দফায় দফায় বাড়ছে ওষুধের দাম। তিন বছর ধরে চলছে এ অবস্থা। গত ১১ মাসে চার দফায় দ্বিগুণের বেশি বাড়ানো হয়েছে অ্যান্টিবায়োটিকসহ অতি প্রয়োজনীয় বিভিন্ন ওষুধের দাম। ওষুধের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন ডায়াবেটিস, গ্যাস্ট্রিক, শ্বাসকষ্টজনিত দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা। তাদের মধ্যে যাদের অবস্থা দিন এনে দিনে খাওয়ার মতো, তাদের যেন মরণদশার উপক্রম হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত এক হাজার ৪০০ রকমের ওষুধের দাম ৬০ থেকে ১০০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এপ্রিল থেকে মে পর্যন্ত এসব ওষুধের দাম বাড়ানো হয় ২০ থেকে ৫০ শতাংশ। জুন ও জুলাই মাসে বাড়ানো হয় আরো এক দফা।
সর্বশেষ চলতি নভেম্বর মাসে এসব ওষুধের দাম আবার বাড়ানোর কারণে গত ১১ মাসে তা ২০০ শতাংশে পৌঁছেছে।
নগরীর হালিশহর কে ব্লকের বাসিন্দা আশিকুর রহমান জানান, ডায়াবেটিস ও শ্বাসকষ্টজনিত রোগে প্রতি মাসে তাকে ৫০০-৬০০ টাকার ওষুধ কিনতে হয়। হঠাৎ ওষুধের দাম বেড়ে যাওয়ায় অন্যদের মতো বিপাকে পড়েন তিনি।
চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার বাসিন্দা ফেরদৌস আরা জানান, হজমজনিত রোগে প্রতি পাঁচ দিনে ১০টি মেবিস ট্যাবলেট খেতে হয় তাকে, যার দাম ১৩৫ টাকা। অথচ বছরের শুরুতে এটি বিক্রি হতো ৫৫ টাকায়।
তারা বলেন, বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম এমনিতেই নাগালের বাইরে, তার ওপর দফায় দফায় ওষুধের দাম বেড়ে যাওয়ায় নাভিশ্বাস উঠেছে তাদের।
জানা যায়, দাম বাড়ার শীর্ষে রয়েছে বেক্সিমকো ফার্মা, স্কয়ার, ইনসেপ্টা, একমি ও এসিআই।
জানতে চাইলে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড চট্টগ্রাম বিভাগের জ্যেষ্ঠ আঞ্চলিক বিপণন কর্মকর্তা মঈনুল ইসলাম মজুমদার বলেন, ‘২০১২ সালের শেষ দিকে ডলারের দাম যখন বেড়ে যায় তখন বেক্সিমকো ছাড়া সব কো¤পানি ওষুধের দাম বাড়িয়েছে। কিন্তু অনেক পরে আমরা দাম বাড়িয়েছি। তাছাড়া বর্তমান সময়ে আমাদের দেশে ওষুধের দাম বিশ্বের অনেক দেশ তো বটেই, এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর চেয়েও তুলনামূলক কম।’
এক প্রশ্নের জবাবে বেক্সিমকোর এই কর্মকর্তা বলেন, ‘উৎপাদন খরচসহ যাবতীয় খরচ বেড়ে যাওয়ায় আমরা ওষুধের দাম বাড়াতে বাধ্য হয়েছি। শুধু বেক্সিমকো নয়, প্রায় সব কো¤পানি ওষুধ শিল্প সমিতি ও ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমতিক্রমে ওষুধের দাম বাড়িয়েছে।’
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর চট্টগ্রামের ওষুধ তত্ত্বাবধায়ক কে এম মুহসীনিন মাহবুব বলেন, ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর কর্তৃপক্ষ ওষুধের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করে না। কো¤পানিগুলো নিজেরাই মূল্য নির্ধারণ করে। এ ক্ষেত্রে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কিছুই করার নেই।
চট্টগ্রাম মহানগরীর বৃহত্তম পাইকারি বাজার হাজারী লেইন ও চমেক হাসপাতাল এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, একই মানের হলেও কো¤পানিভেদে ওষুধ বিক্রি হচ্ছে একেক দামে। অতিপ্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিক সিপ্রোফ্লক্সাসিন গ্রুপগুলোর মধ্যে বেক্সিমকোর নিওফ্লক্সিন, স্কয়ারের সিপ্রোসিন ৫০০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট প্রতিটি ২৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা বছরের শুরুর দিকে ছিল ১৩ টাকা। লিব্যাক (৫০০ মিলিগ্রাম) ক্যাপসুলের প্রতিটির দাম ১২ টাকা থেকে হয়েছে ২৫ টাকা। বেড়েছে লিব্যাক সিরাপের দামও। ৮০ টাকা থেকে হয়েছে ১২০ টাকা।
স্কয়ার, বেক্সিমকো, এসিআই, এসকেএফসহ অধিকাংশ কো¤পানির প্রতিটি রেনিটিডিন ট্যাবলেটের মূল্য আড়াই টাকা থেকে বেড়ে এখন ৫ টাকা। দাম বেড়েছে জ্বর-ব্যথার বিভিন্ন কো¤পানির প্যারাসিটামল-ক্যাফেইন গ্রুপের ট্যাবলেটও। স্কয়ারের এইস প্লাস ও বেক্সিমকোর নাপা এক্সট্রা ট্যাবলেট প্রতি পাতার দাম ১৮ টাকা থেকে এখন ২৫ টাকা।
ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য প্রয়োজনীয় স্কয়ার ফার্মাসিউটিকেলসের ইনফরমেট-৫০০ ট্যাবলেট প্রতি পাতা এখন বেড়ে ৩৭ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। চলতি মাসের মাঝামাঝি সময়েও এর দাম ছিল ২৬ টাকা। বেক্সিমকোর ডায়ারিল ১ মিলিগ্রাম ও স্কয়ারের সেকরিন ১ মিলিগ্রাম প্রতিটি ট্যাবলেটের দাম এক মাস আগেও ছিল ৩ টাকা, এখন তা হয়েছে ৭ টাকা ৫০ পয়সা। একই কো¤পানির শ্বাসকষ্টজনিত কাশির সিরাপ টোফেন মাস খানেক আগে ছিল ৪৫ টাকা, এখন তা ৬৫ টাকা।
বেক্সিমকো ফার্মার এক হাজার মিলিলিটার ভেক্সাকোয়া ডিএস আইভি স্যালাইনের দাম মাস খানেক আগে ছিল ৬৮ টাকা, বর্তমানে তা বিক্রি হচ্ছে ১০৫ টাকায়। গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ ওমিপ্রাজল। এই গ্রুপের স্কয়ার, বেক্সিমকো, একমিসহ সব কো¤পানির প্রতি ক্যাপসুলের দাম চার টাকা থেকে এখন পাঁচ টাকা।
শ্বাসকষ্টজনিত রোগে ব্যবহৃত হাঁপানি ও কাশির ট্যাবলেট প্রেডনিসোলন। বেশির ভাগ কো¤পানির এই ওষুধের দাম মোটামুটি একই হলেও ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের প্রেডনিসোলন গ্রুপ কর্টন-৫ মিলিগ্রাম ট্যাবলেটের দাম সাত থেকে ১৫ টাকা বেশি।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, আগাম কোনো ঘোষণা ছাড়াই কো¤পানিগুলো ওষুধের দাম বাড়িয়েছে। ফলে ওষুধের গায়ের খুচরা মূল্যের চেয়ে বেশি দামে ওষুধ বিক্রি করতে হচ্ছে।
ব্যবসায়ীরা আরো অভিযোগ করেন, অন্যদিকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা সামনে দাম বাড়তে পারে এমন ওষুধের মজুদদারিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তারা বেশি মুনাফার আশায় ওষুধের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বর্তমান মূল্যের চেয়ে বেশি দাম নিচ্ছে। ফলে ক্রেতাদের সঙ্গে তাদের প্রতিনিয়ত বচসা হচ্ছে।
পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ মুহূর্তে দাম বাড়ানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই। তাদের অভিযোগ, সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ ছাড়াই কো¤পানিগুলো ওষুধের দাম বাড়িয়ে বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে।
হাজারী লেইনের লোকনাথ ফার্মেসির মালিক সুরজিত সাহা বলেন, বছরে ৩০-৫০ শতাংশ পর্যন্ত ওষুধের দাম বাড়ায় বিভিন্ন কো¤পানি। তবে তারা আমাদের দাম বাড়ার সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ বলে না। শুধু বলে দাম বেড়েছে। যে কারণে তাদের নির্ধারিত রেটেই আমাদের ওষুধ কিনতে হয়। আমাদের বেশি দামে বিক্রি করতে হয়।