ঢাকা ০২:৫৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্মকথা: শান্তির জন্য একটি রাত

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৪:৩০:৪৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৫ জুন ২০১৫
  • ৩৯৫ বার
১৯৯৫ সালে বিএনপি সরকারের সময় মাগুরা আসনে উপনির্বাচনে কারচুপি ও নিরপেক্ষতার প্রশ্ন উঠে। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষভাবে করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলো দাবি তোলে। কিন্তু তদানিন্তন ক্ষমতাসীন সরকার বিষয়টিকে যথাযথ গুরুত্ব দেয় নাই। ফলশ্রুতিতে জাতীয় নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হয় তার জন্য তীব্র আন্দোলন দানা বাঁধে। তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকার মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পর জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘোষণা করে। কিন্তু নির্বাচনের নিরপেক্ষতার প্রশ্নে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী প্রভৃতি শক্তিশালী রাজনৈতিক দলসমূহ নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে। তারপরও সাংবিধানিক প্রয়োজনে ১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিএনপি একতরফাভাবে দুই তৃতীয়াংশেরও বেশি আসন পেয়ে সরকার গঠন করে। কিন্তু এটা জনগণ, বিরোধী রাজনৈতিক দল, দাতা এবং আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। তাই দেশব্যাপী আন্দোলন চলতেই থাকে। দল নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি তুঙ্গে উঠে।
জাতীয় পার্টি দলীয় এমপি এ.কে.এম মাঈদুল ইসলাম মুকুল তার লেখা ‘আত্মসত্তার রাজনীতি এবং আমার ভাবনা’ শীর্ষক গ্রন্থে এসব কথা লিখেছেন। তিনি জিয়াউর রহমানের কেবিনেটের সদস্য ছিলেন।
এ.কে.এম মাঈদুল ইসলাম মুকুল আরও লিখেছেন, সে সময় জনগণের প্রচ- বাঁধার মুখে সরকার রংপুরে কয়েকটি আসনে নির্বাচনই করতে পারেনি। যেহেতু আমার বাড়ি বৃহত্তর রংপুরে এবং পূর্বে আমি প্রায় দশ বৎসর রংপুরের রাজনৈতিক ও উন্নয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ছিলাম। তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে বললেন, রংপুরের আসনগুলোতে নির্বাচন করা যায় কিনা দেখার জন্য। আমি এ লক্ষ্যে রংপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হই। সৈয়দপুর বিমান বন্দরে নেমে দেখি সেখানে দুই ট্রাক পুলিশ অবস্থান করছে। আর আমার জন্য অন্য কোন গাড়িও নেই। অগত্যা পুলিশের গাড়িতে করেই রংপুর যাচ্ছি। সারাক্ষণ মাথা নিচু করে রাখি। মাঝে মাঝে লোকজন না থাকলে খালি মাঠের মধ্যে দিয়ে যখন গাড়ি পার হয় তখন মাথাটা একটু উপরে তুলি। এটা আমার তিক্ত তীব্র অভিজ্ঞতা। যাহোক, রংপুর সার্কিট হাউজে গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখি রাজশাহী কমিশনার ও ডিআইজি পুলিশ উপস্থিত রয়েছেন। নির্বাচন করার ব্যাপারে কমিশনার সাহেবকে বললাম- ডিসি, ম্যাজিস্ট্রেট, ইউএনও এবং সংশ্লিষ্ট নির্বাচন কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা করার জন্য। ডিআইজি সাহেবকে বললাম, পুলিশ অফিসারদের সাথে আলোচনা করার জন্য এবং তাদের মতামত নেয়ার জন্য। এরপর আমরা একসঙ্গে সকলে বসে বিদ্যমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করলাম। এর মধ্যে  পীরগঞ্জ আসন এবং রহিমউদ্দিন সাহেবের আসন দু’টোতে নির্বাচন করা কোন মতেই সম্ভব নয় বলে অনেকেই জানালেন। এসব জায়গায় নির্বাচন করতে হলে রক্তক্ষয় হবে। আমি বললাম যে, আমি রক্তপাতে বিশ্বাসী নই। আপনারা প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়ে দেন যে এ পরিস্থিতে এখানে নির্বাচন করা সম্ভব নয়। পরের দিন আবার পুলিশ পাহারায় আমাকে পৌঁছে দেয়া হয়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, এর মধ্যে রংপুরের পীরগঞ্জ থেকে একজন প্রার্থী, মরহুম মতিউর রহমান, যিনি বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রী পরিষদের সদস্য ছিলেন, তিনি বললেন, ‘বাবা, তোমার সঙ্গে ঢাকায় যাব’। মতিউর রহমান সাহেবের কথা শুনে বুঝতে পারলাম পরিস্থিতি কত ভয়াবহ ছিল। একজন প্রাক্তন মন্ত্রী হিসেবেও সে সময় তিনি নিজ আসনে নির্বাচনে যেতে পারছেন না, এমন কি নিজ এলাকায় থাকাটাও নিরাপদ মনে করছেন না। যাহোক তাঁকে সঙ্গে করেই পুলিশের পাহারায় ঢাকায় চলে আসি।
এর মধ্যেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার কিভাবে করা যায় এ ব্যাপারে সংসদ অধিবেশন ডাকা হয়। সংসদে রাত্র ১১টা পর্যন্ত আলোচনা হয়। কিন্তু কোন সুরাহা হচ্ছে ন্ াবেগম খালেদা জিয়া সে সময় খুব অসুস্থ ছিলেন। সংসদ অধিবেশন চলাকালেই এক পর্যায়ে আমি বেগম খালেদা জিয়াকে অনুরোধ করলাম, এখানে যেহেতু আলোচনা এগুচ্ছে না, আপনার কক্ষে চলুন। তখন বেগম জিয়া তাঁর কক্ষে গিয়ে ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী, খন্দকার মাহবুব উদ্দিন, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার সাহেবকে ডেকে এ ব্যাপারে একটি খসড়া তৈরি করার জন্য বললেন। ডা. বি. চৌধুরী, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, খন্দকার মাহবুব উদ্দিন সকলেই কিভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার করা যায় সে ব্যাপারে খসড়া তৈরি করতে বারবার লেখেন, আবার কাটেন। বার বার কাটছাট, ঘষামাঝা করতে করতে রাত তিনটা বেজে গেল। কারণ এ ধরনের সরকার ব্যবস্থা বিশ্বে কোথাও ছিল না। বেগম খালেদা জিয়া বললেন, দেশের এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য আজ রাত্রেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাস করতে হবে। বেগম জিয়ার দৃঢ় সংকল্প ও সাহসী সিদ্ধান্তের জন্য সেদিন রাতেই বিলটি পাশ করা হলো। সন্ধ্যা থেকে অধিবেশন শুরু হয়। এরপর সারা রাত আলোচনা হল। সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধন করা হল। ভোর পাঁচটার দিকে উক্ত তত্ত্বাবধায়ক বিল সংসদে পাশ হল। সংসদ ভেঙ্গে দেয়া হল। তারপর আবার নির্বাচন। সব রাজনৈতিক দলই অংশগ্রহণ করল। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করল। সদ্য নতুন ‘কনসেপ্ট’ হিসেবে সারা রাত জেগে যে তত্ত্বাবধায়ক বিল পাশ করা হলো হয়তো সেটার কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকতে পারে। এসব ভুলভ্রান্তি থেকে থাকলে সেগুলো প্রয়োজনে সংশোধন করা যেতে পারে।

কিন্তু বর্তমান মহাজোট সরকার যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার জন্য আন্দোলন করেছিল সে কথা আজ বেমালুম ভুলে গেল। তারা সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাদ দিয়ে পুর্বের একই জায়গায় ফিরে এলো। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাদ দিয়ে ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সংবিধান সংশোধন করা হলো। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারে হাইকোর্টের রায় হল। যদিও হাইকোর্টের রায়ে আরও দুইবর তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখা যাবে বলে বলা হয়েছে। কিন্তু বর্তমান মহাজোট সরকার সেদিকে না গিয়ে এমনভাবে সংবিধান সংশোধন করল যেখানে প্রধানমন্ত্রী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান থাকবেন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে আজকে আবার অতীতের মত নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার জোর দাবি উঠেছে। আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।
এক সময় ইউরোপ জুড়েই রাজ্য ও সামন্ত প্রভুদের ইচ্ছাই আইন হিসেবে বিবেচিত হতো। ফ্রান্সের সম্রাট চতুর্দশ লুইয়ের একটি বিখ্যাত  উক্তি ছিল। সেটা হলো, “it is legal because i wish it.” অর্থাৎ ‘এটি আমার ইচ্ছা আর এ জন্যই এটি আইন’। আমাদের প্রধানমন্ত্রীও কি মনে করেন যে, তিনি যেটি মনে করেন সেটিই আইন?

