নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার কুর্শা গ্রামে একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশে অবৈধভাবে ইটভাটার কার্যক্রম চলছে। এতে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০১৩ অনুযায়ী, আবাসিক এলাকা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কৃষিজমির এক কিলোমিটারের মধ্যে কোনও ইটভাটা স্থাপন করা যাবে না। কিন্তু এই আইন ভেঙে ইটভাটা চালাচ্ছে মেসার্স কামাল ব্রিকস।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, কুর্শা গ্রামে রয়েছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দাখিল মাদ্রাসা, কওমি মাদ্রাসা ও এতিমখানা। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংলগ্ন স্থানে ‘মেসার্স কামাল ব্রিকস’ নামে ভাটা তৈরি করে বছরের পর বছর পোড়ানো হচ্ছে ইট। সরকারি তালিকায় ভাটাটির অস্তিত্ব নেই। পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র, জেলা প্রশাসক কর্তৃক লাইসেন্স ও অগ্নিসংযোগের অনুমোদন নেই। তা সত্ত্বেও ইটভাটাটির কার্যক্রম চলছে।
শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, ভাটাটির ১০ মিটারের মধ্যে ইবনে তাইমিয়া দাখিল মাদ্রাসা, মাদ্রাসাতুল রিদওয়ান নামে আরেকটি কওমি মাদ্রাসা, আবাসিক কুর্শা আদর্শ এতিমখানা এবং ১০০ মিটারের মধ্যে অবস্থিত পশ্চিম কুর্শা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এসব প্রতিষ্ঠান সংলগ্ন ইটভাটায় স্বাস্থ্যঝুঁকির পাশাপাশি মারাত্মক হুমকির মুখে রয়েছে পরিবেশ ও প্রতিবেশ। ভাটাটি থেকে নির্গত ধোঁয়ায় শিক্ষার্থীরা হাঁচি, কাশি, অ্যাজমা, এলার্জিসহ নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। আইন অমান্য করে দিনের পর দিন ভাটটি চললেও প্রশাসনের নীরব ভূমিকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও স্থানীয় লোকজন
ইবনে তাইমিয়া দাখিল মাদ্রাসা ও মাদ্রাসাতুল রিদওয়ানের কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেন, আমাদের মাদ্রাসার ঠিক পাশেই ইটভাটার কাজ চলছে। এর ধোঁয়া আর ধুলা ক্লাসের ভেতরে ঢুকে যায়। শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। ভাটাটি বন্ধ হলে আমরা সুন্দর পরিবেশে লেখাপড়া করতে পারবো। এটি বন্ধের জন্য আমরা শতাধিক শিক্ষার্থী ও শিক্ষক গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন করেছি। পরে জেলা প্রশাসক ফৌজিয়া খানের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছি। পরিবেশ সচিব বরাবর অভিযোগ দিয়েছি। কিন্তু অজানা কারণে আজ পর্যন্ত কোনও ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন।
মাদ্রাসাতুল রিদওয়ানের এক শিক্ষক বলেন, দিনভর ধোঁয়া, শব্দ আর শ্রমিকদের হইহুল্লোড় ক্লাস নিতে কষ্ট হয়। ভাটার লোকজন আমাদের জমির একাংশও দখল করেছে। প্রশাসনের কাছে অভিযোগ দিয়েও কাজ হয়নি।
কুর্শা গ্রামের বাসিন্দা মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, শিশুরা ঠিকমতো পড়তে পারে না। ধোঁয়ার গন্ধে নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। আর বিকালে শ্রমিকদের আড্ডা আর তাসের আসর চলে। প্রভাবশালীদের কারণে প্রশাসন কোনও ব্যবস্থা নেয় না। এখনও প্রতিদিন ফসলি জমির মাটি ইটভাটায় যাচ্ছে। এতে জমির পরিমাণ কমছে। ধোঁয়া আর ধুলাবালুতে ফসল নষ্ট হচ্ছে, পরিবেশও খারাপ হচ্ছে।
শামছুন্নাহার নামে আরেক স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, আমরা সুন্দর পরিবেশ চাই। শিশুদের শিক্ষার পরিবেশ চাই। ইটভাটার ছাঁয়ায় আমাদের সন্তানদের স্বপ্ন ও সুস্থ জীবন চাপা পড়ুক, তা চাই না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কামাল ব্রিকস থেকে ৫০০-৬০০ মিটার দূরে আলতাফ ব্রিকসের চিমনি কোনও নোটিশ ছাড়াই গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ দখল, দূষণ ও অনুমোদনহীনতার অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও কামাল ব্রিকস কার্যক্রম চালাচ্ছে। স্থানীয়রা এটিকে ‘একচোখা’ আচরণ বলে অভিযোগ করছেন। কামাল ব্রিকসের মালিক নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের নিকলী উপজেলার সাবেক সভাপতি ইমরুল হাসান ও ঢাকা উত্তর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হকের ভগ্নিপতি কামাল হোসেন ও বিয়াই জহিরুল হক।
সরেজমিনে দেখা গেছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশে ঘনবসতি এলাকায় ও কৃষি জমিতে গড়ে তোলা হয়েছে কামাল ব্রিকসসহ কয়েকটি ইটভাটা। অধিকাংশ ভাটায় কাঠ পুড়িয়ে ইট তৈরি করা হয়। অবৈধ ট্রলির মাধ্যমে আশপাশের এলাকার ফসলি জমির মাটি এনে তৈরি করা হচ্ছে ইট। এমন আরেকটি ভাটা নিকলী উপজেলার বনমালীপুর গ্রামের মেসার্স সামিয়া ব্রিকস। পরিবেশ দূষণের দায়ে পরিবেশ অধিদফতরের মনিটরিং অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট শাখা ভাটাটির কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়। অথচ ভাটাটির কার্যক্রম এখনও চলছে।
এ বিষয়ে জানতে ভাটাটির মালিক ইমরুল হাসানকে একাধিকবার কল দিলেও রিসিভ করেননি। পরিবেশ অধিদফতর কিশোরগঞ্জের দেওয়া তথ্যমতে, জেলায় মোট ইটভাটার সংখ্যা ১১৫ টি। এর মধ্যে ৪৭টি অবৈধ। বৈধ তালিকায় রয়েছে ৬৮টি। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, অবৈধ ভাটাগুলো দ্রুত বন্ধ করতে হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কিশোরগঞ্জ পরিবেশ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক মো. মমিন ভূঁইয়া বলেন, নিকলীতে পরিবেশ নীতিমালা না মানায় চারটি ইটভটার লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। আমরা ইতিমধ্যে অভিযান চালিয়ে তিনটি ইটভাটা ভেঙে দিয়েছি। কামাল ব্রিকস নিয়ে একটি আইনি জটিলতা তৈরি হওয়ায় সেখানে অভিযান চালানো যায়নি। কারণ, এই ভাটার মালিক হাইকোর্টে একটি মামলা করেছেন। আদালত ছয় মাসের জন্য স্থিতাবস্থা জারি করায় ব্যবস্থা নিতে পারিনি আমরা।
নিকলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রেহানা মজুমদার বলেন, অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযানগুলো জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে চালানো হয়। খোঁজ নিয়ে জেনেছি, কামাল ব্রিকসের অনুমোদন নেই। সেটির বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলবো।