ঢাকা ০৪:৫৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৮ মে ২০২৫, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

চালের বাজার অস্থিরতার নেপথ্যে কী

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৫:২৯:৫১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল ২০২৫
  • ২২ বার

আমন মৌসুমে কৃষকের কাছ থেকে মনপ্রতি ১১০০ টাকায় ধান কিনে ছোট ছোট গুদামে মজুত করে। কয়েক মাস পর সেই ধান ১৬০০-১৭০০ টাকা বিক্রির টার্গেট নেয় চক্রটি। ফলে কৃষক পর্যায়ে সরবরাহ কমায় মিল পর্যায়ে বাড়তে শুরু করে চালের দাম। মৌসুমি ব্যবসায়ীদের একচেটিয়া ধান মজুতের প্রভাবে এবার নতুন করে চালের বাজারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে।

এর প্রভাব পড়ে পাইকারি বাজারে। খেসারত হিসাবে খুচরা বাজারেও চালের মূল্য বাড়ছে হুহু করে। চালে এই বাড়তি খরচের মাশুল গুনতে হচ্ছে দেশের সব মানুষকে। এখন গরিবের মোটা চাল কিনতে কেজিপ্রতি খরচ হচ্ছে ৬০-৬২ টাকা। এতে বিপদে পড়েছেন নিম্ন-আয় ও খেটে খাওয়া মানুষ।

অপরদিকে খুচরা বাজারে মিনিকেট ও নাজিরশাইলের কেজি ঠেকেছে ৯০-৯৬ টাকায়। অর্থশালীদের জন্য এক কেজি মিনিকেট চাল ৯৬ টাকায় কেনা সম্ভব হলেও মধ্যবিত্ত শ্রেণির আয় কমে যাওয়ায় তারা আর পারছেন না। ঝুঁকছেন মোটা চালের দিকে। সোমবার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।

সোমবার রাজধানীর নয়াবাজার, জিনজিরা কাঁচাবাজার, মালিবাগ বাজার ও রামপুরা কাঁচাবাজারসহ চারটি বাজার ঘুরে চালের দাম বৃদ্ধির চিত্র পাওয়া গেছে। এতে দেখা যায়, এক মাস আগে প্রতি কেজি মোটা চালের মধ্যে স্বর্ণা জাতের মূল্য ছিল আগে ৫৫ টাকা। এখন (২১ এপ্রিল) সেই চাল কেজিপ্রতি ৫-৭ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৬০-৬২ টাকায়। ৬২ টাকার পাইজাম চাল বিক্রি হচ্ছে ৬৫ টাকা দরে। ৮৫ টাকার মিনিকেট বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৯০-৯২ টাকায়। তবে উচ্চমূল্যে নাজিরশাইলের দাম ৯০-৯৬ টাকায় স্থিতিশীল রয়েছে।

বাজারে চালের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় ভোক্তাসাধারণ উদ্বিগ্ন। যদিও অন্তর্বর্তী সরকারের খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার মনে করেন, আমন মৌসুমের শেষভাগে এসে বাজারে চালের দাম ১/২ টাকা বাড়া অস্বাভাবিক কিছু না। বিপুল আমদানি এবং সংগ্রহ সত্ত্বেও কেন বাজার নিয়ন্ত্রণে আসছে না-এমন প্রশ্নে তিনি যুগান্তরকে বলেন, খোঁজ নিয়ে দেখেন বাজারে সবকিছুর দাম একটু বেড়েছে। চালের দাম একটু বাড়াটাও স্বাভাবিক। কারণ, কৃষক যদি ন্যায্যমূল্য না পান বা উৎপাদন মূল্য হারান, তাহলে তারা চাষাবাদ বন্ধ করে দেবেন।

উপদেষ্টা আরও বলেন, সরকার চলতি মৌসুমে ৪৯ টাকা দরে বোরো চাল ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ৩৬ টাকা দরে বোরো ধান এবং গম সংগ্রহ করা হবে। দাম বাড়ানোর পেছনে যুক্তি হচ্ছে কৃষককে স্বাবলম্বী করা। কৃষককে লাভবান করতেই এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। উপদেষ্টা বলেন, মাঝারি মানের চাল বাজারে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু মোটা চাল (সাধারণ মানুষের চাল) ৫২ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

