মিষ্টান্নজাতদ্রব্যের প্রতি বাঙালীর টান আদিকালের। দেশের সর্বত্রই তাই তৈরী হয় নানা স্বাদের-নানা পদের ও নানা বর্ণের মিষ্টি। তবে একই মিষ্টি বিভিন্ন অঞ্চলেই তৈরী হলেও— এক-এক অঞ্চল এক-এক মিষ্টির জন্য প্রসিদ্ধি লাভ করে। আর তা লাভ করে— সেই সেই অঞ্চলের কারিগরদের তৈরীর শৈলী, গুণাগুণ, মান ও নিপুণতার কারণেই। তেমনই স্বাদ ও গুণাগুণের কারণে গাইবান্ধার রসমঞ্জরীর রয়েছে আলাদা সুনাম।
আর তাই, গাইবান্ধাতে এসেছেন কিন্তু রসমঞ্জরীর স্বাদ আস্বাদন করেননি— তবে তো বলতে হয় গাইবান্ধা ভ্রমণই বৃথা! অতিথি আপ্যায়ন ও আনন্দ অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে অফিস-আদালতে গাইবান্ধার সবখানেই যে এই রসমঞ্জরীর জয়গান!
এই অঞ্চলের রসমঞ্জরী এলাকার চাহিদা পূরণ করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যাচ্ছে। কেবল তা-ই নয়, মানুষের রসনায় তৃপ্তি এনে দিতে তা বিদেশেও যাচ্ছে। রসালো ঘন দুধের ক্ষীরের সঙ্গে খাঁটি ছানায় তৈরী মারবেল সদৃশ্য ছোট ছোট গোলাকার রসগোল্লা সমন্বয়ে তৈরী হয় এই মিষ্টি। মুকুল থেকে সদ্য বেরুনো আমের গুটির মতো রসগোল্লা দুধের ঘন ক্ষীরে ‘মঞ্জরিত’ হয়ে দু’টি ভিন্ন স্বাদের সমন্বয়ে সৃষ্টি করে তৃতীয় মাত্রার অপূর্ব স্বাদ। তাই বুঝি মিষ্টির কাব্যিক নাম (রস+মঞ্জরী) ‘রসমঞ্জরী’। অবশ্য অনেক অঞ্চলে এই মিষ্টিকে বলে ‘রসমালাই’।
রসমঞ্জরী কোন্ কারিগর প্রথম তৈরী করেছেন তাঁর নাম জানা না গেলেও এটা জানা যায়— এই অঞ্চলের রসমঞ্জরী প্রথম তৈরী করেছিলেন গাইবান্ধা শহরের মিষ্টি ভাণ্ডারের মালিক রাম মোহন দে। ১৯৪০ সালে যা ব্যবসায়িকভাবে উৎপাদন শুরু হয় এবং ১৯৫০ সালের দিকে এর সুনাম ও পরিচিতি দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে।
গাইবান্ধা জেলা শহরের সার্কুলার রোডের রমেশ ঘোষ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের রমেশচন্দ্র ঘোষ পঞ্চাশের দশকে এই অঞ্চলের রসমঞ্জরীকে গোটা দেশের মিষ্টি প্রিয় রসিকজনদের কাছে পরিচিত ও সুপ্রিয় করে তোলেন। এরপর এগিয়েছে সম্মুখে মিষ্টিপ্রিয়দের মন জয় করে। অবশ্য, এ কথা সত্য যে রসমঞ্জরীর আদি সেই স্বাদের যথেষ্ট ঘাটতি এখানকার মিষ্টিতে রয়েছে।
গাইবান্ধা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, রমেশ ঘোষ মিষ্টির দোকান, পুষ্প মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, জলযোগ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, সন্তোষ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, কালিবাবুর মিষ্টির দোকান, দেব মিষ্টান্ন ভাণ্ডার ও পলাশবাড়ী উপজেলা সদরের শিল্পী হোটেল এ্যান্ড রেষ্টুরেন্ট ও মিতালী হোটেল, গোবিন্দগঞ্জের মায়ামণি ও বনফুল হোটেল এ্যান্ড রেষ্টুরেন্টে ভাল মানের এই রসমঞ্জরী পাওয়া যায়।
রমেশ ঘোষ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের সত্ত্বাধিকারী বলরাম ঘোষ জানালেন, প্রতিকেজি রসমঞ্জরী ২৫০ টাকা এবং প্রতিপ্লেট ৫০ টাকা ও হাফপ্লেট ২৫ টাকা দরে বেচাকেনা চলে। বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্য এমনকি কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে পাঠানোর ক্ষেত্রেও নিজস্ব গোলাকার প্লাস্টিক পাত্রে টেপ দিয়ে এয়ারটাইট প্যাকিংয়ের ব্যবস্থাও রয়েছে।
রসমঞ্জরী তৈরীর কারিগর ভক্ত ঘোষ জানালেন, এই মিষ্টি তৈরীর উপকরণে থাকে খাঁটি গরুর দুধ, চিনি, দুধের ছানা ও মশলার মধ্যে ছোট এলাচ। তৈরীর পদ্ধতি এমন কিছু কঠিন নয়। গরুর দুধ জ্বাল দিয়ে ঘন ক্ষীর করতে হবে এবং তাতে মেশাতে হবে পরিমাণ মতো চিনি। এ ছাড়া ছানা দিয়ে ছোট ছোট গোলাকার গুটি তৈরী করে চিনির সিরায় জ্বাল দিতে হবে। বাদামী রং হলে ছাকনী দিয়ে সিরা ঝরিয়ে রসগোল্লার গুটিগুলো ক্ষীরে মেশাতে হবে। পরে ঠাণ্ডা করে ক্ষীর গুটিগুলোসহ রসমঞ্জরী পাত্রে পরিবেশিত করতে হবে।
তিনি আরও জানালেন, প্রতিকেজি রসমঞ্জরীর গড় উৎপাদন ব্যয় পড়ে প্রায় ২২০ টাকা থেকে ২৩০ টাকা। তবে দুধ, চিনি, ময়দা, এলাচ ও জ্বালানীর মূল্যবৃদ্ধিসহ কারিগরের মজুরী বেড়ে যাওয়ায় এই মিষ্টি তৈরীতে লাভের পরিমাণ সীমিত হয়ে পড়েছে।
রসমঞ্জরী বিক্রেতা অজিত ঘোষের মতে, খাঁটি দুধ প্রাপ্তি ও কারিগরের দক্ষতার ওপরই নির্ভর করে রসমঞ্জরীর গুণ, মান ও স্বাদ। তবে অধিক লাভের আশায় ছানা ও ক্ষীরে বেশী পরিমাণ আটা, সুজি ও অন্যান্য ভেজাল মিশিয়ে গ্রামগঞ্জে অনেক মিষ্টির দোকানে নিম্নমানের রসমঞ্জরীও আজকাল তৈরী হচ্ছে। যাতে এ জেলার ঐতিহ্যবাহী এই মিষ্টির সুনাম বিঘিœত হচ্ছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
ভোজনরোসিকদের যারা এখনো গাইবান্ধা অঞ্চলের রসমঞ্জরীর স্বাদ নেননি— তারা সত্ত্বর এর স্বাদগ্রহণে ভুলবেন না।