দৈনিক আমার দেশের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান তিন বছর সাড়ে সাত মাস কারাগারে থাকার পর জামিনে মুক্ত হয়েছেন গত ২৩ নভেম্বর।কিন্ত রাষ্ট্রদ্রোহ ও সেনা বিদ্রোহে উসকানির অভিযোগে দায়ের করা দুটি মামলায় আটক নাগরিক ঐক্যের আহবায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না এখনো কারাগার থেকে মুক্ত হতে পারেননি।এক বছর নয় মাস ধরে কারাগারে বন্দি রয়েছেন তিনি।
আওয়ামী লীগের একসময়ের সাংগঠনিক সম্পাদক মান্নার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি সরকার উৎখাতে ষড়যন্ত্র ও সেনাবাহিনীকে বিদ্রোহে উসকানি দেয়ার চেষ্টা করেছেন। এসব অভিযোগে তার বিরুদ্ধে দুটি মামলার তদন্ত চলছে। তার জামিনের বিষয়টি এখন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে বিচারাধীন রয়েছে।
দুটি মামলায় হাইকোর্ট থেকে মান্না জামিন পেলেও রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে রোববার (২৭ নভেম্বর) পর্যন্ত তা স্থগিত করে রাষ্ট্রপক্ষকে নিয়মিত লিভ টু আপিল করতে নির্দেশ দেন আপিল বিভাগ। নিয়মানুযায়ী আপিল বিভাগের রোববারের কার্যতালিকায় আদেশের জন্য রাষ্ট্র বনাম মাহমুদুর রহমান মান্না ৫২ নম্বরে রাখা হয়েছে।জামিনের বিষয়টি ওইদিন সুরাহ হতে পারে বলে জানিয়েছেন মান্নার আইনজীবী ইদ্রিসুর রহমান।
নিউ ইয়র্কে অবস্থানরত বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা এবং অন্য এক ব্যক্তির সঙ্গে মান্নার টেলিআলাপের দুটি অডিও ক্লিপ প্রকাশের পর গত বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।রাষ্ট্রদ্রোহ ও সেনা বিদ্রোহে উসকানির অভিযোগে গত বছরের ৫ মার্চ ও ২৪ ফেব্রুয়ারি গুলশান থানায় মান্নার বিরুদ্ধে মামলা দুটি হয়।
এই দুই মামলায় নিম্ন আদালতে মান্নার জামিন আবেদন নাকচ হলে তিনি হাই কোর্টে আবেদন করেন।এই প্রেক্ষিতে গত ২১ মার্চ রুল দেয় বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী ও বিচারপতি কাজী মো. ইজারুল হক আকন্দের হাই কোর্ট বেঞ্চ। মান্না কেন জামিন পাবেন না- তা জানতে চাওয়া হয় ওই রুলে।সেই রুলের শুনানি নিয়ে গত ১০ নভেম্বর বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেন ও বিচারপতি মো. আতাউর রহমান খানের বেঞ্চ মান্নার জামিনের আদেশ দেন ।
রাষ্ট্রপক্ষ ওই আদেশের বিরুদ্ধে চেম্বার আদালতে যায়। চেম্বার বিচারপতি আবেদনটি নিয়মিত বেঞ্চে পাঠিয়ে দিলে গত ১৪ নভেম্বর তা শুনানির জন্য ওঠে।ওইদিন রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের শুনানি করে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আপিল বিভাগ মান্নার জামিন ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত স্থগিত রেখে ওই সময়ের মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষকে নিয়মিত লিভ টু আপিল করতে বলেন।
অপরদিকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে দায়ের করা মামলায় গত ৩০ আগস্ট বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেন ও বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়ার সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ মান্নার জামিন আদেশ দেন। পরে মান্নার জামিন মঞ্জুর করে হাইকোর্টের দেওয়া আদেশ ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত স্থগিত করেন আপিল বিভাগ। একইসঙ্গে হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আবেদন ওই সময় পর্যন্ত মুলতবি রেখে নিয়মিত লিভ টু আপিল করতে বলা হয়।
মাহমুদুর রহমান মান্নার আইনজীবী ইদ্রিসুর রহমান পূর্বপশ্চিমকে বলেন, রাষ্ট্রদ্রোহ ও সেনা বিদ্রোহে উসকানির অভিযোগে দায়ের করা দুই মামলায় মান্নাকে হাইকোর্ট জামিনে দিয়েছেন। পরে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে জামিনের বিরুদ্ধে আপিল করলে আদালত ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত তা স্থগিত রেখে ওই সময়ের মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষকে নিয়মিত লিভ টু আপিল করতে বলেন, যা রোববারের কার্যতালিকায় এসেছে।
এদিকে কারাগারে কেমন আছেন ছাত্রলীগের সাবেক তুখোড় নেতা ও ডাকসু সভাপতি মান্না? পারিবারিক ও তার আইনজীবী সূত্রে জানা গেছে, নানা রোগে এই রাজনীতিক এখন বিপর্যস্ত। যদিও মান্নার জীবনে কারাবাস নতুন নয়; তবে রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে তিনি আগে কারাগারে গেছেন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময়ও গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যেতে হয়েছে তাকে। কিন্তু এবার জোড়া মামলায় গত এক বছর নয় মাস ধরে তিনি কারাগারে বন্দি। পরিবার ও মান্নার রাজনৈতিক সহযোগীদের অভিযোগ, তাকে কারাগারে আটকে রেখে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে।
পারিবারিক সূত্র জানায়, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলায় চোখে স্প্লিন্টারের আঘাত পান মান্না। এ কারণে নিয়মিত ল্যান্স ব্যবহার করতেন আওয়ামী লীগের একসময়কার এই নেতা। হাঁটুর ব্যথার কারণে থেরাপি নিতেন। গত বছর মান্নাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে নেয়ার কয়েক দিন পর গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (সিসিইউ) ভর্তি করা হয়েছিল। বুকে ব্যথা অনুভব করায় তাকে ঢাকা মেডিকেলে নেয়া হয় বলে তখন জানিয়েছিল কারা কর্তৃপক্ষ।
গত ১৬ জুন মাহমুদুর রহমান মান্নাকে ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালে চিকিৎসা দিতে হাইকোর্টের আদেশ বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এস.কে.) সিনহা নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চ এ আদেশ দেন। এর আগে মান্নাকে ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা দিতে গত ৩১ মে কারাকর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ।
বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের সরকারবিরোধী হরতাল-অবরোধের সময় গত বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নার দুটি ফোনালাপ ফাঁস হয়। তাতে দাবি করা হয়, ফোনালাপের অপর প্রান্তের দুজনের একজন হলেন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা। বিষয়টি তখন গণমাধ্যমেও প্রচারিত হয়। তাতে দাবি করা হয়, সরকারবিরোধী আন্দোলন আরও চাঙ্গা করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘লাশ’ফেলার পরামর্শ দিয়েছেন মান্না।ফাঁস হওয়া অপর ফোনালাপে মান্না অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী এক ব্যক্তির সঙ্গে দেশে দেশে চলমান পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের বিষয়ে আলোচনা করেন বলে দাবি করা হয়।
ফেনালাপ ফাঁস হওয়ার দুই দিন পর ২৪ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর ধানমন্ডির স্টার কাবারের সামনে থেকে গ্রেপ্তার করা হয় মান্নাকে। ওই রাতেই গুলশান থানার অপারেশন অফিসার উপপরিদর্শক (এসআই) শেখ সোহেল রানা বাদী হয়ে মান্না ও অজ্ঞাতনামা একজনকে আসামি করে মামলা করেন। দণ্ডবিধির ১৩১ ধারায় মামলা নম্বর ৩২।মামলার এজাহারে মান্নার বিরুদ্ধে ‘সেনাবাহিনীকে উসকানি দেয়াসহ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের’অভিযোগ আনা হয়।
দিন দশেক পর ৫ মার্চ একই থানায় আরেকটি মামলা করা হয় মান্নার বিরুদ্ধে। দ্বিতীয় মামলায় মান্নার পাশাপাশি সাদেক হোসেন খোকাকেও আসামি করা হয়। এ মামলায় দণ্ডবিধির ১২০-বি/১২১-এ/১২৪-এ ধারায় রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়।
পুলিশের করা এই দুই মামলার তদন্ত চলছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উত্তর বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার মাহফুজুল ইসলাম। তিনি বলেন, মাহমুদুর রহমান মান্নার বিরুদ্ধে করা দুটি মামলা তদন্তাধীন রয়েছে। এ বিষয়ে আদালতে অগ্রগতির প্রতিবেদনও দেওয়া হয়েছে।