চট্টগ্রাম বিএনপির পালে নোমানের নতুন হাওয়া

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক মন্ত্রী আবদুল্লাহ আল নোমান অনেকটা ঝিমিয়ে ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করেই তিনি হয়ে উঠেছেন সক্রিয়। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে এসে যোগ দিচ্ছেন রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে। দিচ্ছেন কর্মীদের অনুপ্রেরণা। সব বিভেদ ভুলে চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপিকে সংগঠিত করাই এখন নেতা-কর্মীদের প্রধান কাজ বলে তার বক্তৃতায় দৃঢ়ভাবে এমন মনোভাব ব্যক্ত করছেন। হঠাৎ তার এই সরব উপস্থিতি দলের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরিয়ে এনেছে। রাজনীতি বিশ্লেষকেরা এটাকে শুভকর বলেই মনে করছেন।

আবদুল্লাহ আল নোমানের অতীত রাজনৈতিক পটভূমি বিশ্লেষণ করে তার সমর্থকদের এটাই অভিমত। তিনি বিএনপির হাল ধরে আছেন দীর্ঘদিন ধরে। তার সাংগঠনিক দক্ষতা প্রশ্নাতীত। রাজনীতিতে তার ভাবমূর্তিও স্বচ্ছ। আন্দোলনে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগও নেই তেমন।

সূত্রে জানা যায়, নোমান বামধারার ছাত্ররাজনীতি করে কারাভোগ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন। স্বাধীনতার পর মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সঙ্গে রাজনীতি করেছেন তিনি। ১৯৭২ সালের ৯ই ডিসেম্বর তার বিয়ের পরদিন ছিল ন্যাপের প্রথম কংগ্রেস। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেই তিনি চট্টগ্রাম থেকে ছুটে গিয়েছিলেন টাঙ্গাইলের সন্তোষে। সে কংগ্রেসে তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন সাংগঠনিক সম্পাদক। ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও বর্তমান বেসরকারি বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন সে কমিটির প্রচার সম্পাদক ও বিএনপি থেকে বহিষ্কার হওয়া মহাসচিব প্রয়াত আবদুল মান্নান ভূঁইয়া সে কমিটির কৃষি সম্পাদক ছিলেন। জিয়াউর রহমানের সময়ে বিএনপিতে যোগ দেয়ার পর তিনিই মনোনীত করেছিলেন শ্রমিক দলের সহ-সভাপতি।

তারপর নানা উত্থান-পতনেও তিনি এ দল ছেড়ে যাননি। স্বৈরাচারী এরশাদ আমলে কারাভোগ করেছেন। দলের টালমাটাল অবস্থায় খালেদা জিয়াকে ছেড়ে যাননি। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে দলের যে ক’জন সিনিয়র নেতা নিরবচ্ছিন্নভাবে বিএনপির রাজনীতি করে গেছেন তাদের অন্যতম আবদুল্লাহ আল নোমান। দলের সাংগঠনিক সম্পাদক, যুগ্ম মহাসচিব, শ্রমিক দলের সভাপতি, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন পর্যায়ক্রমে।

কিন্তু গত বছর বিএনপির জাতীয় সম্মেলনে দলের ভাইস চেয়ারম্যান পদ পাওয়া নোমান এবার আরো পদোন্নতির আশায় ছিলেন। তিনি দলের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটিতে আসছেন- এমন খবর চা্উর হয়েছিল আগেই। কিন্তু কমিটি ঘোষণার পর যারপরনাই হতাশ হয়ে পড়েন এ নেতা। নতুন কমিটিতে স্থায়ী কমিটিতে স্থান পান আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। রাজনীতিতে তার তুলনায় জ্যেষ্ঠ নোমান। তাকে ডিঙিয়ে স্থায়ী কমিটিতে আমীর খসরুর অন্তর্ভুক্তিতে তিনি ভেঙে পড়েন। নোমারের অনুসারীরাও হয়ে পড়েন হতাশ, ক্ষুব্ধ।

