খুলনা থেকে প্রকাশিত দৈনিক জন্মভূমির সম্পাদক ও প্রকাশক হুমায়ুন কবির বালু হত্যাকাণ্ডের একাদশতম বার্ষিকী আজ শনিবার। দুর্বল তদন্তের কারণে ইতিমধ্যে এই হত্যা মামলার আসামিরা বেকসুর খালাস পেয়েছেন। এ ঘটনায় দায়ের করা বিস্ফোরক মামলার অধিকতর তদন্ত এত দিনেও শেষ হয়নি। পরিবারের অভিযোগ, দীর্ঘসূত্রতার কারণে বিস্ফোরক মামলার তদন্তও দুর্বল হচ্ছে। এর ফলে প্রকৃত খুনিরা পার পেয়ে যেতে পারে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সাংবাদিক বালু ২০০৪ সালের ২৭ জুন নিজ পত্রিকা অফিস তথা বাসার সামনে সন্ত্রাসীদের বোমার আঘাতে খুন হন। সেই সঙ্গে আহত হন বালুর ছেলে আসিফ কবীর। পরিবারের পক্ষ থেকে এ ঘটনায় কোনো মামলা দায়ের করা হয়নি। খুলনা থানার সেই সময়ের উপপরিদর্শক (এসআই) মারুফ আহমেদ বাদী হয়ে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনের পৃথক ধারায় দুটি মামলা দায়ের করেন। যথারীতি পুলিশ মামলাটির তদন্ত করে অভিযোগপত্র জমা দেয়। প্রায় চার বছর ধরে হত্যা মামলার বিচার চলার পর ২০০৮ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি রায় ঘোষণা করা হয়। রায়ে সাত আসামি বেকসুর খালাস পান।
বিচারে কোনো আসামির বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত না হওয়া এবং কেউ সাজা না পাওয়ার ঘটনায় পরিবারের পক্ষ থেকে গভীর হতাশা ও ক্ষোভ ব্যক্ত করা হয়। বালুর ছেলে আসিফ কবীর প্রধানত দুর্বল তদন্তকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, ‘তদন্তকাজ সঠিক পথে না এগোনোর কারণে হত্যাকারী ও নেপথ্যের ব্যক্তিরা পার পেয়ে গেছে।’
বিচারে কোনো আসামিকে দণ্ড দিতে না পেরে আদালত নিজেই উদ্বেগ প্রকাশ করেন। আদালত তাঁর পর্যবেক্ষণে বলেন, ‘তদন্তে যেসব বিষয় গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল এবং যাদের জিজ্ঞাসাবাদ বা সাক্ষী করা প্রয়োজন ছিল; তা করা হয়নি।’ তদন্তের দুর্বলতা প্রসঙ্গে আদালত আরো বলেন, ‘তদন্ত কর্মকর্তারা দুর্ঘটনাস্থলের মানচিত্র এঁকেছেন, কিন্তু আশপাশস্থলের কাউকে সাক্ষী করেননি, এমনকি তাদের জিজ্ঞাসাবাদও করেননি। এ ছাড়া আসামিদের পূর্বপরিকল্পনা বা ষড়যন্ত্রের বিষয়টি প্রমাণিত না হওয়ায় প্রসিকিউশন গুরুতর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’ আদালতের ধারণা, ‘ঘটনাস্থলের আশপাশের লোক সাক্ষ্য প্রদান করলে হয়তো প্রকৃত তথ্য পাওয়া যেত।’ রায়ে বিচারক বলেন, ‘যাই হোক, এই মামলার সব দিক পর্যালোচনা করে আমি কোনো গুরুত্বপূর্ণ সারকামসটেনশিয়াল এভিডেন্স (জোরালো সাক্ষ্যপ্রমাণ) পাই নাই; যাতে অকাট্যভাবে আসামিদের অভিযোগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হয়।’
এর পরিপ্রেক্ষিতে মামলাটির অধিকতর তদন্তের দাবি ওঠায় ২০০৯ সালের ২০ এপ্রিল রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী এনামুল হক হত্যা মামলার দুর্বল দিকগুলো উল্লেখ করে বিস্ফোরক মামলাটি আরো তদন্তের জন্য আদালতে আবেদন জানান। আইনজীবী আবেদনে বলেন, ‘চাঞ্চল্যকর বালু হত্যা মামলার সব আসামি খালাস পেয়েছেন। ন্যায়বিচারের স্বার্থে বিস্ফোরক মামলাটি অধিকতর তদন্ত প্রয়োজন।’ ওই বছর ১০ মে আদালত আবেদনটি বিবেচনায় নিয়ে মামলাটির অধিকতর তদন্তের জন্য আদেশ দেন। এই তদন্ত গত ছয় বছরেও শেষ হয়নি। বর্তমানে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) মামলাটি তদন্ত করছে।
বিস্ফোরক মামলার তদন্তে দীর্ঘসূত্রতার বিষয়ে বালুর পরিবারের পক্ষ থেকে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে। হুমাযূন কবির বালুর ছোট ভাই এস এম জাহিদ হোসেন বলেন, ‘সাংবাদিক বালু সন্ত্রাসীদের বোমার আঘাতে নিহত হয়েছেন, এই সত্যি ঘটনাটির সঙ্গে কে বা কারা যুক্ত থাকতে পারে তা খুঁজে দেখার দায়িত্ব পুলিশের। পুলিশই হত্যাকাণ্ডটির সাক্ষ্য-প্রমাণাদি জোগাড় করবে। উপযুক্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ আদালতে উপস্থাপিত হলেই বিচারে অপরাধী শাস্তি পাবে। দুর্বল তদন্ত ও দীর্ঘসূত্রতায় প্রকৃত খুনি, গডফাদার, অর্থ জোগানদাতারা পার পেয়ে যেতে পারে।’
এ বিষয়ে খুলনা ওয়ার্কিং জার্নালিস্ট ইউনিটির যুগ্ম আহ্বায়ক কাজী মোতাহার রহমান বলেন, ‘হত্যা মামলার রায়ে বিচারক তদন্তকাজে দুর্বলতার কথা স্পষ্ট করে বলেছেন। ফলে আমরা চাই এবারের তদন্তে ওই দুর্বলতাগুলো দূরীভূত হোক।’ তিনি মনে করেন, ‘তদন্তের ওপরই বিচারকাজ নির্ভর করে। অপরাধী চিহ্নিত ও সাজা পাওয়ার বিষয়টিও তদন্ত ও প্রসিকিউশনের ওপর নির্ভরশীল।’
তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘অধিকতর তদন্তে নতুন কিছু আলামত পেয়েছি। এর ভিত্তিতে হত্যা মামলাটি পুনরুর্জীবিত করা সম্ভব। খুব শিগগির অভিযোগপত্র জমা দেব।’