নারী ও পুরুষের মধ্যে সমতা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান উপরে। ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম প্রকাশিত বৈশ্বিক লিঙ্গ বিভাজন সূচক (গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ ইনডেক্স) প্রতিবেদন ২০১৬ অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থান ৭২তম। ১৪৪টি দেশের তথ্য নিয়ে এই তালিকা করা হয়েছে। এই তালিকায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পরবর্তী অবস্থানে রয়েছে প্রতিবেশী দেশ ভারত। দেশটির অবস্থান ৮৭তম। এরপর রয়েছে শ্রীলংকা (১০০), নেপাল (১১০), মালদ্বীপ (১১৫), ভূটান (১২১) ও পাকিস্তান (১৪৩)।
প্রতিবেদনটিতে বিভিন্ন সূচক ধরে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এতে বাংলাদেশ সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে। এই সূচকে আমাদের অবস্থান সপ্তম। এছাড়া ‘অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি এবং সুযোগ’ শীর্ষক সূচকে বাংলাদেশকে দেখানো হয়েছে ১৩৫তম অবস্থানে। নারী পুরুষের শিক্ষার সুযোগের সূচকে বাংলাদেশ রয়েছে ১৪৪তম অবস্থানে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ ও ভারতে তুলনামূলক লিঙ্গ বৈষম্য কম। এ অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি বৈষম্য ভূটান ও পাকিস্তানে। তালিকায় থাকা সবচেয়ে নীচের দিক থেকে পাকিস্তানের অবস্থান দ্বিতীয়। এরপরের অর্থাত্ সর্বশেষ অবস্থানে রয়েছে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ ইয়েমেন।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বিগত কয়েক দশকে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ নারীর ক্ষমতায়নে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। দেশটির উন্নতির ক্ষেত্রে মূলত রাজনীতিতে নারীর বড় অংশগ্রহণ, কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। সেইসাথে প্রাথমিক শিক্ষায় মেয়ে শিশুর অংশগ্রহণও বেড়েছে।
কর্মক্ষেত্রে নারী: বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য মতে, বর্তমানে প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ে ৭ দশমিক ৬ শতাংশ নারী আছেন। তবে উপসচিব থেকে সচিব পর্যায়ে নারীর সংখ্যা এক শতাংশ বা তারও কম। দেশে সরকারি ও আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানে অনুমোদিত পদের সংখ্যা ১০ লাখ ৯৬ হাজার ৩৩৪টি। এর মধ্যে নারীর সংখ্যা ৮৩ হাজার ১৩৩জন। ১৯৭৪ সালে কর্মক্ষেত্রে নারী ছিল ৪ শতাংশ, এখন তা ৩৩ শতাংশ হয়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উর্ধ্বতন নিয়োগ-বদলি) শেখ ইউসুফ হারুন জানান, সচিবালয়ে ৬ জন নারী পূর্ণাঙ্গ সচিবের দায়িত্ব পালন করছেন। সচিব পদমর্যাদায় আছেন আরও ২ জন। অল্প সময়ের মধ্যে সচিব মর্যাদা পাওয়ার অবস্থায় আছেন আরও বেশ কয়েকজন।
অর্থনীতিতে দিন দিন নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। বিবিএস-এর সর্বশেষ (২০১৬) জরিপ মতে, দেশে ৫ কোটি ৩১ লাখ কর্মজীবীর মধ্যে ১ কোটি ৬২ লাখ নারী। প্রবাসে বিভিন্ন পেশায় কর্মরত ৭৬ লাখ প্রবাসীর মধ্যে মাত্র ৮২ হাজার ৫৫৮জন নারী। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম খাত পোশাক শিল্পে ৫ হাজারেরও অধিক কারখানায় ১৫ লাখ শ্রমিক কর্মরত। যার ৮৫ শতাংশ নারী। তবে এই পোশাক শ্রমিকরা কর্মক্ষেত্র, রাস্তায় বিভিন্ন ধরনের হয়রানির শিকার হন। সঙ্গে আছে কর্মক্ষেত্রে অগ্নিকান্ডের ঝুঁকি।
জাতীয় শ্রমশক্তি জরিপ মতে, দেশে নারী শ্রমিকের সংখ্যা সাড়ে ৮ লাখ, তবে সবাই মজুরি বৈষ্যমের শিকার। গ্রামাঞ্চলে পুরুষ শ্রমিক দৈনিক মজুরি ১৮৪ টাকা পেলে, নারী শ্রমিক পান ১৭০ টাকা। ইউএনএফপিএ’র ২০১৬ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, নারীরা পুরুষের তুলনায় বেশি শহরে কাজে আসছে। ঢাকা শহরে এই হার ১০০জন পুরুষের বিপরীতে ১৬৭জন, সেখানে চট্টগ্রামে এই হার ১৬৬ জন।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯১ সালে ১৭৯ জন নারী শ্রমিক বিদেশে পাঠানোর মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল। ২০১৬ সালের ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত জনশক্তি রপ্তানিতে গত আট বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এ পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে নারী শ্রমিক গেছেন ৭ লাখ ৪৯ হাজার ২৪৯ জন । তবে এসব দেশ থেকে ফেরত আসা শ্রমিকরা দূতাবাসের অসহযোগিতাসহ নানা অভিযোগ করেছেন।
বিশেষজ্ঞরা যা বলেন: রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক রওনক জাহান বলেছেন, গতানুগতিকতার বাইরে এসে নারীরা কাজ করছে। তবে তাদের উচ্চ পর্যায়ে না যাওয়ার প্রধান কারণ পুরুষরা শুরু থেকে কাজ করছেন। তিনি বলেন, নারীরা বিভিন্ন র্যাঙ্কে কাজ করুক -এটা শুধু চাইলেই হবে না এজন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অনেক দেশে আছে, যে সেক্টরে নারী ভাল করছে সে সেক্টর থেকে দক্ষ নারী এনে অন্য সেক্টরে ভারসাম্য তৈরি করা হয়। আমাদের দেশে শিক্ষা ক্ষেত্রে নারীরা ভাল করছে, শিক্ষা ক্ষেত্র থেকে প্রতি বছরই কিছু নারীকে প্রশাসনের যে সকল জায়গায় নারী নেই সেখানে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডির) এর রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম বলেন, মূল বিষয় হল কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। কৃষি ও অকৃষিখাতে নারীরা প্রবেশ করছেন। তবে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নারীরা পূর্ণ ঘন্টা নিয়োজিত নয়। কর্মক্ষেত্রে ১৫ বছরের বেশি বয়সে ৮৩ শতাংশ পুরুষ কাজ করে। একই বয়সের নারীর সংখ্যা মাত্র ৩৩ শতাংশ। যা আমাদের বড় দুর্বলতা। তাছাড়া নারীর বেকারত্বের হার বেশি।
এ প্রসঙ্গে মহিলা ও শিশু বিষয়ক সচিব নাসিমা বেগম ইত্তেফাককে বলেন, পুরুষের মতোই তাদের (নারীদের) দায়িত্ব পালন করতে হয়। নারী সচিব বিষয় নয়, বিষয় হল নারী কাজে কতটা নিজেকে প্রমাণ করতে পারল। আর সেই কাজের সুযোগটাই তৈরি করা জরুরি।