চা বাগান অধ্যূষিত সিলেটের মৌলভীবাজারে বিভিন্ন চা বাগানে একক প্রজাতির বনায়ন রাবার চাষাবাদ বিস্তৃত হওয়ায় হুমকির সম্মুখিন চা শিল্প-ক্ষতির মুখে প্রাণবৈচিত্র্যে। চা বাগানের জন্য লিজ নেয়া এসব টিলা ভূমিতে চা বাগান কর্তৃপক্ষ রাবার চাষাবাদ অব্যাহত রেখেছে।
রাবার চাষাবাদের ফলে চা শিল্পের জন্য দেখা দিচ্ছে হুমকি। অপরদিকে পরিবেশেরও ক্ষতি বয়ে আনছে বলে মন্তব্য করছেন সংশ্লিষ্টরা। রাবার চাষাবাদ চা শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের কর্মসংস্থান ও চায়ের উৎপাদন হ্রাসের আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে।
জানা গেছে, মৌলভীবাজার জেলার চা বাগান সমূহ গত কয়েক বছর যাবত চা চাষের পাশাপাশি রাবার চাষে এগিয়ে আসছে। রাবার চাষাবাদ বিস্তৃত হলে চা শ্রমিকদের কর্মসংস্থান এবং চায়ের উৎপাদন হ্রাস পাবে এমনটা আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। রাবার চাষ পরিবেশের জন্যও অনুকূল নয় এবং পশু পাখিরাও এ সকল গাছ থেকে রীতি মতো খাদ্য সংগ্রহ করতে পারে না বলে কেউ কেউ মন্তব্য করছেন।
রাবার চাষাবাদে চা বাগানে শ্রমিকদের মধ্যে বেকারত্ব বাড়িয়ে দিচ্ছে। সংশ্লিষ্ট এক তথ্যে জানা যায়, মৌলভীবাজার জেলার চা চাষের জন্য লিজ নেয়া টিলা ভূমির ২ হাজার হেক্টরেরও বেশি ভূমিতে রাবার চাষাবাদ চলছে। রাবার চাষাবাদে মুনাফা বেশী থাকায় কর্তৃপক্ষ এখন সেদিকেই ঝোঁক নিয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
পরিবেশবিদদের মতে, দ্রুত মুনাফা সম্পন্ন হলেও রাবার গাছ আমাদের প্রকৃতি, পরিবেশ, বন্যপ্রাণির প্রতিকূল ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে। চা বাগানের শেড ট্রি গুলোতে পরিবেশ রক্ষা, পাখির আবাসস্থল তৈরীতে ভূমিকা রাখছে। কিন্তু রাবার চাষাবাদে এ ধরণের কোন সুবিধা নেই, উপরন্ত ক্ষতির কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে। চা গাছের জন্য ছায়া ও পানি শোষণের জন্য গাছ গাছালি মাটির গুনাগুন উর্বরতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়।
অন্যদিকে রাবার চাষাবাদ যেখানে হয়েছে সেখানে রাবার বাগানের নিচে ঘাসও উঠছে না। রাবার একটি একক প্রজাতির বনায়ন। এর ফলে প্রাণবৈচিত্র্য ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এসব গাছে পাখি বসে না, বন্য প্রাণীদের জন্য খাবার তৈরী করতে পারে না। কৃষি জমির উর্বরতা, পানি প্রাপ্তির হার কমিয়ে দারিদ্রতা বাড়াছে। রাবার চাষাবাদে বাস্তুসংস্থান, জনস্বাস্থ্য ও প্রতিবেশ বজায় রেখে স্থানীয় প্রাণ-বৈচিত্র্য ও লোকায়ত জীবন ব্যবস্থার দিক বিবেচনা করেই চাষাবাদ হওয়া প্রয়োজন বলে তারা মনে করেন।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রামভজন কৈরী জানান, চা বাগানে রাবার চাষাবাদ করলে শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের এবং চা উৎপাদন দু’টিই হ্রাস পাবে। তাছাড়া রাবার চাষাবাদ পরিবেশের জন্যও ক্ষতির কারণ রয়েছে। রাবার বাগানে শ্রমিক নিয়োগ কম হয়। বর্তমানে নতুন করে রাবার চাষাবাদ সরকার বন্ধ করে দিয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। চা শ্রমিক নেতা ও ইউপি সদস্য সীতারাম বিন জানান, তারা চা বাগানে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছেন। রাবার বাগান করে চায়েরও বারোটা বাজতে শুরু করেছে এবং পরিবেশকেও হুমকির সম্মুখিন করছে। এর ফলে শ্রমিকরা রোগাক্রান্ত এবং বেকার হচ্ছে।
ডানকান ব্রাদার্স লংলা চা বাগানের শ্রমিক নেতা সম্ভু অধিকারী বলেন, রাবার গাছের পাতা যেখানে পড়ে সেখানে কোন ফসল উৎপাদন হয় না। তাছাড়া যেসব শ্রমিক গাছ থেকে রাবারের কষ সংগ্রহ করেন, তাদের অধিকাংশেরই বুকে ব্যাথা থাকে। তিনি মন্তব্য করেন, রাবার গাছ কোন গাছ গাছালিকে বেড়ে উঠতে দেয় না। এমনকি ঝোপজঙ্গলও জন্মাতে পারে না। এটি পরিবেশের জন্য খুবই ক্ষতির কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ন্যাশনাল টি কোম্পানি (এনটিসি) মৌলভীবাজারের চা বাগানের একজন কর্মকর্তা বলেন, চায়ের জন্য জমি লিজ এনে চা বাগান সম্প্রসারণ না করে অবৈধভাবে রাবার বাগান করে চা শিল্পকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়া হচ্ছে। ফলে চা শ্রমিকরাও রোগাক্রান্ত হচ্ছে। দেশী বিদেশী কোম্পানী সমুহ চা চাষাবাদে এক সময় ব্যাপক আগ্রহী থাকলেও বর্তমানে চা এর পাশাপাশি রাবার চাষের ঝোঁক বাড়াতে শুরু করেছে। অথচ পরিবেশ দূষন না ঘটিয়ে কিরূপ জমিতে রাবার গাছ লাগানো উচিত তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে না। তাঁর মতে, চা বাগানের টিলার এক প্রান্তে চা এবং অপর প্রান্তে রাবার চাষাবাদ শুরু হয়েছে।
ন্যাশনাল টি কোম্পানি (এনটিসি) ডিজিএম মো. শাহজাহান বলেন, এনটিসি’র পাত্রখোলা, মাধবপুর, কুরমা, বিজয়াসহ কয়েকটি চা বাগানে রাবার বাগান রয়েছে। তবে রাবারের দাম নিন্মগতি ও সংশ্লিষ্টদের অনিহা থাকায় নতুন করে রাবার চাষাবাদ বন্ধ রয়েছে।
চা বাগানে রাবার চাষাবাদ বিষয়ে মৌলভীবাজার জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) অফিসের এক কর্মকর্তা জানান, চা বাগান কর্তৃপক্ষ এক সময়ে বাংলাদেশ টি বোর্ডের (বিটিবি) অনুমতি নিয়ে চা বাগানের পরিত্যক্ত টিলায় রাবার চাষাবাদ শুরু করেছে। এইসব রাবার গাছের বয়স ২৫ থেকে ২৮ বছর বয়স হয়েছে। আরো কয়েক বছর পর রাবার গাছ কেটে ফেলা হবে। জেলা সমম্বয় কমিটির সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক নতুন করে চা বাগানে রাবার চাষাবাদ বন্ধ করা হয়েছে। নতুনভাবে অনুমতি ছাড়া যেকেউ রাবার চাষাবাদ করতে পারবেন না।