রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা হিসেবে ঢাকা মহানগরীর থানাগুলোর প্রায় চার হাজার মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করে মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছেন ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট ওমর ফারুক ফারুকী। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর বিরোধী দলের রাজনৈতিক কর্মসূচিকে ঘিরে নাশকতার অভিযোগে এসব মামলা করা হয়। অনেক সময় কর্মসূচি ছাড়াই গায়েবি নাশকতার মামলা দেওয়ার অভিযোগও আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে ছিল। আওয়ামী লীগ একটানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকায় তা আর প্রত্যাহারের সুযোগ হয়নি। বরং প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনের আগে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের টার্গেট করে অনেক মামলায় সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করে। শত শত নেতাকর্মীকে দণ্ড দেওয়া হয়। ২০০৯ সালের পর গত ৫ জুলাই পর্যন্ত সারাদেশে ১ লাখ ৪২ হাজার ৯৮৩ মামলায় ৫৯ লাখ ২৯ হাজার ৪৯২ জনকে আসামি করা হয়। তাদের বেশির ভাগই বিএনপির নেতাকর্মী।
সূত্র জানায়, সুপারিশ হওয়া মামলাগুলোর অধিকাংশই চার্জশিট দাখিল হওয়ার পর ট্রায়ালের পর্যায়ে রয়েছে। বাকি মামলাগুলো তদন্তাধীন। এসব মামলায় ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের ১৭ জুলাইয়ের মধ্যে দায়ের হওয়া।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক মামলা প্রত্যাহারের উদ্যোগ নেয় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। সে পদক্ষেপের অংশ হিসেবে প্রথমে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের গত ১৭ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত দায়ের হওয়া ২২৮ নাশকতার মামলায় ৩ হাজার ৫৬ জন আসামির অব্যাহতি চেয়ে পুলিশের মাধ্যমে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। আদালত চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করলে মামলাগুলো শেষ হয় এবং আসামিরা অব্যাহতি পায়। যেখানে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং বিরোধীয় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ও ছাত্র অন্দোলনসহ নেতাকর্মী আসামি ছিলেন। এরপর গত ২২ সেপ্টেম্বর রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক মামলা প্রত্যাহারে সরকার জেলা ও মন্ত্রণালয় পর্যায়ে দুটি কমিটি গঠন করে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে আবেদনের সময়সীমা বেঁধে দেয়। এরপরই সারাদেশে আবেদন শুরু হয়। ঢাকা জেলা ও ঢাকা মহানগরীর থানাগুলোর আবেদনের স্থান ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়।
সূত্র জানায়, ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর প্রায় চার হাজার মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করে মন্ত্রণালয়ে পাঠালেও ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে এক হাজার মামলা প্রত্যাহারের আবেদনও পড়েনি।
এ সম্পর্কে ওমর ফারুক ফারুকী বলেন, মামলা প্রত্যাহারের আবেদন জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে কম পড়েছে। তবে তিনি নিজ উদ্যোগে রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক মামলার তালিকা সংগ্রহ করেছেন। যার মাধ্যমে তিনি প্রায় চার হাজার মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করে মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, মামলাগুলোয় বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং বিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাসহ সাধারণ মানুষও আসামি রয়েছেন। তালিকা সংগ্রহের কাজ এখনও চলমান, যা শেষ হলে আবার সুপারিশসহ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।
এদিকে জানা গেছে, গত ৫ আগস্টের পর ঢাকা সিএমএম, ঢাকা মহানগর দায়রা জজ এবং সিজেএম এবং ঢাকা জেলা জজ আদালতে বিচারাধীন রাজনৈতিক মামলাগুলোর অধিকাংশই নিষ্পত্তি করে আসামিদের খালাস বা অব্যাহতি দিয়েছেন আদালত। সূত্র জানায়, এভাবে প্রায় দুই হাজার মামলা নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। শুধু বাকি আছে উচ্চ আদালত কর্তৃক স্থগিত থাকা এবং তদন্তাধীন মামলা। যা প্রত্যাহারের সুপারিশ করছেন পাবলিক প্রসিকিউটর কার্যালয়।
বিএনপির দপ্তর সূত্র জানায়, ২০০৯ সালের পর গত ৫ জুলাই পর্যন্ত সারাদেশে নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ১ লাখ ৪২ হাজার ৯৮৩ মামলায় ৫৯ লাখ ২৯ হাজার ৪৯২ জনকে আসামি করা হয়েছে। শুধু ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর থেকে তিন মাসের মধ্যে সারাদেশে ১ হাজার ৬৪৫ মামলায় প্রায় ৭০ হাজার নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছিল। মামলাগুলোর মধ্যে ঢাকা মহানগরের ৫০ থানায় ১৭ হাজার ৫৮৩টি মামলা রয়েছে বলে দাবি বিএনপির।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, গত জাতীয় নির্বাচনের আগে ২০২৩ সালের আগস্ট মাস থেকে ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকা ও ঢাকা মহানগর এলাকাধীন থানার নাশকতার ৫৫ মামলায় বিএনপি ও তার অঙ্গসংগঠন এবং জামায়াতে ইসলামী ও তার অঙ্গসংগঠনের প্রায় ৮৪৫ নেতাকর্মী ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট, ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ এবং ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিভিন্ন রায়ে দণ্ডিত হন।
আরও উল্লেখ্য, ২০০৯-১৩ মেয়াদের আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের আমলে ‘রাজনৈতিক হয়রানিমূলক’ বিবেচনায় ৭ হাজার ১৯৮টি মামলা সম্পূর্ণ বা আংশিক প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হয়েছিল। এর উল্লেখযোগ্য একটি অংশ ছিল হত্যা মামলা। আর ২০০১-০৬ মেয়াদে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারও একই কায়দায় ৫ হাজার ৮৮৮টি মামলা সম্পূর্ণ প্রত্যাহার এবং ৯৪৫টি মামলা থেকে কিছু আসামিকে অব্যাহতি দেয়।