাবুই চোখে পড়ে হরহামেশায়।
এলাকায় শেয়াল, বনবিড়ালের মত বন্যপ্রাণীও দেখা যায়। আবার পুকুরের একপাশে পাখির উড়েচলা দেখতে তৈরি করা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন বসার স্থান। দূর দূরান্ত থেকে আসা দর্শণার্থীরা সেখানে বসে পাখি দেখে। অনেকেই স্মৃতি ধরে রাখতে নিজ ক্যামেরায় তুলছেন ছবি।
পাখির এই অভয়াশ্রম গড়ে উঠেছে গ্রামবাসীর নিজ উদ্যোগেই। তারা এসব পাখি নিজেরাও যেমন শিকার করেন না, তেমনি অন্যদেরও নিরুৎসাহিত করে আসছেন দিনের পর দিন।
এ বিষয়ে কথা হয় ওই অভয়াশ্রম গড়ে তোলার প্রধান উদ্যোক্তা ও হাসানপুর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ইউনুছার রহমান হেফজুলের সঙ্গে। জানান, ২০০৬ সালে তিনিসহ গ্রামের বেশ কয়েকজন যুবক এলাকাটিকে পাখির জন্য নিরাপদ হিসেবে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন। ওই গ্রামের সোনালী সংসদ নামে সংগঠনের মাধ্যমে গ্রামের যুবকরা নিজ গ্রামসহ আসে-পাশের গ্রামের মানুষদের সচেতন করতে শুরু করেন মাইকিং। গ্রামের প্রতিটি প্রবেশ পথে স্থাপন করা হয় সাইনবোর্ড।
পাশাপাশি গ্রামের ভেতরে গাছ কাটা ও উচ্চশব্দে আওয়াজ করা নিষিদ্ধ করা হয়। আর গ্রামের কেন্দ্রে থাকা পুকুরটিতে মাছ শিকার বন্ধ করে দেওয়া হয়।
হেফজুল বলেন, শুরুর দিকে এ ধরনের কাজ করতে অনেকটাই বেগ পেতে হয়েছে। তারপরও প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও জীববৈচিত্র রক্ষায় এই কাজ করেছেন তারা।
পাখি শিকারের দায়ে তিন জনকে আটক করে ভ্রাম্যমাণ আদালতে সোর্পদও করেছে গ্রামবাসী। তাদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজাও দেয় আদালত। আবার প্রায় ১৫ জন আটক করে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয় বলে জানান হিফজুল।
বর্তমানে জীব বৈচিত্র্য বন, বণ্যপ্রাণী ও নদী সংরক্ষণ কমিটি (জীবন) নামে সংগঠন ওই গ্রামের পাখি রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে।
এলাকাবাসীর তথ্য মতে জানান, গ্রামজুড়ে প্রায় ৩০ প্রজাতির পাখি রয়েছে। এদের জন্য আলাদাভাবে কোন খাবারের যোগান দিতে হয় না। আশেপাশের জলাশয়, পুকুরের মাছ ও জলজ প্রাণী এবং গাছের ফল খেয়েই পাখিগুলো জীবন ধারণ করে। পাখিগুলো পাশের গ্রামের পুকুরেও খাবার সংগ্রহ করতে যায়। আর পুকুরগুলোতে কারেন্ট জাল ফেলে রাখায় বেশ কিছু পাখি মারা পড়ছে।
গ্রামের গৃহবধূ জাহানারা বেগম বলেন, ‘আগে এই গ্রামে তেমন কেউ আসত না। কিন্তু এখন পাখির এই অভয়াশ্রম দেখতে শুধু জেলারই নয়; দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নানা বয়সী মানুষ ছুটে আসেন।’
জেলা সদর থেকে স্ব-পরিবারে পাখি দেখতে আসা কলেজ শিক্ষক আহাদ আলী বলেন, ‘এক বন্ধুর কাছ থেকে এই অভয়াশ্রমের কথা জানতে পেরে এখানে ছুটে এসেছি। এখানে এসে মনে হচ্ছে এটা বুঝি পাখিদেরই গ্রাম।’
জেলায় পাখিদের এ ধরনের আরও ১৭টি অভয়াশ্রম চিহিৃত করেছে রাজশাহী বিভাগীয় বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ। এসব স্পটগুলো হচ্ছে নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার আলিদেওয়ানা গ্রাম, হাসানপুর গ্রাম, জোয়ানপুর, রাইগাঁ, পত্নীতলা উপজেলার চানপুকুর, কদমকুড়ি, মান্দার দক্ষিণ মৈনম, গবিন্দপুর, উতরাইল মানিক বিল, বিনোদপুর সদর উপজেলার বাগবাড়ি, বোয়ালিয়ার হাতিপোতা, গহেরপুরের এন্ট্রিতলা, রানীগরের গোনা, আত্রাই উপজেলার বান্দাইখাড়ার ধনপাড়া ও পোরশার বড়গ্রাম-সোমনগর।
গত প্রায় ৩০ বছর ধরে এসব পাখি নিয়ে গবেষণা করছেন মহাদেবপুর উপজেলা কুঞ্জুবন গ্রামের মনসুর সরকার। তিনি নিজ উদ্যোগে গড়ে তুলেছেন ‘বিচিত্র পাখি উৎপাদন বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান’ নামে একটি খামারও। তার মতে, এসব অভয়াশ্রম ঘিরে গড়ে তুলতে হবে হরেক রকম বন ও ফলজ বাগান। যাতে করে পাখিগুলো কখনও খাবারের অভাববোধ না করে। এসব এলাকাকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবেও গড়ে তোলা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।
এ বিষয়ে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ ও রাজশাহী বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবুল কালাম বলেন, নওগাঁর পাখিদের অভয়াশ্রমের স্পটগুলোতে পর্যায়ক্রমে উন্নয়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। যারা ব্যক্তি উদ্যোগে এসব কাজ করছেন, তাদেরকে সহযোগিতা দেয়ার পাশাপাশি তাদেরকে স্বীকৃতি দেয়ার চেষ্টাও করা হচ্ছে।