এসএসসির প্রশ্ন ফাঁস

ভয়ানক ব্যাধি প্রশ্নফাঁস বন্ধ হয়নি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় নানা তদারকি করেও ব্যর্থ হয়েছে প্রশ্নফাঁস বন্ধ করতে। এসএসসি পরীক্ষায় এবারও প্রশ্নফাঁসের প্রমাণ মিলেছে। পরীক্ষা শুরুর ২৪ ঘণ্টা আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশ্ন পেয়ে গেছে অনেক পরীক্ষার্থী। পরীক্ষা শেষে অনেক ছাত্রছাত্রীই এ প্রতিবেদককে এসব তথ্য জানিয়েছে। যদিও শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিলেন, প্রশ্ন ফাঁসের কোনো সুযোগ নেই। গতকাল রবিবার এসএসসিতে বাংলা দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষা নির্ধারিত ছিল। তবে পরীক্ষা শুরুর অনেক আগেই ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ম্যাসেঞ্জারসহ নানান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফাঁস হয়ে যায় প্রশ্ন। অনেকে রাতেই ফেসবুকে পোস্ট করেছেন প্রশ্নপত্রের মূল কপি। বাংলাদেশ প্রতিদিন প্রতিবেদকের কাছেও ফাঁস হওয়া প্রশ্নের প্রমাণ রয়েছে। পরীক্ষা শুরুর আগেই পাওয়া স্ক্রিনশর্ট সংরক্ষণ করা হয়েছে। পরীক্ষার পর দেখা গেছে ফাঁস হওয়া প্রশ্নের সঙ্গে হুবহু মিলে গেছে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের প্রশ্ন। এ ছাড়া দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ড ও রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের প্রশ্নও পরীক্ষার আগের রাতেই ফাঁস হয়ে গেছে বলে অনেকেই এ প্রতিবেদককে ফোন করে অভিযোগ করেছেন। অনেকেই বলেন, পরীক্ষার একদিন আগে তাদের মোবাইলে পৌঁছে গেছে প্রশ্নপত্র। গতকাল ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের ‘খ সেট’ (তেঁতুল)-এর এক নম্বর প্রশ্নে ‘বাংলা নববর্ষ, পরিবেশ দূষণ’ এই দুই বিষয়ের যে কোনো একটি নিয়ে অনুচ্ছেদ লিখতে বলা হয়েছে। চার নং প্রশ্নে ভাবসম্প্রসারণ লিখতে বলা হয়েছে, ‘কীর্তিমানের মৃত্যু নেই ও শৈবাল দিঘিরে বলে… … … দিলেম শিশির’ এর যে কোনো একটি নিয়ে। ছয় নম্বর প্রশ্নে ‘অধ্যবসায়, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও মানবকল্যাণে বিজ্ঞান’ এর যে কোনো একটি বিষয়ে রচনা লিখতে বলা হয়েছে। গতকাল সকাল ১০টায় এ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। দেখা গেছে ফাঁস হওয়া প্রশ্নের সঙ্গে পরীক্ষার প্রশ্নের হুবহু মিল রয়েছে। প্রতিটি দাড়ি, কমা, সেমিকোলনও মিল পাওয়া গেছে। এমনকি বহুনির্বাচনী (এমসিকিউ) প্রশ্নও ফাঁস হয়ে গেছে একদিন আগেই। সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমে এমসিকিউ প্রশ্নও পৌঁছে যায় ছাত্রছাত্রীদের মোবাইলে মোবাইলে। ফলে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন পেয়ে অনেক ছাত্রছাত্রীই পরীক্ষা দিয়েছে ‘স্বাচ্ছন্দ্যে, তৃপ্তি সহকারেই’। তারা এমসিকিউএ নির্ধারিত ত্রিশ নম্বরের ত্রিশ নম্বরই উত্তর করেছেন ফাঁস হওয়া প্রশ্ন দেখে। নাম প্রকাশ না করে রাজধানীর একটি স্কুলের ছাত্রী এ প্রতিবেদককে জানায়, হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে পরীক্ষার ছয় ঘণ্টা আগেই সে লিখিত ও এমসিকিউ প্রশ্ন পেয়ে যায়। ফাঁস হওয়া প্রশ্নে অনেকেই পরীক্ষা দিয়েছে উল্লেখ করে অনেক মেধাবী পরীক্ষার্থী ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের এক ছাত্রী জানায়, পরীক্ষা দেওয়ার পর জানতে পেরেছি যে বিভিন্ন স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষার আগেই প্রশ্ন পেয়েছে। পরীক্ষাতে নাকি হুবহু মিলে গেছে সেই প্রশ্ন। আক্ষেপ করে সেই ছাত্রী জানায়, তাহলে আর কষ্ট করে পড়ালেখা করলাম কেন আমরা? কীভাবে তাহলে মেধাবীদের সঠিক মূল্যায়ন হবে? এ ব্যাপারে জানতে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় সাব কমিটির সভাপতি অধ্যাপক মো. মাহাবুবর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পাওয়া প্রশ্ন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গুজব, মিথ্যা প্রমাণিত হয়। তবে ‘পরীক্ষার আগে পাওয়া প্রশ্নের সঙ্গে পরীক্ষার প্রশ্ন হুবহু মিলে গেছে, প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে’ শিক্ষার্থীদের এমন অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। শিক্ষাবিদরা বলছেন, যে কোনো মূল্যে পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ করতে হবে। ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে জিপিএ পাঁচ পাওয়া এই ‘মেধাবীরা’ই জাতির মেরুদণ্ডে আঘাত করবে একদিন। জামালপুর জেলার একটি স্কুলের শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করে জানায়, তাদের স্কুলের বেশিরভাগ পরীক্ষার্থী ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়েছে। রংপুর জেলার এক স্কুলের এসএসসি পরীক্ষার্থী জানায়, মাত্র ৫০০ টাকায় পরীক্ষা শুরুর পাঁচ ঘণ্টা আগে পাওয়া গেছে দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের প্রশ্ন। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এর আগে একটি গবেষণাপত্রের মাধ্যমে প্রশ্ন ফাঁসের প্রক্রিয়া চিহ্নিত করে সংবাদ সম্মেলন করেছিলাম, যদিও শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রশ্নফাঁসের বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করেছিল। এ পরীক্ষায় যদি প্রশ্নফাঁসের প্রমাণ মেলে তবে আমরা বলতেই পারি যে প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে। তিনি বলেন, আমি মনে করি শিক্ষা মন্ত্রণালয় যদি সত্যিই প্রশ্ন ফাঁস বন্ধ করতে চায় তবে সেটি সম্ভব। এক্ষেত্রে দোষীদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনার বিকল্প নেই।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর