প্রচন্ড কোলাহলপূর্ণ বিভাগীয় শহর রংপুর থেকে পাগলাপীর হয়ে তিস্তা ব্যারেজ ডালিয়ার পথে যেতে বাইক দেখাচ্ছে ৫০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম হয়ে গেছে। বাইকচালক সহকর্মী সাংবাদিক হালিম আনছারী জানালেন রাস্তার পাশের টং দোকানে ভাল চা পাওয়া যায়। আশ্বিন মাস তবুও গোটা শরীর ধূলায় ধূসরিত।
রংপুর-দিনাজপুর মহাসড়কে প্রচুর যানবাহন চলাচল করে। ইট-বালু-সিমেন্টের ট্রাকের চাকার বদৌলতে এই গোটা শরীর ধূলাবালিময় হয়ে গেছে। রাস্তার টং দোকানে চায়ের অর্ডার দিয়েই মধ্যবয়স্ক এক মহিলা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন। বললেন, আপনারা কোন এনজিওর বাহে? আমরা এনজিও নই, নির্বাচনের হালচাল দেখতে এসেছি। শুনেই পাশের দাঁড়িয়ে থাকা আরেক মহিলা বললেন, স্যার এখানে জামায়াত ছাড়া কিছুই দেখতে পাবেন না। আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি গোলাম মোস্তফা এমপি পালিয়েছে। তার ছেলে ব্যাংকে চাকরি করতো সেও পালিয়েছে। শুধু ওই এমপি নয়, আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই পালিয়েছে। তবে যারা রয়ে গেছেন তাদের অনেকেই জামায়াতে যোগদান করেছেন। অদূরে টানানো একটি পোস্টার দেখিয়ে বললেন, ওই যে দেখছেন পোস্টার জামায়াতের প্রার্থীর। আওয়ামী লীগের লোকজন ও চিহ্নিত ব্যবসায়ীরা এখন জামায়াতি হয়ে গেছে। জাতীয় পার্টি আছে তবে প্রচারণা নেই। চা পানের পর উপজেলা শহর জলঢাকা পেরুতেই দেখা হলো দীর্ঘদিন ঢাকায় বসবাস করা সিটি ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা শ্রী কৈলাশ রায়ের সঙ্গে। ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে দিয়ে কয়েক বছর ধরে একটি ফিলিং স্টেশনের ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছেন। ভ্যান থেকেই নামতে নামতে ডাক দিলেন। ‘নির্বাচন নিয়ে মানুষের ভাবনা কি?’ প্রশ্ন শুনেই বললেন, মানুষ বুঝে গেছে নির্বাচন হলেই বিএনপি ক্ষমতায় যাবে। তবে এ এলাকায় জামায়াতের প্রচারণা বেশি। জামায়াতের প্রার্থীরা পোস্টারিং করে নির্বাচনে প্রচারণায় নেমে পড়েছেন। ৫ আগস্টের পর বিএনপির অবস্থা খুবই ভাল দেখা গিয়েছিল। কিন্তু জেলার একজন শীর্ষ নেতা (তারেক রহমানের আত্মীয়) জেল থেকে বের হয়ে বিএনপির নির্যাতিত ও পরীক্ষিত নেতাকর্মীদের উপর ছড়ি ঘোড়ানোয় সাংগঠনিক ভাবে দলটি ক্রমান্বয়ে দুর্বল হচ্ছে।
জলঢাকায় জামায়াতের প্রচারণা বেশি হলেও অন্যান্য উপজেলায় জাতীয় পার্টি ও বিএনপির জনসমর্থন বেশি। তবে বিএনপিতে এখন জগাখিচুরি এবং জাতীয় পার্টির নেতারা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন কিনা তা নিয়ে স্বংশয়ে রয়েছেন। আর এনসিপি নামে রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা হয়েছে এখানের মানুষজন জানেন না। রংপুর শহরে এনসিপির তৎপরতা থাকলেও গ্রামের মানুষ চেনেন না। জেহাদুল ইসলাম নামের একজন জামায়াতের নির্বাচনী প্রচারণার পদ্ধতি জানিয়ে বললেন, জুম্মার নামাজের পর এরা মুসুল্লিদের হাতে লিফলেট ধরিয়ে দেয়। কারো কারো হাতে সদস্য ফরম তুলে দেয়। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের যারা চিহ্নিত তারা নিজেদের রক্ষায় ফরম পূরন করে জামায়াতে যোগদান করেন। মসজিদ-মাদরাসাগুলোর কমিটিতে জামায়াত নানাভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে। গণঅভ্যুত্থানের পর বিএনপির নেতারা আওয়ামী লীগ-নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা করায় আওয়ামী লীগের সমর্থক ব্যবসায়ীরাও জামায়াতের দিকে ঝুকে পড়েছে।
পাগলাপীর টু ডালিয়ার তিস্তা বাঁধ রোডে ছিমছাম সবুজের সমারোহ। পথের দু’ধারে গাছের সারি। যেতে যেতে পথে নানাজনের সঙ্গেই কথা হয়। আগের রাতে রংপুরের সেন্ট্রাল রোডের জাতীয় পার্টির অফিসের আড্ডায় দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও রংপুর মহানগরের সাধারণ সম্পাদক এস এম ইয়াসিন বলেছিলেন, জাতীয় পার্টির পক্ষ্যে এবার রংপুরে ভোটের জোয়ার উঠবে। প্রতিটি আসনে আমাদের প্রার্থী প্রায় চূড়ান্ত করাই রয়েছে। আমরা মাঠে নামলে জামায়াত টিকবে না। আওয়ামী লীগের ভোট এবার লাঙ্গল পাবে। প্রসঙ্গ তুলতেই বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ (মাহবুব) সাবেক নেতা বর্তমানে জলঢাকায় প্রভাবশালী শিল্প সংস্কৃতিসহ সব অঙ্গনে পরিচিত মুখ মশিউর রহমান বললেন, স্বৈরাচার এরশাদের জাতীয় পার্টি ভোটে নামলে ভোট ভাগ হবে। তবে এখানকার মানুষের এখনো সন্দেহ নির্বাচন হবে কিনা? নির্বাচন হলে জাতীয় পার্টি অংশ নিতে পারবে কিনা? স্বৈরশাসনক এরশাদের জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ নিতে পারলে ভোটের চিত্র হবে একরকম আর জাপা ছাড়া ভোটের চিত্র হবে আরেক রকম। নিলফামারিতে বিএনপির সাংগঠনিক আবস্থা আগেই দিল দুর্বল। এখন তারেক রহমানের আত্মীয় এক নেতা জেল থেকে বের হওয়ায় বিশৃংখলা-অসন্তোষ আরো বেড়েছে। হাতের আঙ্গুল দিয়ে দূরের একটি গ্রামের দিকে দেখিয়ে বললেন, ওই যে দেখা যায় পশ্চিম বালাগ্রাম; ওখানেই বিতর্কিত নারী তুরিন আফরোজের বাড়ি। ওর বাবা আলমউদ্দিন সিএসপি অফিসার ছিলেন। বিতর্কিত ওই মহিলা জামায়াতের নেতাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে লড়েছেন। আদালতে মহিলা ছিলেন আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে। প্রকাশ্যে জামায়াত বিরোধী হলেও পর্দার আড়ালে ওই মহিলার সঙ্গে জামায়াতের খুবই সখ্য। হাসিনা পালানোর পর মানুষ তার উপর বিক্ষুব্ধ। পেলেই পিটিয়ে মারবে। তাই মহিলা নিরাপত্তার জন্য কারাগরে যাওয়ার প্রয়োজন ছিল। আলোচনা রয়েছে ওই মহিলা জামায়াতের ইশারায় বর্তমানে কারাগারে গেছেন।
