পরে বেগম খালেদা জিয়ার পরামর্শে শেষ পর্যন্ত লন্ডনে তারেক রহমান এবং প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হলো। বৈঠকটি যদি কেউ গভীরভাবে লক্ষ করেন তাহলে দেখবেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান শুরুতেই প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে বলেছেন, ‘আম্মা আপনাকে সালাম দিয়েছেন।’ অর্থাৎ বেগম খালেদা জিয়াই অভিভাবক। বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে যে বিএনপি পরিচালিত হচ্ছে সেই বার্তাটি তিনি ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে দিয়েছেন। একই সঙ্গে সন্তান হিসেবে মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা, আনুগত্য ও ভালোবাসার প্রকাশ এটি। বেগম খালেদা জিয়ার পরামর্শ অনুযায়ী বিএনপি তার অবস্থান থেকে সরে আসে। জাতির বৃহত্তর ঐক্যের স্বার্থে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধ্বে অর্থাৎ রোজার আগে নির্বাচন করার প্রস্তাব দেয়। এটি বিএনপির একটি বড় ধরনের ছাড়। বিএনপি যে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক চর্চায় বিশ্বাস করে এবং তারা যে একগুঁয়েমিতে আবদ্ধ থাকতে চায় না, দলের স্বার্থের চেয়ে দেশের স্বার্থ তাদের কাছে বড়—এটিরই প্রমাণ আবার দিল দলটি। আর তা সম্ভব হয়েছে বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা এবং দেশের প্রতি তাঁর ভালোবাসার কারণে। এ জন্যই তাঁকে ‘দেশনেত্রী’ হিসেবে সম্বোধন করেন সাধারণ মানুষ। একটি উত্তপ্ত পরিস্থিতি, ভুল বোঝাবুঝি যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সহজেই সমাধান করা যায় তা দেখিয়ে দিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন।
বেগম খালেদা জিয়া বেশ অসুস্থ। দীর্ঘদিন তিনি নির্যাতিত হয়েছেন, কারাভোগ করেছেন। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত মানুষটি অবশ্যই বেগম খালেদা জিয়া। তাঁকে দীর্ঘদিন নির্জন কারা প্রকোষ্ঠে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। চিকিৎসার সুযোগ দেওয়া হয়নি। এমনকি তিনি যখন গুরুতর অসুস্থ, তখনো তাঁকে তিল তিল করে হত্যার নীলনকশা রচনা করেছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু সব কিছু উপেক্ষা করে বেগম খালেদা জিয়া তাঁর দৃঢ় মনোবল ও আপসহীন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে এবং মহান সৃষ্টিকর্তার কৃপায় বেঁচে আছেন। তাঁর প্রতি যে সীমাহীন জুলুম-নির্যাতন করা হয়েছে, সে ব্যাপারে একটি কথাও বলেননি বেগম জিয়া। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের পতনের পর নিজের মুক্তির জন্য নয়, জাতির মুক্তিতে ‘শুকরিয়া’ আদায় করেন। বলেন, ‘দেশের মানুষ’ এই দিনটি দেখার অপেক্ষায় ছিল।’ এটাই বেগম জিয়া, একজন অনুকরণীয় আদর্শ। এখনো তিনি জাতিকে পথ দেখাচ্ছেন। বেগম খালেদা জিয়ার এই বিচক্ষণতার কারণেই দেশ অনিবার্য একটি সংঘাতের হাত থেকে রক্ষা পেল বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। কারণ, এই বাস্তবতা অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই—এই মুহূর্তে বিএনপি দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক দল। কর্মী-সমর্থকের দিক থেকে তো বটেই, এমনকি জনসমর্থনের দিক থেকেও বিএনপির ধারে কাছে কোনো রাজনৈতিক দল নেই। আবার বিএনপির নেতৃত্বে ৯০ শতাংশ রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধ। বিএনপির নেতৃত্বে এই রাজনৈতিক দলগুলো দীর্ঘ ১৭ বছর স্বৈরাচার এবং ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে জড়িত। তাদের ত্যাগ-তিতিক্ষা অনেক। বাংলাদেশে ‘জুলাই বিপ্লব’ কেবল ৩৬ দিনের আন্দোলন নয়। দীর্ঘদিন জনগণের মধ্যে যে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, বেদনা এবং নিষ্পেষণ তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। আর এই নিষ্পেশনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মশাল জ্বালিয়ে রেখেছিল বিএনপি। জুলাই বিপ্লবে যদি আমরা অবদানের কথা বলতে চাই, তাহলে সবচেয়ে বেশি অবদান বিএনপির লাখো নেতাকর্মীর। বিএনপির হাজার হাজার নেতাকর্মী মিথ্যা মামলায় হয়রানির শিকার হয়েছেন, বহু কর্মী গুম হয়েছেন। অনেকে আহত হয়েছেন। অনেকে প্রাণ দিয়েছেন। এসব ত্যাগের বিনিময়ে আসলে শেষ পর্যন্ত স্বৈরাচারী শাসনের পতন ঘটেছে। বিএনপি ও তার মিত্র রাজনৈতিক দলগুলো যদি অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়, তাহলে এই সরকারের ক্ষমতায় থাকা কেবল দুরূহ নয়, অসম্ভব হয়ে পড়বে। দেশে একটি শূন্যতা, বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। দেশ যখন সেই অনিশ্চয়তার পথে হাঁটছিল, তখন জাতিকে পথ দেখালেন বেগম জিয়া। বাংলাদেশ যেন গণতন্ত্রের পথে যায়, বাংলাদেশ যেন ঐক্যের পথে যায় এবং দেশ গড়ার সংগ্রামে যেন সবাই সম্মিলিত হয়ে অংশগ্রহণ করতে পারে, সেই বার্তাটি দিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন গভীর সংকট উত্তরণের পথ দেখালেন। হয়ে উঠলেন জাতীয় ঐক্যের প্রতীক, জাতির কাণ্ডারি।
নির্বাচন নিয়ে যখন অন্তর্বর্তী সরকার একটি ভুল পথে হাঁটছিল, তখন একটি রাজনৈতিক সমঝোতা সৃষ্টি এবং জাতীয় ঐক্যের আবহকে টিকিয়ে রাখার জন্য বেগম জিয়া যে পরামর্শ দিয়েছেন তা ঐতিহাসিক। তিনি দলের স্বার্থকে যেমন বিসর্জন দিয়েছেন, তেমনি ঐক্যকে অটুট রাখার পন্থাও খুঁজে বের করেছেন। শুধু এবার নয়, ১৯৮২ সাল থেকে তাঁর রাজনীতিতে আসার পর থেকে তিনি কখনো ব্যক্তির স্বার্থ বা দলের স্বার্থ দেখেননি। সব সময় দেশের স্বার্থ দেখেছেন সবার আগে। দেশ সবার আগে এবং দেশের মানুষের কল্যাণের জন্যই তিনি তাঁর রাজনীতিকে পরিচালিত করেছেন। এ কারণেই তিনি জনপ্রিয়তার শীর্ষে। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে গিয়ে তিনি ক্ষমতার হালুয়া-রুটির ভাগ নিতে পারতেন, কিন্তু জনগণের স্বার্থে তিনি সেই নির্বাচনে যাননি। তাঁর আপসহীন নেতৃত্বের কারণেই ’৯০-এ স্বৈরাচারের পতন হয়। ’৯১-এর নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর তিনি দলের স্বার্থের চেয়ে দেশের ও জনগণের স্বার্থকে প্রাধান্য দেন। বিএনপি দলগতভাবে সংসদীয় রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থা বিশ্বাস করত। কিন্তু দেশের স্বার্থে নির্বাচনে বিজয়ের পর তিনি সংসদীয় সরকারব্যবস্থা পুনঃ প্রবর্তন করেন। গড়ে তোলেন জাতীয় ঐক্য। জনগণের স্বার্থে, জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার কারণেই তিনি নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন ১৯৯৬ সালে। এখন যে ব্যবস্থাকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের একমাত্র পথ মনে করা হয়।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনি একটি অনুকরণীয় উদাহরণ, যিনি দেশের কল্যাণের জন্য রাজনীতি করেন। ব্যক্তিস্বার্থ, ব্যক্তিগত লোভ এবং দলের স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে দেশকে ভালোবাসা এবং দেশপ্রেমের অনন্য নজির স্থাপন করেছেন বেগম খালেদা জিয়া। আর এবার ড. ইউনূস ও তারেক রহমানের বৈঠক আয়োজনের নেপথ্যে থেকে তিনি প্রমাণ করলেন, তিনি জাতির কাণ্ডারি, সত্যিকারের অভিভাবক।