নোমানের অনুসারীদের তখন বলতে শোনা যায়, ত্যাগী নেতা আব্দুল্লাহ্ আল নোমানের সঠিক মূল্যায়ন হয়নি। তিনি দীর্ঘ ৩৭ বছর ধরে বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় আছেন। দলের আন্দোলন সংগ্রামে নিয়োজিত ছিলেন। বেশ কয়েকবার জেলও খেটেছেন। জাতীয় সম্মেলনেও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছিলেন। কিন্তু দল তার ত্যাগের যথাযথ মূল্যায়ন করেননি।
এ ঘটনার পরপরই অনেকটা চুপচাপ হয়ে পড়েন আবদুল্লাহ আল নোমান। বেশির ভাগ সময় ঢাকায় ধানমন্ডির নতুন বাসায় সময় কাটাতেন। তখন তিনি তার হঠাৎ নীরবতার কারণ গণমাধ্যমের কাছে ব্যাখাও করেছিলেন। তখন তার ভাষ্য ছিলো এটাই, রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বেশি সময় দেওয়ার কারণে শরীরটা হঠাৎ একটু খারাপ করেছে। অন্য কিছু নয়।

এই বিষয়ে নোমান তখন আরো বলেছিলেন, স্থায়ী কমিটির বিষয়টি নিয়ে আর কিছু বলতে চান না। অনেকদিন তো রাজনীতি করেছি। মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। একাধিকবার বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছি। খালেদা জিয়ার সঙ্গে ছিলাম। তার সঙ্গেই আছি।

তখন তিনি আরও বলেন, তবে স্থায়ী কমিটি নিয়ে মন একটু খারাপ সত্যি। ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে শুধু রাজনীতি করেছি। অন্যকিছু করিনি। এগুলো নিয়ে এখন আর কিছু বলতে চাই না। যারা করেছেন তারা কিভাবে করেছেন উনারাই ভালো জানেন। বিএনপির জন্য সব তো দিলাম।

এদিকে কমিটি ঘোষণার পর থেকে তার পদত্যাগ নিয়ে তৈরি হওয়া গুঞ্জনের ব্যাপারে আবদুল্লাহ আল নোমান বলেছিলেন, বিএনপিই আমার শেষ ঠিকানা।

তবে তখন একথাও শোনা গেছে, কাগজে-কলমে নোমানের স্থায়ী কমিটিতে অন্তর্ভুক্তির সুযোগ এখনো শেষ হয়ে যায়নি। কারণ ১৯ সদস্যের এই কমিটিতে এখনও দুটি পদ খালি আছে। তবে বর্তমানে নোমানের রাজনীতিতে সরব উপস্থিতিতে দলের নেতা-কর্মীরা বলছেন, নোমানের রাজনীতির নাওয়ে নতুন পাল তুলে তিনি আবার ফিরে এসেছেন। যোগ দিচ্ছেন সভা-সমাবেশে।

গত ৫ জানুয়ারি গণতন্ত্র হত্যা ও কালো দিবস পালন করেছে চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপি ও তার অঙ্গসংগঠন। এ উপলক্ষে আলোচনাসভা ও কালো পতাকা মিছিলের আয়োজন করে সংগঠনটি। একই দিন বিকালে নগরীর কাজীর দেউরির নাছিমন ভবনে কার্যালয়ের মাঠে এক সমাবেশ ও আলোচনা সভায় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক মন্ত্রী আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, আজ সেই কলঙ্কময় দিন, যেদিন নির্বাচন না হয়েই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় বসেছে। পার্লামেন্টের মাধ্যমে নির্বাচিত না হয়ে কাগজে-কলমে হয়েছে। আইনী প্রক্রিয়ায় হয়নি। তাই এ সংসদ ও সরকারকে মানা যায় না।

তিনি বর্তমান সরকারকে উদ্দেশ করে বলেন, যে আগুনে আপনি হাত দিয়েছেন, সেই আগুনে আপনার হাত পুড়ে যাবে। এটা শুধু সময়ের অপেক্ষা। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিলো গণতন্ত্রের লড়াই। সে লড়াইয়ে বিএনপি অংশ নিয়েছিলো।

তিনি আরো বলেন, বর্তমান সরকার রয়েছে অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে। অবিলম্বে নির্বাচন দিয়ে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা জরুরি। প্রয়োজনীয় আলোচনা করে সরকার গঠন করার কথা বলেন আবদুল্লাহ আল নোমান।

