ঢাকা ০৫:৫৯ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৩ জুন ২০২৫, ৮ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ভুলে ভরা টিকটকের অর্ধেকেরও বেশি মানসিক স্বাস্থ্য পরামর্শের ভিডিও

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১১:৪৯:৫৯ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২ জুন ২০২৫
  • ১৩ বার

টিকটকে ট্রেন্ডিং থাকা মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক শীর্ষ ১০০টি ভিডিও বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এর অর্ধেকেরও বেশি ভিডিওতে ভুল বা বিভ্রান্তিকর তথ্য রয়েছে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান পরিচালিত এক অনুসন্ধানে এ তথ্য উঠে এসেছে।

বর্তমানে অনেকেই মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তার জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভরসা করছেন। তবে এই অনুসন্ধান বলছে, সেখানে ‘তাৎক্ষণিক সমাধানে’র মতো ভুল থেরাপিউটিক ভাষার ব্যবহার এবং অসত্য দাবি ছড়িয়ে পড়ছে

গবেষণায় দেখা যায়, কিছু ভিডিওতে এমন পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। যেমন—উদ্বেগ কমাতে গোসলের সময় কমলা খাওয়া বা ম্যাগনেশিয়াম গ্লাইসিনেট, তুলসী ও জাফরান জাতীয় পরিপূরক গ্রহণ করার কথা। মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নে এসবের কার্যকারিতার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি খুবই সীমিত। আবার কিছু ভিডিওতে এক ঘণ্টার মধ্যে ট্রমা নিরাময়ের পদ্ধতি শেখানো হচ্ছে বা সাধারণ আবেগ-অনুভূতিকে সীমার বাইরে গিয়ে মানসিক রোগ হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে।

দ্য গার্ডিয়ান ‘mentalhealthtips’ হ্যাশট্যাগের অধীনে টিকটকের শীর্ষ ১০০টি ভিডিও বিশ্লেষণের জন্য মনোবিজ্ঞানী, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এবং একাডেমিক বিশেষজ্ঞদের কাছে পাঠিয়েছিল। তাদের মত অনুযায়ী, এই ১০০টি ভিডিওর মধ্যে ৫২টি ভিডিওতে কোনো না কোনোভাবে ভুল তথ্য উপস্থাপিত হয়েছে। অন্য অনেক ভিডিও ছিল অস্পষ্ট বা তেমন কার্যকর নয়।

কিংস কলেজ লন্ডনের স্নায়ুমনোরোগ বিশেষজ্ঞ এবং গবেষক ডেভিড ওকাই বলেন, অনেক ভিডিওতে ‘ওয়েলবিয়িং’, ‘অ্যাংজাইটি’ ও ‘মেন্টাল ডিসঅর্ডার’—এই শব্দগুলোকে অদলবদল করে ব্যবহার করা হয়েছে, যা মানসিক অসুস্থতার প্রকৃত ধারণা সম্পর্কে বিভ্রান্তি তৈরি করে। তিনি বলেন, ‘সংক্ষিপ্ত, নজরকাড়া ভিডিওগুলো প্রায়ই প্রাতিষ্ঠানিক থেরাপির জটিলতাকে ছাপিয়ে যায়।’

যুক্তরাজ্যের জাতীয় স্বাস্থ্যসেবার (এনএইচএস) মনোরোগ চিকিৎসক ও সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ড্যান পলটার বলেন, ‘কিছু ভিডিও দৈনন্দিন আবেগকে মারাত্মক মানসিক রোগ হিসেবে তুলে ধরছে, যা তরুণদের জন্য বিভ্রান্তিকর এবং প্রকৃত রোগীদের অভিজ্ঞতাকে তুচ্ছ করছে।’

ব্রিটিশ সাইকোলজিক্যাল সোসাইটির স্বীকৃত মনোবিজ্ঞানী অ্যাম্বার জনস্টন বলেন, ট্রমাবিষয়ক বেশির ভাগ ভিডিওতে সত্যের কিছুটা অংশ থাকলেও, তা অতিরিক্ত সাধারণীকরণ করে পিটিএসডির (পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার) মতো জটিল সমস্যাকে সরলভাবে তুলে ধরা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘প্রত্যেক মানুষের ট্রমা বা মানসিক আঘাত ও পিটিএসডি অভিজ্ঞতা আলাদা। এগুলো বোঝার জন্য প্রশিক্ষিত বিশেষজ্ঞের সহায়তা প্রয়োজন।’

টিকটক বলেছে, যারা মানুষকে চিকিৎসা না নেওয়ার পরামর্শ দেয় বা ক্ষতিকর চিকিৎসা প্রচার করে এমন ভিডিও তারা সরিয়ে ফেলে। যুক্তরাজ্যে কেউ যদি বিষণ্নতা, উদ্বেগ বা পিটিএসডির মতো শব্দ সার্চ করে, তাকে এনএইচএসর তথ্য পেজে পাঠানো হয়।

এদিকে, প্রযুক্তিবিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান লেবার পার্টির এমপি চি ওনওয়ুরাহ বলেন, অনলাইন সেফটি অ্যাক্ট (ওএসএ) কতটা কার্যকরভাবে ভুল ও ক্ষতিকর তথ্য ঠেকাতে পারছে তা নিয়ে তদন্ত চলছে। তিনি বলেন, ‘অ্যালগরিদমের মাধ্যমে টিকটক ক্ষতিকর ভুল তথ্য ছড়াচ্ছে—এটি গুরুতর উদ্বেগের বিষয়।’

লিবারেল ডেমোক্র্যাট এমপি ভিক্টোরিয়া কলিন্স এই গবেষণার ফলাফলকে ‘ভয়াবহ’ বলে উল্লেখ করেন এবং সরকারকে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান।

স্বাস্থ্য ও সামাজিক সেবা সিলেক্ট কমিটির চেয়ারপারসন লেবার পার্টির এমপি পলেট হ্যামিল্টন বলেন, ‘সোশ্যাল মিডিয়ার তথাকথিত টিপস কখনোই পেশাদার চিকিৎসার বিকল্প হতে পারে না।’

রয়্যাল কলেজ অব সাইকিয়াট্রিস্টসের অনলাইন সেফটি বিষয়ক প্রধান অধ্যাপক বার্নাডকা ডুবিকা বলেন, ‘সোশ্যাল মিডিয়া সচেতনতা বাড়াতে পারে, তবে মানসিক অসুস্থতা শনাক্তের জন্য প্রশিক্ষিত পেশাজীবীর পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন প্রয়োজন।’

টিকটকের একজন মুখপাত্র বলেন, ‘টিকটক এমন একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে মানুষ তাদের মানসিক স্বাস্থ্যভিত্তিক অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেয় এবং সহানুভূতিশীল কমিউনিটি তৈরি করে। এই গবেষণার পদ্ধতিগত সীমাবদ্ধতা রয়েছে, যা মানুষের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ভাগ করার স্বাধীনতাকে চ্যালেঞ্জ করে।’

সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তারা অনলাইন সেফটি অ্যাক্টের মাধ্যমে ক্ষতিকর ভুল তথ্য কমাতে উদ্যোগ নিয়েছে। বিশেষ করে শিশুদের জন্য ক্ষতিকর কনটেন্ট ঠেকাতে প্ল্যাটফর্মগুলোকে বাধ্য করা হয়েছে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

ভুলে ভরা টিকটকের অর্ধেকেরও বেশি মানসিক স্বাস্থ্য পরামর্শের ভিডিও

আপডেট টাইম : ১১:৪৯:৫৯ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২ জুন ২০২৫

টিকটকে ট্রেন্ডিং থাকা মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক শীর্ষ ১০০টি ভিডিও বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এর অর্ধেকেরও বেশি ভিডিওতে ভুল বা বিভ্রান্তিকর তথ্য রয়েছে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান পরিচালিত এক অনুসন্ধানে এ তথ্য উঠে এসেছে।

বর্তমানে অনেকেই মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তার জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভরসা করছেন। তবে এই অনুসন্ধান বলছে, সেখানে ‘তাৎক্ষণিক সমাধানে’র মতো ভুল থেরাপিউটিক ভাষার ব্যবহার এবং অসত্য দাবি ছড়িয়ে পড়ছে

গবেষণায় দেখা যায়, কিছু ভিডিওতে এমন পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। যেমন—উদ্বেগ কমাতে গোসলের সময় কমলা খাওয়া বা ম্যাগনেশিয়াম গ্লাইসিনেট, তুলসী ও জাফরান জাতীয় পরিপূরক গ্রহণ করার কথা। মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নে এসবের কার্যকারিতার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি খুবই সীমিত। আবার কিছু ভিডিওতে এক ঘণ্টার মধ্যে ট্রমা নিরাময়ের পদ্ধতি শেখানো হচ্ছে বা সাধারণ আবেগ-অনুভূতিকে সীমার বাইরে গিয়ে মানসিক রোগ হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে।

দ্য গার্ডিয়ান ‘mentalhealthtips’ হ্যাশট্যাগের অধীনে টিকটকের শীর্ষ ১০০টি ভিডিও বিশ্লেষণের জন্য মনোবিজ্ঞানী, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এবং একাডেমিক বিশেষজ্ঞদের কাছে পাঠিয়েছিল। তাদের মত অনুযায়ী, এই ১০০টি ভিডিওর মধ্যে ৫২টি ভিডিওতে কোনো না কোনোভাবে ভুল তথ্য উপস্থাপিত হয়েছে। অন্য অনেক ভিডিও ছিল অস্পষ্ট বা তেমন কার্যকর নয়।

কিংস কলেজ লন্ডনের স্নায়ুমনোরোগ বিশেষজ্ঞ এবং গবেষক ডেভিড ওকাই বলেন, অনেক ভিডিওতে ‘ওয়েলবিয়িং’, ‘অ্যাংজাইটি’ ও ‘মেন্টাল ডিসঅর্ডার’—এই শব্দগুলোকে অদলবদল করে ব্যবহার করা হয়েছে, যা মানসিক অসুস্থতার প্রকৃত ধারণা সম্পর্কে বিভ্রান্তি তৈরি করে। তিনি বলেন, ‘সংক্ষিপ্ত, নজরকাড়া ভিডিওগুলো প্রায়ই প্রাতিষ্ঠানিক থেরাপির জটিলতাকে ছাপিয়ে যায়।’

যুক্তরাজ্যের জাতীয় স্বাস্থ্যসেবার (এনএইচএস) মনোরোগ চিকিৎসক ও সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ড্যান পলটার বলেন, ‘কিছু ভিডিও দৈনন্দিন আবেগকে মারাত্মক মানসিক রোগ হিসেবে তুলে ধরছে, যা তরুণদের জন্য বিভ্রান্তিকর এবং প্রকৃত রোগীদের অভিজ্ঞতাকে তুচ্ছ করছে।’

ব্রিটিশ সাইকোলজিক্যাল সোসাইটির স্বীকৃত মনোবিজ্ঞানী অ্যাম্বার জনস্টন বলেন, ট্রমাবিষয়ক বেশির ভাগ ভিডিওতে সত্যের কিছুটা অংশ থাকলেও, তা অতিরিক্ত সাধারণীকরণ করে পিটিএসডির (পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার) মতো জটিল সমস্যাকে সরলভাবে তুলে ধরা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘প্রত্যেক মানুষের ট্রমা বা মানসিক আঘাত ও পিটিএসডি অভিজ্ঞতা আলাদা। এগুলো বোঝার জন্য প্রশিক্ষিত বিশেষজ্ঞের সহায়তা প্রয়োজন।’

টিকটক বলেছে, যারা মানুষকে চিকিৎসা না নেওয়ার পরামর্শ দেয় বা ক্ষতিকর চিকিৎসা প্রচার করে এমন ভিডিও তারা সরিয়ে ফেলে। যুক্তরাজ্যে কেউ যদি বিষণ্নতা, উদ্বেগ বা পিটিএসডির মতো শব্দ সার্চ করে, তাকে এনএইচএসর তথ্য পেজে পাঠানো হয়।

এদিকে, প্রযুক্তিবিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান লেবার পার্টির এমপি চি ওনওয়ুরাহ বলেন, অনলাইন সেফটি অ্যাক্ট (ওএসএ) কতটা কার্যকরভাবে ভুল ও ক্ষতিকর তথ্য ঠেকাতে পারছে তা নিয়ে তদন্ত চলছে। তিনি বলেন, ‘অ্যালগরিদমের মাধ্যমে টিকটক ক্ষতিকর ভুল তথ্য ছড়াচ্ছে—এটি গুরুতর উদ্বেগের বিষয়।’

লিবারেল ডেমোক্র্যাট এমপি ভিক্টোরিয়া কলিন্স এই গবেষণার ফলাফলকে ‘ভয়াবহ’ বলে উল্লেখ করেন এবং সরকারকে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান।

স্বাস্থ্য ও সামাজিক সেবা সিলেক্ট কমিটির চেয়ারপারসন লেবার পার্টির এমপি পলেট হ্যামিল্টন বলেন, ‘সোশ্যাল মিডিয়ার তথাকথিত টিপস কখনোই পেশাদার চিকিৎসার বিকল্প হতে পারে না।’

রয়্যাল কলেজ অব সাইকিয়াট্রিস্টসের অনলাইন সেফটি বিষয়ক প্রধান অধ্যাপক বার্নাডকা ডুবিকা বলেন, ‘সোশ্যাল মিডিয়া সচেতনতা বাড়াতে পারে, তবে মানসিক অসুস্থতা শনাক্তের জন্য প্রশিক্ষিত পেশাজীবীর পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন প্রয়োজন।’

টিকটকের একজন মুখপাত্র বলেন, ‘টিকটক এমন একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে মানুষ তাদের মানসিক স্বাস্থ্যভিত্তিক অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেয় এবং সহানুভূতিশীল কমিউনিটি তৈরি করে। এই গবেষণার পদ্ধতিগত সীমাবদ্ধতা রয়েছে, যা মানুষের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ভাগ করার স্বাধীনতাকে চ্যালেঞ্জ করে।’

সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তারা অনলাইন সেফটি অ্যাক্টের মাধ্যমে ক্ষতিকর ভুল তথ্য কমাতে উদ্যোগ নিয়েছে। বিশেষ করে শিশুদের জন্য ক্ষতিকর কনটেন্ট ঠেকাতে প্ল্যাটফর্মগুলোকে বাধ্য করা হয়েছে।