যদিও সরকারি সংস্থা টিসিবির হিসাবে সোমবার খুচরা বাজারে প্রতি কেজি মোটা চালের দাম ছিল সর্বোচ্চ ৫৭ টাকা। এক মাস আগে টিসিবির মূল্য তালিকায় এ চাল সর্বোচ্চ ৫৫ টাকায় বিক্রির তথ্য দেওয়া আছে। সরকারি হিসাবেও মাসের ব্যবধানে মোটা চালের দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ২ টাকা।

নয়াবাজারে চাল কিনতে আসা মো. ইউসুফ বলেন, চাল ছাড়া আমাদের চলে না। সেই চালের দাম যদি এত হয়, আমাদের কীভাবে চলবে। বাজারে সব ধরনের চালের দামই বাড়তি। মধ্য আয়ের ইউসুফ আগে মিনিকেট চাল কিনতেন। তবে বাজারে এসে সেই চাল ৯০ টাকার ওপরে দেখে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, এক কেজি চাল কিনতে যদি ৯০ টাকা খরচ করি, তাহলে অন্যান্য পণ্য কী করে কিনব?

মালিবাগ কাঁচাবাজারের খালেক রাইস এজেন্সির মালিক দিদার হোসেন যুগান্তরকে বলেন, এবার মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চালের বাজার অস্থির করে রেখেছেন। তারা বেশি দামে ধান বিক্রির জন্য মজুত করেছেন। এতে মিল পর্যায়ে দাম বাড়ায় পাইকারি বাজারে দাম বেড়েছে।

এদিকে রাজধানীর কাওরান বাজারের পাইকারি আড়ত আল্লাহর দান রাইস এজেন্সির মালিক সিদ্দিকুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, চালকল মিলে দাম বেড়েছে। মৌসুমি ধান বিক্রেতাদের কারসাজিতে এবার চালের দাম বেড়েছে। তিনি জানান, মিল থেকে চাল এনে পরিবহণ খরচ ও কিছু লাভ রেখে আমরা বিক্রি করে দিই। সেক্ষেত্রে পাইকারি পর্যায়ে মোটা চালের মধ্যে স্বর্ণা জাতের চাল বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) ২৬৫০ টাকায় বিক্র করছি, যা এক মাস আগেও ২৫৫০ টাকা ছিল। মোটা জাতের স্বর্ণা চাল বস্তাপ্রতি বেড়েছে ১০০ টাকা। তিনি জানান, পাইজাম চালের বস্তা বিক্রি করছেন ২৮০০ টাকা, যা আগে ২৭০০ টাকা ছিল। তার কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, পাইজাম বেড়েছে বস্তাপ্রতি ১০০ টাকা। অপরদিকে তিনি মিনিকেট বিক্রি করছেন বস্তা ৪৩০০ টাকা, যা এক মাস আগে বিক্রি করেছেন ৪১০০ টাকায়। অর্থাৎ মিনিকেটে বস্তাপ্রতি বেড়েছে ২০০ টাকা।

এদিকে ঢাকার বাইরে সোমবার নওগাঁ ও দিনাজপুরে মিল পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সোমবার প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) স্বর্ণা জাতের মোটা চাল বিক্রি হয় ২৫৫০-২৬০০ টাকায়, যা এক মাস আগে ছিল ২৪০০ টাকা। এতে দেখা যায়, মিল পর্যায়েই মোটা চালের দাম বেড়েছে বস্তাপ্রতি ২০০ টাকা। মাঝারি আকারের চাল পাইজাম প্রতি বস্তা বিক্রি হয় ২৬৫০-২৭০০ টাকা দরে, যা এক মাস আগে ছিল ২৫৮০ টাকা। মিনিকেট বস্তা বিক্রি হয় ৪২০০ টাকা, যা এক মাস আগে ৪০০০ টাকা ছিল। নাজিরশাইল ২৫ কেজির বস্তা ২১০০ টাকা, যা আগে ২০০০ টাকা ছিল।

নওগাঁর চালকল মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ব্যবসায় নতুন উপলক্ষ্য হয়েছে ধান। বেশি লাভের আশায় মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ধান ব্যবসায় ঝুঁকছেন। তারা আমন মৌসুমে কৃষকের কাছ থেকে ১১০০ টাকা মন ধান কিনে বাড়িঘর এমনকি বাড়ির আশপাশে গুদাম বানিয়ে মজুত করছেন। নিয়েছেন কয়েক মাসের টার্গেট। কারণ, এখন কৃষকের হাতে ধান নেই। তারা মাঠ থেকে ধান তুলে বিক্রি করে দিয়েছেন। মৌসমি চক্র অতি মুনাফা করতে কয়েক মাস পর ধান মনপ্রতি ১৬০০-১৭০০ টাকায় বিক্রির ছক তৈরি করে। এতে মিল পর্যায়ে ধানের সরবরাহ কমায় চালের দাম বেড়ে যাচ্ছে। যার প্রভাব পাইকারি ও খুচরা বাজারে পড়েছে।

কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন যুগান্তরকে বলেন, ধানের বাজারে কোনো ধরনের নজরদারি নেই। যে যেভাবে পারছে মজুত করে বাজারে অস্থিরতা তৈরি করছে। এক কেজি চাল যদি ৯০ টাকা দিয়ে কিনতে হয়, তাহলে আমরা কোন সমাজে আছি? এমন না যে, দেশে দুর্ভিক্ষ লেগেছে। ধান আবাদ হচ্ছে। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় বেশি হচ্ছে। পাশাপাশি আমদানিও হচ্ছে। কিন্তু ভোক্তার উপকার হচ্ছে না। বেশি দাম দিয়ে চাল কিনতে হচ্ছে।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, গত বছর আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে ভারতে থেকে ধেয়ে আসা বন্যার কারণে বেশ কয়েকটি জেলায় আমন ধানের উৎপাদন ব্যাহত হয়। এতে সরকারি হিসাবে প্রায় ১০ লাখ মেট্রিক টন চাল কম উৎপাদন হয়েছে। সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে ইতোমধ্যে সরকার ভারত, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম ও মিয়ানমার থেকে প্রায় সাড়ে ৮ লাখ মেট্রিক টন চাল আমদানি চুক্তি করেছে। ভারতের সঙ্গে আমদানি চুক্তি হয় ৫ লাখ মেট্রিক টনের। এর মধ্যে ৩ লাখ ৫৩ হাজার ৭১১ মেট্রিক টন চাল আমদানি সম্পন্ন হয়েছে। ভারতের সঙ্গে করা চুক্তির বাকি চাল আমদানি পর্যায়ে রয়েছে। মিয়ানমার থেকে এক লাখ টন চাল আমদানির চুক্তি করা হয় এবং ইতোমধ্যে এক লাখ টন চাল আমদানি সম্পন্ন হয়েছে। ভিয়েতনাম থেকে ১ লাখ টন চাল আমদানির চুক্তি হয় এবং ইতোমধ্যে ৮৪ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন চাল দেশে এসেছে।

এছাড়া পাকিস্তান থেকে ৫০ হাজার টন চাল আমদানির চুক্তি হয়েছে এবং সব চাল ইতোমধ্যে আমদানি সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া সরকারিভাবে ইউক্রেন ও আর্জেন্টিনা থেকে আরও দুই লাখ টন গম আমদানি চুক্তি হয়েছে। ইতোমধ্যে ১ লাখ ৫০ হাজার টন গম আমদানি সম্পন্ন হয়েছে এবং বাকি গম আমদানি পর্যায়ে রয়েছে। অর্থাৎ সরকারি সংগ্রহ পর্যাপ্ত এবং বাজারে চাল বা গমের কোনো ঘাটতি নেই।

খাদ্য মন্ত্রণালয়সংশ্লিষ্টরা জানান, বাজারে চালের ঘাটতির আশঙ্কায় সরকার বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে বিদেশ থেকে ১১ লাখ ৭৫ হাজার টন চাল আমদারি অনুমতি দিয়েছে। বেসরকারিভাবে এ পর্যন্ত ৪ লাখ ৪৮ হাজার ৬৫০ মেট্রিক টন চাল আমদানি করা হয়েছে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

চালের বাজার অস্থিরতার নেপথ্যে কী

আপডেট টাইম : ০৫:২৯:৫১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল ২০২৫

আমন মৌসুমে কৃষকের কাছ থেকে মনপ্রতি ১১০০ টাকায় ধান কিনে ছোট ছোট গুদামে মজুত করে। কয়েক মাস পর সেই ধান ১৬০০-১৭০০ টাকা বিক্রির টার্গেট নেয় চক্রটি। ফলে কৃষক পর্যায়ে সরবরাহ কমায় মিল পর্যায়ে বাড়তে শুরু করে চালের দাম। মৌসুমি ব্যবসায়ীদের একচেটিয়া ধান মজুতের প্রভাবে এবার নতুন করে চালের বাজারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে।

এর প্রভাব পড়ে পাইকারি বাজারে। খেসারত হিসাবে খুচরা বাজারেও চালের মূল্য বাড়ছে হুহু করে। চালে এই বাড়তি খরচের মাশুল গুনতে হচ্ছে দেশের সব মানুষকে। এখন গরিবের মোটা চাল কিনতে কেজিপ্রতি খরচ হচ্ছে ৬০-৬২ টাকা। এতে বিপদে পড়েছেন নিম্ন-আয় ও খেটে খাওয়া মানুষ।

অপরদিকে খুচরা বাজারে মিনিকেট ও নাজিরশাইলের কেজি ঠেকেছে ৯০-৯৬ টাকায়। অর্থশালীদের জন্য এক কেজি মিনিকেট চাল ৯৬ টাকায় কেনা সম্ভব হলেও মধ্যবিত্ত শ্রেণির আয় কমে যাওয়ায় তারা আর পারছেন না। ঝুঁকছেন মোটা চালের দিকে। সোমবার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।

সোমবার রাজধানীর নয়াবাজার, জিনজিরা কাঁচাবাজার, মালিবাগ বাজার ও রামপুরা কাঁচাবাজারসহ চারটি বাজার ঘুরে চালের দাম বৃদ্ধির চিত্র পাওয়া গেছে। এতে দেখা যায়, এক মাস আগে প্রতি কেজি মোটা চালের মধ্যে স্বর্ণা জাতের মূল্য ছিল আগে ৫৫ টাকা। এখন (২১ এপ্রিল) সেই চাল কেজিপ্রতি ৫-৭ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৬০-৬২ টাকায়। ৬২ টাকার পাইজাম চাল বিক্রি হচ্ছে ৬৫ টাকা দরে। ৮৫ টাকার মিনিকেট বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৯০-৯২ টাকায়। তবে উচ্চমূল্যে নাজিরশাইলের দাম ৯০-৯৬ টাকায় স্থিতিশীল রয়েছে।

বাজারে চালের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় ভোক্তাসাধারণ উদ্বিগ্ন। যদিও অন্তর্বর্তী সরকারের খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার মনে করেন, আমন মৌসুমের শেষভাগে এসে বাজারে চালের দাম ১/২ টাকা বাড়া অস্বাভাবিক কিছু না। বিপুল আমদানি এবং সংগ্রহ সত্ত্বেও কেন বাজার নিয়ন্ত্রণে আসছে না-এমন প্রশ্নে তিনি যুগান্তরকে বলেন, খোঁজ নিয়ে দেখেন বাজারে সবকিছুর দাম একটু বেড়েছে। চালের দাম একটু বাড়াটাও স্বাভাবিক। কারণ, কৃষক যদি ন্যায্যমূল্য না পান বা উৎপাদন মূল্য হারান, তাহলে তারা চাষাবাদ বন্ধ করে দেবেন।

উপদেষ্টা আরও বলেন, সরকার চলতি মৌসুমে ৪৯ টাকা দরে বোরো চাল ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ৩৬ টাকা দরে বোরো ধান এবং গম সংগ্রহ করা হবে। দাম বাড়ানোর পেছনে যুক্তি হচ্ছে কৃষককে স্বাবলম্বী করা। কৃষককে লাভবান করতেই এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। উপদেষ্টা বলেন, মাঝারি মানের চাল বাজারে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু মোটা চাল (সাধারণ মানুষের চাল) ৫২ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

যদিও সরকারি সংস্থা টিসিবির হিসাবে সোমবার খুচরা বাজারে প্রতি কেজি মোটা চালের দাম ছিল সর্বোচ্চ ৫৭ টাকা। এক মাস আগে টিসিবির মূল্য তালিকায় এ চাল সর্বোচ্চ ৫৫ টাকায় বিক্রির তথ্য দেওয়া আছে। সরকারি হিসাবেও মাসের ব্যবধানে মোটা চালের দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ২ টাকা।

নয়াবাজারে চাল কিনতে আসা মো. ইউসুফ বলেন, চাল ছাড়া আমাদের চলে না। সেই চালের দাম যদি এত হয়, আমাদের কীভাবে চলবে। বাজারে সব ধরনের চালের দামই বাড়তি। মধ্য আয়ের ইউসুফ আগে মিনিকেট চাল কিনতেন। তবে বাজারে এসে সেই চাল ৯০ টাকার ওপরে দেখে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, এক কেজি চাল কিনতে যদি ৯০ টাকা খরচ করি, তাহলে অন্যান্য পণ্য কী করে কিনব?

মালিবাগ কাঁচাবাজারের খালেক রাইস এজেন্সির মালিক দিদার হোসেন যুগান্তরকে বলেন, এবার মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চালের বাজার অস্থির করে রেখেছেন। তারা বেশি দামে ধান বিক্রির জন্য মজুত করেছেন। এতে মিল পর্যায়ে দাম বাড়ায় পাইকারি বাজারে দাম বেড়েছে।

এদিকে রাজধানীর কাওরান বাজারের পাইকারি আড়ত আল্লাহর দান রাইস এজেন্সির মালিক সিদ্দিকুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, চালকল মিলে দাম বেড়েছে। মৌসুমি ধান বিক্রেতাদের কারসাজিতে এবার চালের দাম বেড়েছে। তিনি জানান, মিল থেকে চাল এনে পরিবহণ খরচ ও কিছু লাভ রেখে আমরা বিক্রি করে দিই। সেক্ষেত্রে পাইকারি পর্যায়ে মোটা চালের মধ্যে স্বর্ণা জাতের চাল বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) ২৬৫০ টাকায় বিক্র করছি, যা এক মাস আগেও ২৫৫০ টাকা ছিল। মোটা জাতের স্বর্ণা চাল বস্তাপ্রতি বেড়েছে ১০০ টাকা। তিনি জানান, পাইজাম চালের বস্তা বিক্রি করছেন ২৮০০ টাকা, যা আগে ২৭০০ টাকা ছিল। তার কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, পাইজাম বেড়েছে বস্তাপ্রতি ১০০ টাকা। অপরদিকে তিনি মিনিকেট বিক্রি করছেন বস্তা ৪৩০০ টাকা, যা এক মাস আগে বিক্রি করেছেন ৪১০০ টাকায়। অর্থাৎ মিনিকেটে বস্তাপ্রতি বেড়েছে ২০০ টাকা।

এদিকে ঢাকার বাইরে সোমবার নওগাঁ ও দিনাজপুরে মিল পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সোমবার প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) স্বর্ণা জাতের মোটা চাল বিক্রি হয় ২৫৫০-২৬০০ টাকায়, যা এক মাস আগে ছিল ২৪০০ টাকা। এতে দেখা যায়, মিল পর্যায়েই মোটা চালের দাম বেড়েছে বস্তাপ্রতি ২০০ টাকা। মাঝারি আকারের চাল পাইজাম প্রতি বস্তা বিক্রি হয় ২৬৫০-২৭০০ টাকা দরে, যা এক মাস আগে ছিল ২৫৮০ টাকা। মিনিকেট বস্তা বিক্রি হয় ৪২০০ টাকা, যা এক মাস আগে ৪০০০ টাকা ছিল। নাজিরশাইল ২৫ কেজির বস্তা ২১০০ টাকা, যা আগে ২০০০ টাকা ছিল।

নওগাঁর চালকল মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ব্যবসায় নতুন উপলক্ষ্য হয়েছে ধান। বেশি লাভের আশায় মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ধান ব্যবসায় ঝুঁকছেন। তারা আমন মৌসুমে কৃষকের কাছ থেকে ১১০০ টাকা মন ধান কিনে বাড়িঘর এমনকি বাড়ির আশপাশে গুদাম বানিয়ে মজুত করছেন। নিয়েছেন কয়েক মাসের টার্গেট। কারণ, এখন কৃষকের হাতে ধান নেই। তারা মাঠ থেকে ধান তুলে বিক্রি করে দিয়েছেন। মৌসমি চক্র অতি মুনাফা করতে কয়েক মাস পর ধান মনপ্রতি ১৬০০-১৭০০ টাকায় বিক্রির ছক তৈরি করে। এতে মিল পর্যায়ে ধানের সরবরাহ কমায় চালের দাম বেড়ে যাচ্ছে। যার প্রভাব পাইকারি ও খুচরা বাজারে পড়েছে।

কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন যুগান্তরকে বলেন, ধানের বাজারে কোনো ধরনের নজরদারি নেই। যে যেভাবে পারছে মজুত করে বাজারে অস্থিরতা তৈরি করছে। এক কেজি চাল যদি ৯০ টাকা দিয়ে কিনতে হয়, তাহলে আমরা কোন সমাজে আছি? এমন না যে, দেশে দুর্ভিক্ষ লেগেছে। ধান আবাদ হচ্ছে। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় বেশি হচ্ছে। পাশাপাশি আমদানিও হচ্ছে। কিন্তু ভোক্তার উপকার হচ্ছে না। বেশি দাম দিয়ে চাল কিনতে হচ্ছে।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, গত বছর আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে ভারতে থেকে ধেয়ে আসা বন্যার কারণে বেশ কয়েকটি জেলায় আমন ধানের উৎপাদন ব্যাহত হয়। এতে সরকারি হিসাবে প্রায় ১০ লাখ মেট্রিক টন চাল কম উৎপাদন হয়েছে। সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে ইতোমধ্যে সরকার ভারত, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম ও মিয়ানমার থেকে প্রায় সাড়ে ৮ লাখ মেট্রিক টন চাল আমদানি চুক্তি করেছে। ভারতের সঙ্গে আমদানি চুক্তি হয় ৫ লাখ মেট্রিক টনের। এর মধ্যে ৩ লাখ ৫৩ হাজার ৭১১ মেট্রিক টন চাল আমদানি সম্পন্ন হয়েছে। ভারতের সঙ্গে করা চুক্তির বাকি চাল আমদানি পর্যায়ে রয়েছে। মিয়ানমার থেকে এক লাখ টন চাল আমদানির চুক্তি করা হয় এবং ইতোমধ্যে এক লাখ টন চাল আমদানি সম্পন্ন হয়েছে। ভিয়েতনাম থেকে ১ লাখ টন চাল আমদানির চুক্তি হয় এবং ইতোমধ্যে ৮৪ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন চাল দেশে এসেছে।

এছাড়া পাকিস্তান থেকে ৫০ হাজার টন চাল আমদানির চুক্তি হয়েছে এবং সব চাল ইতোমধ্যে আমদানি সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া সরকারিভাবে ইউক্রেন ও আর্জেন্টিনা থেকে আরও দুই লাখ টন গম আমদানি চুক্তি হয়েছে। ইতোমধ্যে ১ লাখ ৫০ হাজার টন গম আমদানি সম্পন্ন হয়েছে এবং বাকি গম আমদানি পর্যায়ে রয়েছে। অর্থাৎ সরকারি সংগ্রহ পর্যাপ্ত এবং বাজারে চাল বা গমের কোনো ঘাটতি নেই।

খাদ্য মন্ত্রণালয়সংশ্লিষ্টরা জানান, বাজারে চালের ঘাটতির আশঙ্কায় সরকার বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে বিদেশ থেকে ১১ লাখ ৭৫ হাজার টন চাল আমদারি অনুমতি দিয়েছে। বেসরকারিভাবে এ পর্যন্ত ৪ লাখ ৪৮ হাজার ৬৫০ মেট্রিক টন চাল আমদানি করা হয়েছে।