ডালিয়া যাওয়ার পথে একটি ফিলিং স্টেশনে বাইকে পেট্রোল নেয়ার সময় চোখে পড়লো নিলফামারী-৩ আসনের জামায়াত মনোনীত প্রার্থী মাওলানা আবদুল্লাহ সালাফির পোস্টার। পোস্টারে দাড়িপাল্লা মার্কা দেখা না গেলেও পার্থীর ঢাউস ছবি। উপরে লেখা রয়েছে শহীদ আবু সাঈদ ও মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধের নাম। জুলাই যোদ্ধাদের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি এলাকাবাসীর দোয়া চেয়েছেন। সেখানে কথা হয় কয়েকজনের সঙ্গে। তারা জানান, জামায়াত পুরোপুরি নির্বাচনী প্রচারণায় নেমে পড়েছে। তবে তারা ইসলামী দল দাবি করলেও কিন্তু ইসলামী দল কিনা সন্দেহ রয়েছে। পোস্টারের দিকে দেখিয়ে এই প্রতিবেদকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন, ওই দেখেন জামায়াত প্রার্থীর নামের আগে মোহাম্মদ নেই। আমার প্রশ্ন একজন মুসলমান নামের আগে মোহাম্মদ নাই কেন? মুসলমানরা নামের আগে মোহাম্মদ লিখে থাকেন। হিন্দুরা নামের আগে শ্রী লেখেন। কিন্তু জামায়াত প্রার্থীর নামের আগে মোহাম্মদ নেই। ওদের প্রচারণা রয়েছে কিন্তু মানুষ ভোট দেবে না। লালমনিরহাট-৩ আসন জেলাসদর, রংপুর-১ আসন গংগাছড়া, রংপুর-৩ আসন রংপুর সদর ও মাহিগঞ্জ, রংপুর-৪ আসন কাউনিয়া-পীরগাছা, রংপুর-৫ আসন মিঠাপুকুরের পায়রাবন্দ, কুড়িগ্রাম-১ আসন ফুলবাড়ি, গাইবান্ধা-১ আসন সুন্দরগঞ্জ, গাইবান্ধা-২ সদরে ঘুরে একই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে। বিভিন্ন দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা ভোটারদের সালাম জানিয়ে ‘অমুক ভাইকে প্রার্থী চাই’ জাতীয় পোস্টারিং করলেও অধিকাংশ আসনে জামায়াতের প্রার্থীরা পোস্টারিং করেছেন। দলটির প্রার্থীদের কারো নামের আগে মোহাম্মদ শব্দটি চোখে পড়েনি। গাইবান্ধার ঘাঘট নদীর ব্রীজের পাশে দাঁড়িয়ে একটি রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন, জামায়াত কার্যত ইসলামী ধারার রাজনৈতিক দল। অথচ তাদের নেতাদের নামের আগে মোহাম্মদ ব্যবহার করতে দেখা যায় না। সব রাজনৈতিক দলের মুসলিম নেতারা নামের আগে মোহাম্মদ শব্দের ব্যবহার করলেও জামায়াত নেতারা কেন নামের আগে মোহাম্মদ ব্যবহার করেন না সেটা রহস্যজনক।
রংপুর বিভাগের ৮ জেলায় ৩৩টি সংসদীয় আসন। এর মধ্যে বৃহত্তর রংপুরের ৫ জেলায় আসন সংখ্যা ২২টি। ডামি প্রার্থীর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রংপুর বিভাগের আট জেলার মোট ৩৩টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২২টি, জাতীয় পার্টি ৪টি এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী ৭টি আসনে জয়ী হয়েছিল। বিগত ১৫ বছর যারা এমপি এবং আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-জাতীয় সংসদের হুইপ হয়েছিলেন; তাদের কেউ কারাগারে কেউ পলাতক। রংপুর, নিলফামারি, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রমের কমপক্ষ্যে ১০টি সংসদীয় আসনের হাটবাজার ও কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা বিক্ষিপ্ত ভাবে নিজের ‘প্রার্থী হিসেব দেখতে চায়’ দাবি করে পোস্টারিং করেছেন। একমাত্র জামায়াত প্রার্থীরা দলীয় প্রার্থী হিসেবে ভোট চেয়ে পোস্টারিং করেছেন। লক্ষ্য করার বিষয় হলো সব রাজনৈতিক দলের প্রার্থীতা প্রত্যাশিদের নামের আগে মোহাম্মদ দেখা গেলেও জামায়াত মনোনীত প্রার্থীদের নামের আগে মোহাম্মদ নেই। রংপুরের মিঠাপুকুরের বেগম রোকেয়া সাখাওয়াতের পায়রাবন্দ এলাকায় (রংপুর-৫) একজন স্থানীয় সংবাদকর্মী বললেন, ভাই, খেয়াল করেছেন, জামায়াতের প্রার্থীদের নামের আগে ‘মোহাম্মদ’ শব্দটি নেই। কেন নেই সেটাই প্রশ্ন। তবে একটি রাজনৈতিক দলের রংপুরের স্থানীয় নেতা জানান, উপনিবেশিক শাসনামলে শিক্ষিত হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ইংরেজদের তাবেদারি করায় প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণপদে চাকরি করেন।ওই সময় শিক্ষিত হিন্দুরা ব্যাপক আকারে তাদের নামের পূর্বে ‘শ্রী’ ব্যবহার করেন। তখন অনেক মুসলমান না বুঝেই হিন্দুদের মত নিজের নামের আগে ‘শ্রী’ লেখা শুরু করে। তখনকার উলামায়ে কেরাম মুসলমানদের স্বাতন্ত্রতা ধরে রাখতে নামের পূর্বে ‘মুহাম্মদ’ যুক্ত করার উৎসাহ দেন। মুসলমানরা নামের আগে ‘মোহাম্মদ’ শব্দের ব্যবহার করেন মূলত মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও অনুগত্য প্রকাশের জন্য। পরবর্তীতে এটা ধর্মীয় সাংস্কৃতিক অভ্যাসে পরিণত হয়।
আসন্ন নির্বাচন নিয়ে উত্তরাঞ্চলের রাজনৈতিক দলগুলোপ প্রস্তুতি-প্রচারণা এবং ভোটারদের ভাবনা জানতে-বুঝতে-সরেজমিন দেখতে ১৬ থেকে ১৯ সেপ্টেম্বর চার দিন রংপুর বিভাগের কয়েকটি জেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরলেও রাতে বিভাগীয় শহর রংপুরের বিভিন্ন স্পটে স্থানীয় সুশীল সমাজ, সাংবাদিক, আইনজীবী, ব্যবসায়ী, পেশাজাবী ও সা্স্কংৃতির ব্যাক্তিত্বদের সঙ্গে আড্ডা হয়। তাদের প্রায় বেশির ভাগই মনে করেন নির্বাচন হলে বিএনপি ক্ষমতায় আসবে এবং রংপুরে জাতীয় পার্টি ভাল ফলাফল করবে। তবে সব দলের নেতাদের উচিত জামায়াতের কাছে রাজনীতি কর্মকৌশল শেখা। জামায়াত নির্বাচনে ভাল ফলাল করতে যেভাবে মেটিকুলাস ডিজাইনে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে ও যতœসহকারে পরিকল্পিতভাবে নির্বাচনী প্রচারণা করছে প্রতিটি দলের সেভাবেই প্রচারণায় নামা উচিত। জামায়াতের নেতাকর্মীরা যেভাবে নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছে তাদের মহিলা নেত্রীরা ঘরে ঘরে যাচ্ছে তাতে করে অনেক সুইং ভোটার দলটির পক্ষে যাবে।
Reporter Name 



