গত ১৫ জানুয়ারি ৩৯টি ওয়ার্ডের কমিটি ভেঙে দিয়ে সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি গঠন করে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে যে সম্মেলনের ঘোষণা চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপি দিয়েছিলো তা তার নেতৃত্বে তা আবার শুরু হয়। তিনি ঘোষণা দেন, পর্যায়ক্রমে সকল ওয়ার্ডের সম্মেলন সম্পন্ন করে চট্টগ্রামকে একটি রোল মডেল হিসেবে দাঁড় করানো হবে। মঞ্জুরুল আলম মঞ্জুকে সভাপতি ও এম এ হালিম বাবলুকে সাধারণ সম্পাদক করে ১৬ নম্বর চকবাজার ওয়ার্ড বিএনপির চার সদস্যের কমিটি ঘোষণা দেওয়া হয়। আনিসুজ্জামান সাইমুনকে সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক ও জসিম উদ্দিনকে সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আগামী এক সপ্তার মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করে নগর বিএনপি থেকে চূড়ান্ত অনুমোদন নেওয়ার জন্য চারজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

একই দিন সকালের সম্মেলন শেষে বিকালে নতুন কমিটি ঘোষণা করেন নগর বিএনপির সভাপতি ডা.শাহাদাত হোসেন। এ সময় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান, নগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশেম বক্কর উপস্থিত ছিলেন। এর আগে সকালে নগরীর চকবাজার এলাকায় কিশলয় কমিনিউটি সেন্টার প্রাঙ্গনে বেলুন ও পায়রা উড়িয়ে সম্মেলনে উদ্বোধন করেন আবদুল্লাহ আল নোমান।

আজ মঙ্গলবার দুপুরে মুঠোফোনে পূর্বপশ্চিমের প্রতিবেদকের সঙ্গে দলের নীতি-নির্ধারণী ও দিক-নির্দেশনা ও নিজের বিষয়ে কথা বলেন আবদুল্লাহ আল নোমান।

বিএনপির এই নেতা বলেন, আমি তো সক্রিয়ই ছিলাম। তবে কমিটি গঠন করার পর আমাকে যে পদে রাখা হয়েছে, সে পদে থাকতে আমি আগ্রহী হইনি। তবে সেসব নিয়ে এখন আর কিছু বলতে চাই না। নেতৃত্বের বিষয়ে আমার আর কোনো কথা নেই। আমি দলের তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করতে চেয়েছি। কাজ করছি।

চট্টগ্রামে দলের কর্ম ও করণীয় প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, আমি এখানে বিপুল সংখ্যক কর্মী নিয়ে কাজ করে চলেছি। আমাদের দিক-নির্দেশনা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য। জনগণ গণতান্ত্রিক পরিবেশে ফেরত চায়। সেই পরিবেশ ফেরানোর জন্যই আমাদের এ আন্দোলন। এ লক্ষ্যে মহানগর কমিটি সুসংগঠিত হচ্ছে।

তবে মহানগর বিএনপির সভাপতি ডা. শাহাদতের নেতৃত্বে সেটি কতোটুকু সম্ভব, নাকি আদৌ সম্ভব নয়-এমন প্রশ্নের জবাবে নোমান বলেন, এখন ডা. শাহাদাতের পরীক্ষা দেওয়ার সময়। তার অগ্রযাত্রায় দলকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। আমি আশা করি তিনি পারবেন। তবে তারপর জনগণই বলবে, কতোটুকু তিনি পেরেছেন। আমরা কতটুকু পেরেছি। তবে তিনি চট্টগ্রামের সভা-সমাবেশে অবশ্যই নিয়মিত উপস্থিত থাকার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন।

তবে রাজনীতিতে আবদুল্লাহ আল নোমানের আবারো সরব উপস্থিতি দলের জন্য কতোটুকু সুখকর-এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ শামসুদ্দিন জানান, অবশ্যই এটি শতভাগ শুভকর বিষয়। তিনি এমন একজন রাজনীতিবিদ যিনি দলের জন্য সারাজীবন ব্যয় করে গেছেন। তিনি কখনোই দল থেকে দূরে থাকতে পারেন না। না। তার উপস্থিতিই তার সমর্থকদের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরিয়ে দিয়েছে।

এই অধ্যাপক আরো বলেন, সাময়িক অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন তিনি। রাজনীতিতে উত্থান-পতন থাকবেই। তবে অভিমান করে দল থেকে দূরে থাকা অবশ্যই তার একটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিলো।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর