একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করতে বিজয়ের পূর্বমুহূর্তে দখলদার পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার আল-বদর, আল-শামস মিলিতভাবে বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। তাদেরই একজন শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আলীম চৌধুরী। বাঙালির মেরুদণ্ড ভাঙার চক্রান্তের শিকার হয়ে নিহত এই বুদ্ধিজীবীর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে অঝোরে কাঁদলেন তার মেয়ে ডা. নুজহাত চৌধুরী। এ সময় উপস্থিত শ্রোতারা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। অশ্রুসিক্ত হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও।
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে বুধবার বিকেলে রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে আওয়ামী লীগের আয়োজনে আলোচনা সভায় এ দৃশ্যের অবতারণা হয়। এ সময় প্রধানমন্ত্রীসহ অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবাই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন।
বাবা ডা. আলীম চৌধুরীর স্মৃতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে ডা. নুজহাত চৌধুরী শৈশবে বাবার কাছ থেকে পাওয়া স্নেহ-ভালোবাসা, স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকবাহিনীর দ্বারা বাবাকে তুলে নিয়ে যাওয়া, নির্মমভাবে তাকে হত্যা ও বাবা ছাড়া স্বাধীনতার ৪৫ বছর কাটানোর বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন।
মুক্তিযুদ্ধের ৪৫ বছর পর স্বাধীনতাবিরোধীদের অর্থনৈতিক শক্তি বেড়ে যাওয়ার সমালোচনা করে তিনি বলেন, আমাদের বাবা-মায়ের আত্মত্যাগের এই বাংলাদেশে আমাদেরই মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে দেয়নি পরাজিত শক্তিরা। তারা অর্থনৈতিকভাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে নিয়েছে। নিজেদের মুখোশের আড়ালে ঢেকে নিয়েছে।
একাত্তেরের স্মৃতিচারণ করে নুজহাত চৌধুরী বলেন, ‘১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর। এইদিনে একটি কাদা লেপা মাইক্রোবাস আমাদের বাসার সামনে ঘুরছিল। দেশের সর্বোচ্চ মেধার অধিকারী কিছু মানুষকে গামছা দিয়ে চোখ, হাত বেঁধে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায়। পেছনে পড়ে থেকেছেন তাদের স্ত্রী, ছোট ছোট সন্তানরা। আমার বাবাকেও ১৫ ডিসেম্বর তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে রাখা হয়েছিল বাবাকে। এই অংশটা চিন্তা করতে চাই না। ১৮ ডিসেম্বর যখন আমার বাবার লাশটা পাই তখন বুকটা গুলিতে ঝাঁঝরা ছিল। তার কপালে দেয়ালের চার্জ করা ছিল।
শহীদ এই তনয়া বলেন, ‘আমাদের মা স্বাধীনতার ৪৫ বছর ধরে স্বামীহারা, আমরা বাবাহারা। কিন্তু একটি সোনার বাংলা দেখব বলে আমরা উনাদের এই ত্যাগ হাসিমুখে মেনে নিয়েছি। আমাদের বাবারা মাথা উঁচু করে চলে গেছেন। তারা হাসিমুখে মৃত্যুকে মেনে নিয়েছিলেন এই আত্মবিশ্বাসে যে, পরবর্তী প্রজন্মের হাতে দেশটা গেলে ভালো থাকবে এই আশায়। আমাদের মায়েরা কোনো অভিযোগ, অনুযোগ ছাড়াই চোখের জল দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে গোপন করে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন।’
nuzhatনিজের শৈশবের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘আমি আমার বাবার খুব আদরের মেয়ে ছিলাম। আমার থেকে ঠিক এক বছরের বড় একটা বোন আছে। আমদের যেহেতু পর পর বছরে জন্ম হয়েছিল তাই আমার বোনটা একটু অসুস্থও ছিল। এ কারণে আমার মা আমাকে বেশি সময় দিতে পারতেন না। মায়ের অজান্তে আমি বাবার বুকের ওপর দিয়ে পড়েছিলাম! এত ব্যস্ত একটা ডাক্তার রাতের বেলায় বাসায় ফিরে এসে ওইটুকু মেয়েকে বুকে নিয়ে ঘুমাতেন। পাশ ফিরতে পারতেন না। কাতও হতে পারতেন না। বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে বলেছিলেন, ওরা আমার চোখের ডাক্তারকে মেরে ফেলেছে। এতো ভালো মানুষ ছিলেন আমার বাবা।
মুক্তিযোদ্ধা নির্যাতনের প্রতিবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, একজন মুক্তিযোদ্ধার গায়ে যখন রডের বাড়ি পড়ে তখন শহীদের সন্তান হয়ে নিজেকে বড় অপমানিত বোধ করি। এটা শুধু আমাদের অপমান নয়, যারা স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়েছেন, দেশ স্বাধীন করেছেন তাদের জন্য যে কত বড় আঘাত, তাদের সম্মানে যে কত অপমান, আশা করি সবাই তা বুঝবেন। আর যেন কোনো মুক্তিযোদ্ধা কারো নির্যাতনের শিকার না হোন।
দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, শহীদের সন্তান, বীরাঙ্গনাদের আরো কাছে যাওয়ার আকাঙ্খা প্রকাশ করে তিনি বলেন, সারাদেশে আমার মতো কতো শহীদের সন্তান, কত মুক্তিযোদ্ধা, কত বীরাঙ্গনা ধুঁকে ধুঁকে মরছে। আমি আপনাদের কাছে যেতে চাই, অনেক কিছু জানতে চাই।
তিনি বলেন, স্বাধীনতাবিরোধীরা আজ দেশে শক্ত অবস্থান গেড়ে নিয়েছে। তারা অর্থনৈতিকভাবে অনেক শক্তিশালী। অর্থ, যোগাযোগ যাই বলুন- সবকিছু স্বাধীনতাবিরোধীদের হাতে। আমরা তো ওঠে দাঁড়াতেই পারিনি। আমরা নিয়োগ বাণিজ্যের সুবিধাভোগী হতে পারিনি। তাই তারা আজ অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী। স্বাধীনতার শক্তিকে ধ্বংস করে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে। তাই আমাদের স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে কোনো আপোস করা যাবে না।
ডা. নুজহাত বলেন, স্বাধীনতার পক্ষের যারা রাষ্ট্রের বিভিন্ন পদে আছেন বা তৃণমূলে রাজনীতি করেন তাদের প্রতি একটা অনুনয়, আমরা অনেক আশা নিয়ে, অনেক ত্যাগ নিয়ে, অনেক শোক নিয়ে দেশকে আপনাদের হাতে সমর্পণ করেছি। আমাদের পিতাদের সারা জীবনের বিনিময়ে আমরা চেয়েছি একটি সুন্দর দেশ। সেই সুন্দর দেশ বিনির্মাণের দায়িত্ব কিন্তু আপনাদের। আপনারা স্বাধীনতাবিরোধীদের কোনো সহায়তা করবেন না।
দেশে সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থানের বিষয়ে তিনি বলেন, ’৭৫-এর পটপরিবর্তনের পর সাম্প্রদায়িকতাকে সাংবিধানিকভাবে এই দেশে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুধু সংবিধানে নয়, রাজনীতিতে নয়, মেধা-মননে, সামাজিক আচার-আচরণ, এমনকি আমাদের পারিবারিক জীবনেও সাম্প্রদায়িকতা ঢুকে পড়েছে। এর বিরুদ্ধেই তো আমাদের সংগ্রাম ছিল। আমরা তো এই বাংলাদেশ চাইনি, যেখানে দীপন-অভিজিৎরা বাঁচতে পারে না। সাংবাদিক হুমায়ুন কবির বালুদের বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়া হয়। আমরাতো সব শোক, সব বিচারহীনতার সংস্কৃতি, সব কষ্ট দূর করে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ চেয়েছিলাম।