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্মকথা: শান্তির জন্য একটি রাত

আপডেট টাইম : ০৪:৩০:৪৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৫ জুন ২০১৫
১৯৯৫ সালে বিএনপি সরকারের সময় মাগুরা আসনে উপনির্বাচনে কারচুপি ও নিরপেক্ষতার প্রশ্ন উঠে। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষভাবে করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলো দাবি তোলে। কিন্তু তদানিন্তন ক্ষমতাসীন সরকার বিষয়টিকে যথাযথ গুরুত্ব দেয় নাই। ফলশ্রুতিতে জাতীয় নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হয় তার জন্য তীব্র আন্দোলন দানা বাঁধে। তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকার মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পর জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘোষণা করে। কিন্তু নির্বাচনের নিরপেক্ষতার প্রশ্নে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী প্রভৃতি শক্তিশালী রাজনৈতিক দলসমূহ নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে। তারপরও সাংবিধানিক প্রয়োজনে ১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিএনপি একতরফাভাবে দুই তৃতীয়াংশেরও বেশি আসন পেয়ে সরকার গঠন করে। কিন্তু এটা জনগণ, বিরোধী রাজনৈতিক দল, দাতা এবং আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। তাই দেশব্যাপী আন্দোলন চলতেই থাকে। দল নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি তুঙ্গে উঠে।
জাতীয় পার্টি দলীয় এমপি এ.কে.এম মাঈদুল ইসলাম মুকুল তার লেখা ‘আত্মসত্তার রাজনীতি এবং আমার ভাবনা’ শীর্ষক গ্রন্থে এসব কথা লিখেছেন। তিনি জিয়াউর রহমানের কেবিনেটের সদস্য ছিলেন।
এ.কে.এম মাঈদুল ইসলাম মুকুল আরও লিখেছেন, সে সময় জনগণের প্রচ- বাঁধার মুখে সরকার রংপুরে কয়েকটি আসনে নির্বাচনই করতে পারেনি। যেহেতু আমার বাড়ি বৃহত্তর রংপুরে এবং পূর্বে আমি প্রায় দশ বৎসর রংপুরের রাজনৈতিক ও উন্নয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ছিলাম। তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে বললেন, রংপুরের আসনগুলোতে নির্বাচন করা যায় কিনা দেখার জন্য। আমি এ লক্ষ্যে রংপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হই। সৈয়দপুর বিমান বন্দরে নেমে দেখি সেখানে দুই ট্রাক পুলিশ অবস্থান করছে। আর আমার জন্য অন্য কোন গাড়িও নেই। অগত্যা পুলিশের গাড়িতে করেই রংপুর যাচ্ছি। সারাক্ষণ মাথা নিচু করে রাখি। মাঝে মাঝে লোকজন না থাকলে খালি মাঠের মধ্যে দিয়ে যখন গাড়ি পার হয় তখন মাথাটা একটু উপরে তুলি। এটা আমার তিক্ত তীব্র অভিজ্ঞতা। যাহোক, রংপুর সার্কিট হাউজে গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখি রাজশাহী কমিশনার ও ডিআইজি পুলিশ উপস্থিত রয়েছেন। নির্বাচন করার ব্যাপারে কমিশনার সাহেবকে বললাম- ডিসি, ম্যাজিস্ট্রেট, ইউএনও এবং সংশ্লিষ্ট নির্বাচন কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা করার জন্য। ডিআইজি সাহেবকে বললাম, পুলিশ অফিসারদের সাথে আলোচনা করার জন্য এবং তাদের মতামত নেয়ার জন্য। এরপর আমরা একসঙ্গে সকলে বসে বিদ্যমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করলাম। এর মধ্যে  পীরগঞ্জ আসন এবং রহিমউদ্দিন সাহেবের আসন দু’টোতে নির্বাচন করা কোন মতেই সম্ভব নয় বলে অনেকেই জানালেন। এসব জায়গায় নির্বাচন করতে হলে রক্তক্ষয় হবে। আমি বললাম যে, আমি রক্তপাতে বিশ্বাসী নই। আপনারা প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়ে দেন যে এ পরিস্থিতে এখানে নির্বাচন করা সম্ভব নয়। পরের দিন আবার পুলিশ পাহারায় আমাকে পৌঁছে দেয়া হয়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, এর মধ্যে রংপুরের পীরগঞ্জ থেকে একজন প্রার্থী, মরহুম মতিউর রহমান, যিনি বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রী পরিষদের সদস্য ছিলেন, তিনি বললেন, ‘বাবা, তোমার সঙ্গে ঢাকায় যাব’। মতিউর রহমান সাহেবের কথা শুনে বুঝতে পারলাম পরিস্থিতি কত ভয়াবহ ছিল। একজন প্রাক্তন মন্ত্রী হিসেবেও সে সময় তিনি নিজ আসনে নির্বাচনে যেতে পারছেন না, এমন কি নিজ এলাকায় থাকাটাও নিরাপদ মনে করছেন না। যাহোক তাঁকে সঙ্গে করেই পুলিশের পাহারায় ঢাকায় চলে আসি।
এর মধ্যেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার কিভাবে করা যায় এ ব্যাপারে সংসদ অধিবেশন ডাকা হয়। সংসদে রাত্র ১১টা পর্যন্ত আলোচনা হয়। কিন্তু কোন সুরাহা হচ্ছে ন্ াবেগম খালেদা জিয়া সে সময় খুব অসুস্থ ছিলেন। সংসদ অধিবেশন চলাকালেই এক পর্যায়ে আমি বেগম খালেদা জিয়াকে অনুরোধ করলাম, এখানে যেহেতু আলোচনা এগুচ্ছে না, আপনার কক্ষে চলুন। তখন বেগম জিয়া তাঁর কক্ষে গিয়ে ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী, খন্দকার মাহবুব উদ্দিন, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার সাহেবকে ডেকে এ ব্যাপারে একটি খসড়া তৈরি করার জন্য বললেন। ডা. বি. চৌধুরী, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, খন্দকার মাহবুব উদ্দিন সকলেই কিভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার করা যায় সে ব্যাপারে খসড়া তৈরি করতে বারবার লেখেন, আবার কাটেন। বার বার কাটছাট, ঘষামাঝা করতে করতে রাত তিনটা বেজে গেল। কারণ এ ধরনের সরকার ব্যবস্থা বিশ্বে কোথাও ছিল না। বেগম খালেদা জিয়া বললেন, দেশের এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য আজ রাত্রেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাস করতে হবে। বেগম জিয়ার দৃঢ় সংকল্প ও সাহসী সিদ্ধান্তের জন্য সেদিন রাতেই বিলটি পাশ করা হলো। সন্ধ্যা থেকে অধিবেশন শুরু হয়। এরপর সারা রাত আলোচনা হল। সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধন করা হল। ভোর পাঁচটার দিকে উক্ত তত্ত্বাবধায়ক বিল সংসদে পাশ হল। সংসদ ভেঙ্গে দেয়া হল। তারপর আবার নির্বাচন। সব রাজনৈতিক দলই অংশগ্রহণ করল। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করল। সদ্য নতুন ‘কনসেপ্ট’ হিসেবে সারা রাত জেগে যে তত্ত্বাবধায়ক বিল পাশ করা হলো হয়তো সেটার কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকতে পারে। এসব ভুলভ্রান্তি থেকে থাকলে সেগুলো প্রয়োজনে সংশোধন করা যেতে পারে।

কিন্তু বর্তমান মহাজোট সরকার যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার জন্য আন্দোলন করেছিল সে কথা আজ বেমালুম ভুলে গেল। তারা সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাদ দিয়ে পুর্বের একই জায়গায় ফিরে এলো। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাদ দিয়ে ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সংবিধান সংশোধন করা হলো। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারে হাইকোর্টের রায় হল। যদিও হাইকোর্টের রায়ে আরও দুইবর তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখা যাবে বলে বলা হয়েছে। কিন্তু বর্তমান মহাজোট সরকার সেদিকে না গিয়ে এমনভাবে সংবিধান সংশোধন করল যেখানে প্রধানমন্ত্রী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান থাকবেন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে আজকে আবার অতীতের মত নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার জোর দাবি উঠেছে। আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।
এক সময় ইউরোপ জুড়েই রাজ্য ও সামন্ত প্রভুদের ইচ্ছাই আইন হিসেবে বিবেচিত হতো। ফ্রান্সের সম্রাট চতুর্দশ লুইয়ের একটি বিখ্যাত  উক্তি ছিল। সেটা হলো, “it is legal because i wish it.” অর্থাৎ ‘এটি আমার ইচ্ছা আর এ জন্যই এটি আইন’। আমাদের প্রধানমন্ত্রীও কি মনে করেন যে, তিনি যেটি মনে করেন সেটিই আইন?